Select Page

ডুবন্ত মানুষের আখ্যান

ডুবন্ত মানুষের আখ্যান

ডুবসাঁতার (in too deep); পরিচালক: নুরুল আলম আতিক; শ্রেষ্ঠাংশে: জয়া আহসান, শেহজাদ চৌধুরী, শ্রাবস্তী দত্ত তিন্নি, শাহরিয়ার শুভ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি প্রমুখ; মুক্তি: ১৭ নভেম্বর ২০১০

ডুবে ডুবে জল খাও?

এরকম প্রশ্ন সমাজে চলতে গেলে শুনতে হয়। ভেতরে ভেতরে মানুষ কি করছে বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল। ‘ডুবসাঁতার’ ভেতরের গল্প বলা ছবি। এ ধরনের ছবি দেখায় একটা আলাদা শান্তি আছে। ভাবনার জগতে ডুবে থাকা যায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও এবং সে ভাবনা থেকে আপনি দাঁড় করাতে পারেন আপনার নিজস্ব একটা অবজারভেশন।

আদতে বাইরে থেকে দেখলে ‘ডুবসাঁতার’ মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ছবির ভাষায় গভীরভাবে বলে যায় যে এটা ভালো অভ্যাস নয়। এর জন্য জীবনে ভুল হতে পারে অনেকরকম যে ভুলটিকে ঢাকার জন্য আরো কিছু ভুল বা অনাকাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত, পরিণতি এসবের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

ভেতর থেকে দেখলে ‘ডুবসাঁতার’ একটা ডুবন্ত আখ্যান যেখানে অনিশ্চিত যাত্রা আছে কিছু মানুষের যারা ভেসে থাকতে চেয়েছিল জীবনে অস্তিত্ব রক্ষা করতে কিন্তু ডুবে গেছে।

জয়া আহসান মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য যার মাদকবিরোধী জরিপ করে সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম আছে। তার সহকর্মীকে নিয়ে সে জরিপ করতে গিয়ে মাদকসেবী একটা ছেলের (শেহজাদ) সাক্ষাৎকার নেয়। সেখানে তাকে ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হয়। ছেলেটির সাথে মেলামেশার ফলে একসময় গর্ভবতী হয়ে গেলে পরিবারে জানাজানি হয়। ছেলেটা ততদিনে জয়ার পরিবারেও একটা স্থান করে নেয় জয়ার বড়ভাইয়ের সাথে দাবাখেলার সুবাদে। চুরি করে ভাত খাওয়া এক চোরকে আবিষ্কার করে জয়ার মা ওয়াহিদা মল্লিক জলি। জলি প্রথমে তাকে বকাঝকা করলেও পরে আদর করে ভাত খেতে দেয়। জয়ার ছোটভাই শুভ বোনের কাছে টাকা নিয়ে ফূর্তি করে গার্লফ্রেন্ড তিন্নির সাথে। ভাতচোরের পালিয়ে যাওয়া দেখে এলাকাবাসী ভুল করে মেরে ফেলে শেহজাদকে সেও তখন জয়াদের বাড়ি থেকে যাচ্ছিল দাবা শেষ করে।

ছবিতে দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে এক একটা মিনিং দাঁড় করিয়ে সাইকোলজিক্যাল কেস স্টাডি টাইপের কিছু একটা করতে চেয়েছেন পরিচালক নুরুল আলম আতিক। তিনি একসাথে যাদেরকে প্রেজেন্ট করেছেন। তারা সবাই সবাইকে ধোঁকা দেয়ররপ্রথমত নিজেকে দ্বিতীয়ত কাছের মানুষগুলোকে। ডিটেইলে বলা যাক-

* জয়া মাদকবিরোধী জরিপ চালাতে গিয়ে মাদকসেবী শেহজাদের সাথে মিশতে থাকে। শেহজাদ বেশিরভাগ সময় নেশাগ্রস্ত থাকত। জয়া একদিন মাথা গরম করে বলে-’কি আছে এটার মধ্যে? দেখি আমাকেও দাও তো।’ এভাবেই ড্রাগস নিতে থাকে তারপর শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে সন্তানের মা হতে চলে। সেটা যখন দুজনের অস্তিত্বের লড়াই হয় জয়া স্বাভাবিকভাবেই মেয়ে হিশাবে সামাজিক সমস্যায় পড়ার দিকটা ভেবে উত্তেজিত থাকে শেহজাদের প্রতি। শেহজাদ বলে-’ব্যবস্থা একটা হবে।’ জয়ার মা পরিবারের মান-সম্মান নিয়ে চিন্তা করে তখন।

* তিন্নিকে দিয়ে ফরম ফিলআপের কথা বলে জয়ার কাছ থেকে এক হাজার টাকা নেয় শুভ। তিন্নি বাসায় এসে বলে আর শুভ প্রাচীরের ওপার থেকে মজা করে। জয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায় শুভ+তিন্নি আড্ডা দিচ্ছে আর তারা নিজেদের লুকাতে ব্যস্ত তখন।

* ভাতচোরকে না পেয়ে কার জায়গায় শেহজাদকে ভাতচোর ভেবে পিটিয়ে মারে লোকজন। পরদিন পুলিশি তদন্তে জয়া জানতে পারে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

দৃশ্যগুলো একটা বাস্তব আবহ তৈরি করে। জয়া নিজে যে মাদকবিরোধী কার্যক্রম শুরু করেছিল সে নিজেই মাদকসেবী হয়ে ভুল করে এবং নিজের খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। শেহজাদের ঢেকে রাখা চুলদাড়িগুলো তার ভেতরের রূপটাকে ঢেকে রাখার একটা প্রতীকী রূপ। শুভ ও তিন্নি মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে পাল্টে যাওয়া প্রজন্মের আনন্দকে প্রাধান্য দেয় অথচ বোঝে না জয়ার কাছ থেকে নেয়া টাকাটা সংসারে কাজে লাগতে পারত। ভাতচোরকে না পেয়ে শেহজাদকে পিটিয়ে মারার ঘটনা আমাদের পরিস্থিতির দোষ যেখানে আমরা একজনের জায়গায় অন্যকে শাস্তি দিতে প্রায়ই অভ্যস্ত। মানুষ ভেতরে বাইরে এজন্য দুইরকম।

জয়ার অভিনয় ন্যাচারালি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রথম শটেই বোঝা যায় কত বড় মাপের অভিনেত্রী সে। এক মা তার ছেলেকে পুকুরে সাঁতার কাটাচ্ছে। সেটা দেখে স্বস্তি পায় জয়া। ডুবসাঁতারের ইঙ্গিতটা সেখানেই। জয়ার কণ্ঠে ‘তোমার খোলা হাওয়া’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি অনবদ্য। জলি তার মতো অসাধারণ। শেহজাদ, তিন্নি, শুভ ভালো ছিল।

ছবিতে প্রতীকী ইমেজে ‘sign and meaning’-কে দেখানো হয়েছে। জয়ার শৈশবে ভাইবোনের ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্যগুলো অতীত-বর্তমান পার্থক্য তুলে ধরে। একটা রাজহাঁস রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন কখন এসে গেছে রাজহাঁসটি বুঝতে পারেনি। যখন উপর দিয়ে চলে যায় রাজহাঁসটি কোনোমতে নিজেকে লুকায়। ডানা সে ঝাপটাতে থাকে আর কিশোরী জয়া চিৎকার করতে থাকে। রাজহাঁসটা একটা sign ছিল। এ দৃশ্যটার গভীর কোনো অর্থ পরিচালক বোঝাতে চেয়েছেন যা সম্পূর্ণ ধরা যায় না। সম্পূর্ণ ধরতে পারলে অবশ্য ছবিতে আড়াল বলে কিছু থাকে না। থাক না কিছু আড়াল।

ডুবে ডুবে জল খাওয়া গ্রামীণ লাইফস্টাইলের থেকে নাগরিক জীবনে বেশি এবং প্রধান। তার একটা ডকুমেন্টেশন আছে এ ছবিতে। মানুষের অন্তর-বাহির চিনতে ছবিটা কাজের কাজ।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন