
‘জিম্মি’ হলাম অবশেষে…
সময়ের কাছে জিম্মি ছিলাম এ ক’দিন। ঈদের ব্যস্ততার কারণে বহুল প্রতীক্ষিত ওয়েব সিরিজটি চাইলেও দেখতে পারিনি। অবশেষে হইচইয়ের দুনিয়ায় প্রবেশ করে দেখে নিলাম প্রিয় পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার আশফাক নিপুনের সাত পর্বের সিরিজ ‘জিম্মি’। বিপ্লবের আগুন বরবারই টগবগ করে এই নির্মাতার কলমে। প্রথমবারের মতো তিনি পাওয়ারহাউজ অব অ্যাক্টিং ট্যালেন্ট জয়া আহসানকে নিয়ে কাজ করেছেন, যিনি বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দুই বাংলার চলচ্চিত্রে কালজয়ী কিছু চরিত্র উপহার দিয়েছেন। যে চরিত্রগুলোর ভার অনেক বেশি। এমন অভিনেত্রী যখন সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘মহানগর’-খ্যাত নির্মাতার সঙ্গে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে অভিষেক করবেন, স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম, ইস্পাত কঠিন কোনো গল্প দেখবো; ’২৪ এর অভ্যুত্থান নিয়ে মাথা ভারী কোনো কনটেন্ট পাবো। আর এখানেই ‘টুইস্ট’। আশফাক নিপুন রীতিমত আমাদের সাথে খেলেছেন। দিনশেষে তিনি আমাদের জন্য বানিয়েছেন একটি ডার্ক কমেডি। আর এখানেই ‘জিম্মি’র মহাসাফল্য। পুরো সিরিজ দেখার পর বার বার অনুভব করছিলাম, আরো আগে কেন ‘জিম্মি’র দুনিয়ায় যুক্ত হলাম না। এক বসাতেই ‘জিম্মি’ সাবাড় করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি।

সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয়, নির্মাতা আশফাক নিপুন চাইলেই আরেকটি ‘মহানগর’ নির্মাণ করতে পারতেন, তবে তিনি তা করেননি। নিরাপদ জোন থেকে বেরিয়ে আরেকটি সাহসী সিরিজ নির্মাণ করেছেন। সাহসী বলছি, কারণ: খুব কম প্লাটফর্ম/নির্মাতাই নারীকেন্দ্রিক গল্প নিয়ে কাজ করেন। কালেভদ্রে হলেও সেগুলো হয় দমবন্ধ সিরিয়াস কোনো ইস্যু নিয়ে। এ জায়গাতেই আশফাক নিপুন ছক্কা পিটিয়েছেন। তিনি তার স্মার্ট রসবোধের হাঁড়িতে হালকা আঁচে ক্ষমতার হাত বদলের গল্প পাকিয়েছেন। ক্ষমতার হাত বদল হলে যে রক্ত-মাংসে গড়া মানুষেরও রঙ বদল হয়-সেই অপ্রিয় সত্যটিই যেন নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ডার্ক কমেডির মোড়কে বাংলাদেশের এক্স-রে রিপোর্ট তুলে ধরেছেন। এই গল্প দেখতে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে, আমাদের সবার গল্প, খাঁটি বাংলাদেশের গল্প। ওটিটি প্লাটফর্মে এমন অনুভূতি অনেকদিন হয়নি। অন্যান্য সিরিজের মত ‘জিম্মি’তে অহেতুক ভায়োলেন্স, গালিগালাজ ছিল না। এটিও আমাদের জন্য পরম পাওয়া।
আমরা বিদেশী সিরিজে ‘মিস্টি কমেডি থ্রিলার’ দেখি। ‘জিম্মি’ও সেই ব্র্যাকেটে পড়ে। দুর্দান্ত রসবোধের মোড়কে সরকারী অফিসের অন্ধকার ভূতের গল্প আমাদের দেশের স্ক্রিনে কখনো দেখছি কিনা, মনে পড়ে না। আশফাক নিপুন আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইঙ্গিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের চিত্র তুলে ধরেছেন এই সিরিজে; যেখানে দুদক কর্মকর্তাও দুর্নীতিবাজ। এই গল্প বলতে গিয়ে আশফাক নিপুন ’২৪-এর জুলাই-আগস্টের সময়কালকে বেছে নিয়েছেন। আবু সাঈদ, ৫ আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছাড়ার পর সরকারী অফিসগুলোতে ছবি নামানো, এস আলম গ্রুপের দুর্নীতি-প্রতিটি বিষয়ই এসেছে ‘জিম্মি’তে। একবারের জন্য আরোপিত মনে হয়নি। ’২৪-এর অভ্যুত্থানের পর সেই সময়টিকে ধরে এবারই বড় আকারে একটি সিরিজ নির্মিত হলো। একদিন হয়তো এই সিরিজটিই দলিল হয়ে থাকবে।
‘জিম্মি’র মূল চালিকাশক্তি ‘রুনা লায়লা’। যে চরিত্রে জয়া আহসান রং ছড়িয়েছেন। কিংবদন্তী শিল্পীর নামে কেন জয়া আহসানের চরিত্রটির নামকরণ করা হয়েছে, তা এই সিরিজ দেখলেই জানা যাবে। সেই সাথে জয়া আহসানের স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের আরেকটি জগত আবিষ্কার করা যাবে এই সিরিজে। তার পরিমিত অভিব্যক্তি, সংলাপ প্রক্ষেপণ, বডি ল্যাংগুয়েজ, চোখের ভাষা-সবকিছুতেই অদ্ভুত সাবলীলতা। এ কারণেই হয়তো চিত্রনায়ক বাপ্পারাজ ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘অভিনয় করতে গিয়ে অভিনয় না করাটাও একটা দক্ষতা, যা জয়ার আছে’। লোভী, ভুক্তভোগী-প্রতিটি সত্তাতেই গুণী অভিনেত্রী জয়া আহসানের আরো কয়েকটি লেয়ার খুঁজে পাওয়া যাবে ‘জিম্মি’ তে। এক কথায়: ফ্লোলেস। সত্যি বলতে, ‘রুনা লায়লা’ চরিত্রে তিনি ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করাও কঠিন। টাকার কবরে কিংবা রেললাইনে শুয়ে থাকার দৃশ্য কিংবা আজাদ-রানার সঙ্গে হোটেলের দৃশ্য কিংবা গহনার দোকানে বাহাস, সেখান থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আবেগের রূপান্তরের দৃশ্য, তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথোপকথন-জয়া আহসান পুরোটা সময় জুড়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। শেষ দৃশ্যে তিনি যখন মনোলোগে সংলাপ বলে হেঁটে আসেন, সেই দৃশ্য শেষে হাত তালি দিয়ে অলক্ষ্যেই বলেছি— ওয়াও!!!

এই সিরিজে পুরুষ চরিত্রগুলোর মধ্যে ‘আজাদ’ আমার অন্যতম ভালো লাগার চরিত্র। গোবেচারা চরিত্রে ইরেশ যাকের বরাবরই দুর্দান্ত। এবারো এই সাধারণ চরিত্রে সহজ-স্বাভাবিক অভিনয় দিয়ে দর্শকদের হৃদয়ে অসাধারণ জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। কক্সবাজারে হোটেলে জ্যুস ফিরিয়ে দেয়ার দৃশ্য হোক কিংবা ফোনে পাহাড়ী/বিদেশী ফিরিয়ে দেয়ার দৃশ্য কিংবা বিলাসবহুল বিছানায় ‘মি টাইম’-প্রতিটি মুহূর্তেই ইরেশ যাকের দর্শক পক্ষের একজন হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন চিত্রনাট্যে। শেষ পর্যন্ত দর্শকরা তাকে সমর্থন দিয়েছেন। জয়া আহসান-ইরেশ যাকেরের জুটিও ম্যাজিকাল ছিল ‘জিম্মি’ তে।
শাহরিয়ার নাজিম জয় এই সিরিজে ‘রানা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তাকে কেন আশফাক নিপুন কাস্ট করেছেন, শুরুতে বিস্মিত হয়েছিলাম। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ সিরিজ দেখে নির্মাতার পছন্দে সহমত পোষণ করেছি। এরকম চরিত্রে শাহরিয়ার নাজিম ছাড়া আর কে-ই বা এত সাবলীল অভিনয় করতে পারতো? ‘রানা’র বুদ্ধিদীপ্ত রস, সাবলীল ভঙ্গিতে মিথ্যে বলা, গণধোলাইয়ের দৃশ্য-সবই পূর্ণ বিনোদন দিয়েছে আমাদের। জয়া আহসানের সঙ্গে কাচ্চি বিরিয়ানী/এলাচের দৃশ্যটি তো ছিল এপিক। ধূসর চরিত্র হলেও দীর্ঘদিন পর শাহরিয়ার নাজিম জয়কে কোনো সিরিজে এতটা ম্যাচুওর/ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মনে হয়েছে। হিমছড়ির চূড়ায় কিংবা হোটেল রুমে জয়-জয়ার কেমিস্ট্রিও জমে ক্ষীর হয়েছিল।
আশফাক নিপুন বরাবরই কাস্টিং করতে গিয়ে আমাদের চমকে দিতে ভালোবাসেন। ‘জিম্মি’ তে সেরকম একজন ছিলেন, তিনি: মুনিরা বেগম মেমী। ছোটবেলার প্রিয় অভিনেত্রী সাম্প্রতিক সময়ে বেশ অনিয়মিত। তাকে শেষ কবে কোন নাটক/ সিনেমায় এত সাবলীল লেগেছে, মনে পড়ে না। তার কণ্ঠ, চলন-বলন সবকিছুতেই ভীষণ ‘মায়া’।
এরফান মৃধা শিবলু, শাহাদাত শিশির ‘জিম্মি’র ভিলেন। আঙুল কাটা, বেল্ট খুলে ছাদ থেকে ফেলে দেয়া-বর্বর সব কাজ করার পরও ভীষণ মজার তারা। প্রান্তর দস্তিদার বরাবরই নির্ভরযোগ্য। ‘কবির’ চরিত্রে তার সাবলীল অভিনয় প্রমাণ করেছে, গুণী নির্মাতারা (মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আশফাক নিপুন, ভিকি জাহেদ) কেন তাকে কাস্ট করেন। শক্তিমান অভিনেতাদের সঙ্গেই পরিমিত আত্মবিশ্বাস নিয়ে সহজ-স্বাভাবিক অভিনয় করেছেন প্রান্তর। রফিউল কাদের রুবেল, মাহমুদ আলমসহ অফিসের যারা সহকর্মীর চরিত্র করেছেন, তারা চিত্রনাট্য এগিয়ে নিয়ে গেছেন দারুণভাবে। এত বিশ্বাসযোগ্য মজার অভিনয় তাদের মত শক্তিশালী অভিনয়শিল্পীদের পক্ষেই সম্ভব। অশোক বেপারীকে নিয়েও নতুন করে বলার কিছু নেই। তার বাচনভঙ্গি, সংলাপ প্রক্ষেপণ সবকিছুরই ভক্ত আমি। ‘জিম্মি’তেও তিনি তার চরিত্রে শতভাগ সৎ ছিলেন। কক্সবাজারের সোলায়মান কিংবা আজাদের দাদী/দাদীর দেখভাল করার মেয়ে/গানের শিক্ষক কিংবা প্রতিবাদী ছাত্রদের প্রতিনিধি-সবাই নিজ নিজ চরিত্রে ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন।
আশফাক নিপুন ‘জিম্মি’র গল্প ধারণ করেছেন পাবনার দৃষ্টিনন্দন লোকেশনে। আর দশটা কনটেন্ট থেকে খুব সহজেই আলাদা করা গেছে ‘জিম্মি’কে। এ ক্ষেত্রে চিত্রগ্রাহক বরকত হোসেন পলাশের মুনশিয়ানার তারিফ করতেই হয়। আউটডোর কিংবা ইনডোরে শট কম্পোজিশন, লাইটিং-সবকিছুই ছিল যথাযথ। সরল সম্পাদনা, জাহিদ নীরবের সামঞ্জস্যপূর্ণ আবহ সংগীত, এলিটা করিমের শিরোনাম গান ‘জিম্মি’র গভীরতাকে সঙ্গত করেছে দারুণভাবে।
গুণী ও চাহিদাসম্পন্ন নির্মাতাদের মধ্যে আশফাক নিপুন একই সাথে নির্ভরতার নাম, আবার হতাশারও নাম। ২/৩ বছর পর নতুন কনটেন্ট নিয়ে আসেন, এটা একদিকে যেমন হতাশার; অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিটি কনটেন্টই তার নামের প্রতি সুবিচার করেছে-ওটিটি প্লাটফর্মের জন্য এটি দারুণ প্রাপ্তির। জীবনটা আসলে অদ্ভুত এক গোলক ধাঁধা। একবার এ চক্রে আটকে গেলে জীবন চলে তার গতিতে। আর আমরাও জিম্মি হয়ে যাই সেই গোলক ধাঁধায়। রুনা লায়লাও আমাদের নতুন এক ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। তিনি ‘জিম্মি’ তে ‘মহানগর’-এর নির্যাস নিয়ে এসেছেন। ‘যদি থাকে নসীবে, আপনা আপনি আসিবে’ কিংবা ‘আপনার সামনে দুইটা রাস্তা খোলা আছে’-এসব ইঙ্গিত আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করছে। তবে কি সামনে রুনা লায়লা আর ওসি হারুনকে আমরা একসাথে দেখতে পাবো?