ঢাকার হরর সিনেমা হিসেবে কয়েক যোজন এগিয়ে ‘মোনা: জ্বীন ২’
[হালকা স্পয়লার]
মোনা: জ্বীন ২; নির্দেশনায়: কামরুজ্জামান রোমান; কুশীলব: তারিক আনম খান, আহমেদ রুবেল, সুপ্রভাত, দীপা খন্দকার, সামিন বাসার।
ভয়ের আখ্যান:
ভয় মানুষের এক আদিমতম ও সহজাত প্রবৃত্তি। এর ভাষা সার্বজনীন। এতোটাই সার্বজনীন যে বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য, চলচ্চিত্র, চিত্রকর্মে ভয় ফুটে উঠেছে বারংবার। বাংলা সাহিত্য ভয়ের গল্পে বেশ সমৃদ্ধ হলেও রুপোলি ফিতায় এর ছাপ পড়েনি। এক প্রতিবেদন উল্টে দেখলাম আমাদের ইন্ড্রাস্টির ৬৩ বছরের যাত্রায় হরর চলচ্চিত্র মোটে এগারটি। সে হিসেবে বারোতম ‘মোনা: জ্বীন ২’।
মোনার কথা:
মোনা এই গল্পের মূল চরিত্র। বছর তের এর মেয়েটির বাবা আলেখ, জ্বীন-ভূত নিয়েই তার কারবার। কমবয়সের কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে একরাতে সে ডেকে আনে এক জ্বীনকে। বিজয় সাইকোলজির প্রফেসর। যুক্তির মধ্যে যা পড়ে না এমন কোনকিছুর অস্তিত্বে সে বিশ্বাসী না। পত্রিকার শিরোনামে ওঠা এক পাঁড়াগাঁয়ের জ্বীনের গল্প সে মেনে নিতে নারাজ। তাই তিন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে চলে যায় মোনার গ্রামে। কিন্তু প্রবল যুক্তিবাদী সাইকোলজিস্টের যুক্তিবুদ্ধি একটু একটু টলে যেতে শুরু করে অতিপ্রাকৃতবাদের সামনে। জ্বীন রহস্যের সূত্র উন্মোচনে ডাক পড়ে প্রফেসর এলাহীর… মূল প্লটটা আমাদের অপরিচিত কোন গল্প না। এবার দেখা যাক পর্দায় তা কতটা ফুটলো।
উইলিং সাসপেন্সন অফ ডিসবিলিফ:
ভয় যেন নেশার মতো। মানুষ ভয় পেতে পছন্দ করে। সেটা এতোটাই যে যখন আমরা ভৌতিক কিছু পড়ি বা দেখি তখন আমাদের বিশ্বাসের বাইরে গিয়েও গল্পকে সত্যি বলে গ্রহণ করি, একেই বলে উইলিং সাসপেন্সন অফ ডিসবিলিফ।
যেখানে মোনা শিহরণ জাগিয়েছেঃ
মোনার সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট এর সিনেমাটোগ্রাফি। ক্যামেরার পেছনে খুব ভালো মানের একটা কাজ হয়েছে। ক্যামেরা প্রতিটা চরিত্রকে যেভাবে অনুসরণ করেছে আমাদের দেশের খুব কম চলচ্চিত্রেই এমন হয়। ডেভেলপমেন্ট আর সাসপেন্স মোমেন্টে বারবার যেভাবে টিল্টিং, জুম ইন-আউট করা হয়েছে, বিগ শট থেকে ধীরে কিন্তু স্থিতধীভাবে ক্লোজ শটে পৌঁছেছে তা প্রশংসার দাবীদার। শট ট্রানজিশন আমাদের এখানে বেসিক শটের ব্যবহারই হয় বেশি। মোনা: জ্বীন ২ এর চমক ছিল শট ট্রানজিশন টেকনিকে। ক্যারেক্টারের ওপর ক্যামেরা স্থির করে ব্যাকগ্রাউন্ড চেঞ্জ করে এভাবে শট ট্রানজিশন করাটা আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রি যে ভাবনা চিন্তায় আগাচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ। খুব পরিপাটি একটা সেট ডিজাইন। সেই সাথে বোনাস হিসেবে তারিক আনাম আর আহমেদ রুবেলের ভালো অভিনয়। ও হ্যাঁ সুপ্রভাত কিছু সিনে অভিব্যক্তিতে সমস্যা করেছেন বটে। তবে সব মিলিয়ে ভালোই করেছেন।
যেখানে হয়েছে ‘শ্রী’হরণ:
প্রথমেই বলি অভিনয়। খুবই কাঁচা, বিশেষত সামিনা বাশার মনে হচ্ছিল অতিঅভিনয়ের সেরাটা দিয়েছেন পর্দায়। যেহেতু গল্পের প্রয়োজনে বারবার বিগ ক্লোজ শট নেয়া হয়েছে, পাত্র-পাত্রীদের এক্সপ্রেশনের খামতিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। দ্বিতীয়ত আলোর ব্যবহার। দেখুন ভয়ের একটা প্রধান উৎস অন্ধকার। পর্দায় পুরো অন্ধকার দেখানো সম্ভব না। কিন্তু আলো-অন্ধকারের যেই ব্যালেন্সটা দরকার ছিল ওটার হিসাব পরিচালক বেশিরভাগ সময় মেলাতে পারেননি। শব্দ ভয় উদ্রেককারী আরো একটা শক্তিশালী উপাদান। কিন্তু শুধু উঁচু শব্দ আর বিদঘুটে চিৎকার জুড়লেই ভয় তৈরি হয় না৷ অনেকসময় বরং তা কানের জন্য ক্ষতিকর। পরিচালকের অমনোযোগিতা ছিল চোখে লাগার মতো। নতুবা কেন ঠিক উচ্চারিত হবে টিক? সাব-কনশাস কে শাব-কনশাস?? আর মন কে মণ??? দিনের এক সিকুয়েন্স পরের কাট এওয়ে শটে আবার রাত চলে আসার বা দিনের বেলা গুড নাইট সংলাপ বলার নেপথ্যে অমনোযোগিতা ছাড়া আর কিই বা বলবো? ভয়ের সিনেমায় নেগোসিয়েশন, ইমোশনাল সিন আনাটা রীতিমতো অপরাধ। গল্প নষ্ট করার এসব উপাদান সিনেমায় যথেষ্ট ছিল। অ্যাকশন দৃশ্যগুলো বাস্তবসম্মত ছিল না। আর ভয় ধরানোর জন্য প্রতিবার সাদা চোখ দেখানোটা এই সময় হাস্যকর ও একঘেঁয়ে। আরো অন্য কিভাবে ভয়ের আবহ তৈরি করা যায় তা নিয়ে পরিচালকের ভাবাটা একান্তই দরকার।
টানছি ইতি এবার:
ভয়ের গল্প ভয় থাকবে এই স্বাভাবিক। মোনা ১০০ ভাগ না পারলেও কিছু কিছু দৃশ্যে ভয় ধরিয়েছে। কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস আর কিছু অমনোযোগিতা গল্পের ক্ষতি করেছে ঠিক। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত আমাদের যেসব হরর সিনেমা হয়েছে মোনা তাদের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে। একটা লম্বা সময় আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রিতে একই রকম কাজ চলেছে বছরের পর বছর। এখন দেখছি নিরীক্ষা হচ্ছে অনেকরকম। মোনা: জ্বীন ২ তেমনই নিরীক্ষার ফল। একদম হাড় হিম করা কিছু নেই তবে আপনি যদি আগেই ঠিক করে রাখেন পর্দায় যায় দেখাক আমি হাসবো। তাহলে মোনা: জ্বীন ২ না দেখাই আপনার কর্তব্য।