Select Page

জীবনের কাছাকাছি ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’

জীবনের কাছাকাছি ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’

ওভার অ্যাক্টিং ছেড়ে কীভাবে সাধারণ জীবন ও আবহমান মনুষ্যবৈচিত্র্যের আলাপনের মধ্যে থেকে চলচ্চিত্রকে সাধারণ মানুষের উপযোগী বই, ছোটগল্প, সাহিত্য বা উপন্যাসের মতো করে ছোট ছোট ডায়ালগে শিল্পীর তুলির প্রতি আঁচড়ে বিমূর্ত ক্যানভাস যেমন মূর্ত হয়ে উঠে, ঠিক তেমনি জীবনের প্রতিটি নান্দনিক উপায়কে অবলম্বনে আঁকা কল্পনাশক্তিকে বিস্তৃত করে মানুষের কাছাকাছি শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গন পরিপূর্ণ করে তুলতে পারা সেই অ-আনুষ্ঠানিক শিল্পকলা হয়তো চলচ্চিত্র পরিচালক শিহাব শাহীন অর্জন করেছেন। এটা নন-ফিকশন শিল্প ভ্রমণ পিপাসুদের প্রথম চাওয়া হয়তো।

তা নাহলে চরকিতে রিলিজ হওয়া গত ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ, ভাষাশৈলী, জীবনের অসংখ্য বাঁক, তরুণ জীবনের প্রতিবন্ধকতা, পিতৃ-মাতৃকুল বা বাপ-ভাই পরিচয়হীন একটা জীবন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন পার করা হতাশাগ্রস্ত বাঙালি জীবনকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে তুলে ধরার পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন কালচার ও জীবনবোধ, বিদেশী প্রবাসী জীবন বিরহ ও ভালোবাসার দূরত্ব, জীবনের কঠিন  অভিজ্ঞতা, বাস্তব পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবিলা, আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের সোসাইটি কালচার এবং বর্তমানের সোসাইটি কালচারের যে অনিবার্য কনফ্লিক্ট, স্বার্থান্বেষী জীবনের খোলস থেকে বেরিয়ে নৈর্ব্যত্তিক জীবনের প্রতি প্রবল আদি অকৃত্রিম অকৃপণ টান অনুভূতি, জীবনের চাওয়া-পাওয়াকে কীভাবে সাধারণ কাতারে নিয়ে আসারই গল্পই ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ সিনেমায় ফুটে উঠেছে। এই চলচ্চিত্রটি আমার প্রবাসী বন্ধুরা জীবন্তরূপে পাবে।

একটা বনরুটি খেয়ে সারাবেলা পার করা রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারা একজন প্যারাহীন যুবক কীভাবে হালের রাজশাহী নগরীরতে শিফট করা খুলনাবাসীর মায়ার জালে জড়িয়ে যায়। হলের জীবনের প্রাইভেসি সংকটে একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মেসের মানবেতর জীবন ফুটে উঠে এই চলচ্চিত্রে, পৃথিবীর আর কোথাও এমন বিশ্ববিদ্যালয় আছে কিনা জানা নাই যেখানে ছাত্ররা গণরুমে থাকে।

একজন নারীর ওপর রাস্তাঘাটে ছিনতাইকারীর উপদ্রব, ছিনতাইকারী হাতে শিকার, বাংলাদেশ সর্বোচ্চ শিক্ষিত হয়ে ইনকামের লিমিটেশন নিয়ে চলা আধুনিক স্বপ্নবাজ তরুণীর জীবন, এদেশে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সারভাইভ করার জীবন, পরিবারের হাল ধরার জীবন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মতো স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা পাশাপাশি একটা পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জীবন, আপ্রাণ চেষ্টা সদিচ্ছার জীবন, মা-বাবার প্রতি পদে পদে বিপদ-আপদ সংকুল পরিবেশে একটা মেয়ে পাশে থেকে গোটা পরিবারকে অসংখ্য সংকট সমস্যার হাত থেকে বাঁচানোর সাহসী উদ্যোগ, নিজের স্বার্থ, প্রেম-ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দেয়ার মতো আগেও অসংখ্য চলচ্চিত্রে আমরা দেখেছি কিন্তু সেগুলো হৃদয় পানে কতটুকু দাগ কেঁটে রয়ে গেছে সেই হিসাব নিশ্চিতভাবে দর্শকরাই ভালো বলতে পারবে। কিন্তু ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ ফিল্মে এই বিষয়গুলো নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

এ সিনেমার দুটি বিশেষ বড় দিক হচ্ছে; দুই প্রান্তের দুটি চরিত্রকে কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে হাঁটানো। সাবলীল সমস্যার মধ্য দিয়ে হাঁটানো। মানুষ যখন নির্মল-নিষ্পাপ থাকে তখন কঠিন বাস্তবতা তার কাছে ভয়াবহ রূপে ধরা দেয়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়েই বেশিরভাগ মানুষ জীবনকে জটিল দূরত্ব অভিজ্ঞ করে তুলে। কিন্তু মানুষের লিমিটেশন জীবন ও জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জন্য জীবনকেই সাবলীল রাখা এতো সহজ কাজের কাজ নয় অন্তত পদবাচ্য মানুষের জন্য। এটা জেনেটিক্যালি আসলে থাকতে হয়। কয়েক পূর্ব পুরুষের হাত থাকতে হয়। কয়েক পূর্ব পুরুষের হাতের ওপরও জীবনের গতিপ্রকৃতি অনেক দিক দিয়ে নির্ভর করে।

আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি শুধু তুমি আর আমিতে একটা সময় ফুলেফেঁপে বড় হয়েছিল ঠিক, কিন্তু ভালোবাসার সমাধির মধ্যেই সেই সিনেমাগুলোকে সীমাবদ্ধ রাখা হতো। কিন্তু ওটিটি প্লাটফর্মের অবতারণা হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ট্যাবুগুলোকে ভাঙার একটা কালচারাল মুভমেন্ট শুরুর রাস্তা তৈরি হয়েছে। যেখানে ভালোবাসা শুধু নিঃস্বার্থ ভালোবাসাই নয়,অসংখ্য স্বার্থ পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবিলা করার যে স্ট্রাগল সেটা ফিল্ম ফ্রেসে দেখাচ্ছে।

তুমি-আমি থেকে বের করে অবজিটিভিটির এক্সজিসটেন্স দেখাচ্ছে। অবজিটিভিটি এনশিউওর না হওয়া পর্যন্ত ভালোবাসা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক থাকছে। মনস্তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করছে অবজিটিভিটি। এটা কালচারালি এনরিচ করার প্রবণতাই যে ফিল্ম সেটা আমাদের পুরাতন চলচ্চিত্র নির্মাতারা জানতেন কিনা আমার জানা নেই। তবে আমাদের এই বাংলার নব জাগরণে কিছু কাজ যে হয়নি তা কিন্তু নয়। সেই লিস্ট মহিমান্বিত রূপেই আমাদের কাছে আছে।

বিগ স্কিনে প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে জীবনের প্রবাহকে দেখানোর যে চলচ্চিত্র এই বাংলায় একটা সময় ছিলো সেগুলো গত পঞ্চাশ বছরে ভারতীয় আর্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে অনেক দিক দিয়ে লোপ পেয়েছিলো। কিন্তু সেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনকে মার্জিত করেনি বরং এই সুড়ঙ্গ পথে এসেছে অসংখ্য বিকৃতি। সবচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে; আমরা ও আমাদের সমাজ অভ্যন্তরে অসংখ্য বিকৃতির মধ্যে হাঁটা সত্ত্বেও নোডাল পয়েন্টে এমন কিছু গ্রামসির সাবওল্টার্ন থিওরির মতো করে  বলতে হয়; আমাদের এমন কিছু চলচ্চিত্র পরিচালক নির্মাতা সৃষ্টি হয়েছে যারা রেহেনা মরিয়ম নূর, হাওয়া থেকে শুরু করে ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’র মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সাহস দেখাচ্ছে। আমি কয়েকদিন আগেও দেখেছি পত্রিকার নিউজে; কলকাতার সিনেমা বাংলাদেশি সিনেমার দাপটে টিকছে না। শিল্পী কলাকুশলীরা মার্কেট হারাচ্ছে। এতে খুশী হওয়ার কিছু নেই। দুঃখ পাওয়ার আছে অনেককিছু।

শিহাব শাহীন পরিচালিত ওয়েব ফিল্ম ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’য় প্রথমবারের মতো জুটি বেঁধেছেন প্রীতম হাসান ও তাসনিয়া ফারিণ। দুজনই অসম্ভব ভালো অভিনয় করেছেন। তাসনিয়া ফারিণ অনেক ম্যাচিউর অভিনয় শিল্পী হয়ে উঠেছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে; বলিউডের অনেক নামকরা শিল্পী থেকেও ভালো অভিনয় করেছেন। প্রীতম হাসানের অভিনয়কে অভিনয় মনে হয়নি। মনে হয়েছে নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনার মধ্যেই তিনি আছেন। প্রীতম আর অভিনয় আলাদা কোনো সত্তা নয়।

এই সিনেমায় নতুন মুখ দেখা মিলেছে রূপন্তী আকিদকে। তিনিও প্রথম হিসেবে নিজেকে ছাপিয়ে গেছেন। আরো অভিনয় করেছেন সমাপ্তি মাশুক, খলিলুর রহমান কাদেরী, শিরিন আলম, শুভজিৎ ভৌমিক ও শাহীন শাহনেওয়াজ। প্রত্যেকেই ভালো অভিনয় করেছেন।

২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট ২২ সেকেন্ডের ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’ দেখে চোখে আরাম লেগেছে। সময়টা ভালো কেটেছে। চোখের কোনে দু-এক ফোটা জল এসেছে। গানের লিরিকস ভালো লেগেছে। এটাই এই সিনেমার সার্থকতা। এমন ফিল্ম আরো আসুক এবং গুণগত বিবর্তন ঘটুক বাংলা কনটেন্টের।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

লেখক ও কলামিস্ট

মন্তব্য করুন