Select Page

ট্রল করলেও এখনো শাবানা-জসিমরাই সেরা

ট্রল করলেও এখনো শাবানা-জসিমরাই সেরা

সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ট্রল’ এখন খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমিও নিজেও অনেক বিষয় নিয়ে ট্রল করি।  তবে ট্রল করার ক্ষেত্রে সবসময় ব্যক্তি,  ঘটনা, বিষয়বস্তু খুব  সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করি। অর্থাৎ সেই সব ব্যক্তি বা ঘটনা নিয়ে ট্রল করি যা ট্রল করার মতোই কিছু। কিন্তু  সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা  ‘ট্রল জেনারেশন’ কখনো এসব বোঝে না।  তারা যাকে খুশি তাকে নিয়ে ট্রল করে।  একবারও ভাবে না, যাকে নিয়ে ট্রল করছি তিনি কোনো ব্যক্তি কিনা বা ট্রল করার মতো কোন কাজ করেছেন কিনা?

বর্তমান প্রজন্মের কাছে ট্রলের সাবজেক্ট হিসেবে প্রয়াত অভিনেতা জসিম ও অভিনেত্রী শাবানা খুবই জনপ্রিয়।  অথচ যে বা যারা আজ তাদের নিয়ে ট্রল করছে খোঁজ নিয়ে দেখবেন জসিম ও শাবানার কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে এদের কোন ধারণাই নেই। সবচেয়ে বড় কথা জসিম প্রয়াত হয়েছেন আজ ২৪ বছর; যিনি আমাদের কোন সমালোচনা,  আলোচনা, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের জবাব দিতে পারবেন না।  সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি চলে গেছেন ২ যুগ আগে অর্থাৎ আজকের জেনারেশন জীবিত জসিমকে দেখেনি। শাবানা জীবিত থেকেও একদম আড়ালে আছেন ২ দশক ধরে; যিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় আছেন বলে আমার জানা নেই।  অথচ এই দুজনকেই সবচেয়ে বেশি ট্রলের শিকার হতে হয়। 

জসিম শুধুই একজন সফল অভিনেতা ছিলেন না তিনি বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটা অধ্যায়ও বটে। সহঅভিনেতা থেকে পর্দা কাঁপানো প্রধান খলনায়ক, সেখান থেকে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ১০ সফল নায়কের একজন জসিম। তার মতো অভিনেতা বাংলাদেশ কেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় আরেকজন খুঁজে পাওয়া যাবে না। অভিনেতা হয়েই জসিম থেমে থাকেননি; বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ফাইট ডিরেক্টর, ফাইটিং গ্রুপের জনক এবং সফল প্রযোজক হিসেবেও চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন।

জসিম ও তার বন্ধু মীর এনামুল করিম  আমান, মাহবুব খান গুই, বাবুল  মিলিত  জ্যাম্বস প্রোডাকশন থেকে নির্মিত  দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’,  ‘আসামী হাজির’,  ‘বারুদ’, ‘জনি’,  ‘ওস্তাদ সাগরেদ’,  ‘মাস্তান রাজা’, ‘কালিয়া’, ‘বাংলার নায়ক’-এর সুপার ডুপার হিট সিনেমা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক  চলচ্চিত্রের সম্পদ হয়ে আছে।  এ চলচ্চিত্রগুলোর মান ও ব্যবসায়িক সফলতার ধারে কাছে গত দেড় দশকের নির্মিত তথাকথিত কয়েক শতাধিক ডিজিটাল চলচ্চিত্রের একটিও নেই। 

আজকের ডিজিটাল চলচ্চিত্রের  প্রযোজক, পরিচালক ও কলা-কুশলীরা যা পারেনি তা জসিম দেখিয়েছেন।  জসিম আমার প্রিয় নায়ক নয় কিন্তু আমরা যারা সেই সময়কার সাক্ষী তারা দেখেছি যে জসিমের সিনেমা মানেই ‘হাউসফুল’ বোর্ড থাকবে। জসিমের সিনেমা দেখতে আমার বাপ, চাচা, মা, খালাদের ভিড় যেমন দেখেছি ঠিক তেমনি সালমান শাহ – ওমর সানী যুগের দর্শকদেরও ছুটে যেতে দেখেছি। ঈদ উৎসবে জসিমের সিনেমা থাকবেই থাকবে, কারণ জসিম মানেই দর্শকদের কাছে ছিল মারমার কাটকাট সিনেমা।

জসিমের হাত ধরেই যেমন নায়ক রিয়াজ এসেছে তেমনি তারও আগে এসেছিল খলনায়ক আহমেদ শরীফ,  মাহবুব খান,  গাঙ্গুয়া, ফাইট ডিরেক্টর আরমান,  চুন্নু,  পরিচালক রায়হান মুজিব,  এফআই মানিকসহ আরও অনেকে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে জসিমের অবদান সম্পর্কে লিখতে গেলে পুরো একটা বই লেখা যাবে।  জসিমকে নিয়ে ট্রল করার আগে জসিম সম্পর্কে আগে ভালো করে জেনে নেবেন। 

শাবানা হলেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের একমাত্র অভিনেত্রী যিনি তার অভিনয় জীবনের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত দাপুটে অভিনেত্রী হিসেবে শীর্ষে ছিলেন।  বাংলাদেশের দুটি প্রজন্মের চলচ্চিত্রের দর্শকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে ধরে রেখেছিলেন যা আর কেউ পারেননি। চলচ্চিত্রের সংখ্যা, অভিনীত চরিত্রের সংখ্যা, ব্যবসায়িক সফলতা,  জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সংখ্যা কোন কিছুতেই শাবানার ধারে-কাছে কোন অভিনেত্রী নেই।

তিনি এমনই অভিনেত্রী ছিলেন যে  বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দুটো কথা প্রচলিত ছিল—  ‘শাবানার চোখের জলের দাম কোটি টাকা’ এবং ‘শাবানার সিনেমায় নায়ক লাগে না, শাবানা থাকলেই সিনেমা চলবে’।  অর্থাৎ যে সিনেমায় শাবানা যত বেশি কাঁদবে সেই সিনেমা তত বেশি সফলতা পাবে।   শাবানাকে কেন্দ্র করে যদি সিনেমার গল্প হয় তাহলে সিনেমার নায়ক থাকলো কী থাকলো না সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়,  দর্শক শাবানাকে দেখতেই হলে যাবে এবং শাবানা পুরো গল্পটিকে টেনে নিতে পারবে।  এই দুটো ব্যাপার শাবানা ছাড়া আজ পর্যন্ত আর কোন অভিনেত্রীর বেলায় ঘটেনি এবং ঘটবেও না।

শাবানার গ্রহণযোগ্যতা এতটাই ছিল যে প্রধান নায়িকা চরিত্রে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা সময়ে শাবানা জাফর ইকবাল ও ইমরানের মায়ের চরিত্রে (অপেক্ষা সিনেমায়) অভিনয় করার সাহস দেখাতে পেরেছেন যা তার সম সাময়িক কবরী,  ববিতা, শবনম সাহস করেনি।  শুধু তাই নয় সেই চরিত্রের জন্য জাতীয় পুরস্কারও জিতে নিয়েছিলেন। শাবানা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্র অভিনেত্রী দুই শাখাতেই জাতীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। 

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের যত অভিনেত্রী প্রযোজক হয়েছিলেন তাদের মধ্যেও সফলতায় ছিলেন শাবানা সবার শীর্ষে।  যারা দর্শক ও নিয়মিত খোঁজ রাখেন এমন ব্যক্তিরাও বিস্মিত হবেন যে শাবানার প্রযোজিত সিনেমাগুলোর নাম শুনলে যা প্রায় সকলে দেখেছেন কিন্তু জানতেন না যে ছবিগুলো শাবানার এসএস প্রোডাকশন থেকে নির্মিত।  শাবানার প্রযোজিত সিনেমাগুলো হলো আজিজুর রহমানের ‘মাটির ঘর’, কামাল আহমেদের ‘রজনীগন্ধা’,  ‘নাজমা’, ‘গরীবের বউ’,  ‘অবুঝ সন্তান’,  মতিন রহমানের  ‘লাল কাজল’,  এ জে মিন্টুর ‘মান সম্মান’, ‘অশান্তি’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, মতিন রহমানের ‘রাঙা ভাবী’, ‘অন্ধ বিশ্বাস’, মনোয়ার খোকনের ‘ঘাত প্রতিঘাত’,  ‘স্বামী কেন আসামী’,  ‘মেয়েরাও মানুষ’।  উল্লেখিত সিনেমাগুলো কী পরিমাণ সফল ছিল তা সেই সময়কার পত্র-পত্রিকা ঘাটলেই জানা যাবে।  সালমান-ওমর সানীর সেরা সময়েও শাবানা কেন্দ্রিক সিনেমা নির্মিত হতো অনায়াসে এবং  সেগুলো সুপারহিট ব্যবসাও করতো। যার প্রমাণ দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘চাকরানী’, মোতালেব হোসেনের ‘স্ত্রী হত্যা’, বাদল খন্দকারের ‘বিশ্বনেত্রী’ সিনেমাগুলো।  এমন একজন অভিনেত্রীকে যখন একটা প্রজন্ম ট্রল করে অসম্মান করে তখন একজন দর্শক হিসেবে খুব কষ্ট লাগে।


About The Author

ফজলে এলাহী (কবি ও কাব্য)

আমি ফজলে এলাহী পাপ্পু, কবি ও কাব্য নামে লিখি। স্বর্ণযুগের বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানকে এ যুগের সকলের কাছে পৌছে দেয়ার আগ্রহে লিখি।

Leave a reply