ঢাকার সিনেমা হল : কোন হলের পরিবেশ কতটা ভালো
২০১৭ সালের শেষের দিকে এসে মনে মনে একটা লক্ষ্য স্থির করি, ঢাকার বুকে এখনো টিকে থাকা সবগুলো সিনেমাহলের বর্তমান অবস্থা কিরকম তা নিজ চোখে পরখ করবো। সিনেমাহলের ভিতরকার পরিবেশ কেমন, নতুন সিনেমা মুক্তি পেলে সেখানে কোন শ্রেণির দর্শক সমাগম বেশি হয়, পুরোনো সিনেমাগুলির দর্শক কেমন; সবমিলিয়ে একজন দর্শক হিসেবে এক একটি সিনেমাহলে আমার এক্সপেরিয়েন্স কেমন হয় সেটাই নিজ চোখে দেখার জন্যে আমার এমন উদ্ভট ডিসিশন নেওয়া।
১৭-০৮-২০১৯ই তারিখে জোনাকি সিনেমা হলে “বেপরোয়া” দেখার মাধ্যমে আমার ঢাকার প্রায় সবগুলো হলে সিনেমা দেখা শেষ হলো। পুরোনো ও নতুন সিনেমা চালিয়ে ঢাকায় টিকে থাকা ৩০ টি সিনেমাহল কে আমি মোট ৬ ভাগে ভাগ করেছি। যথা-
১. টপ ক্লাস কোয়ালিটি।
২. উন্নতমানের।
৩. মধ্যমমানের।
৪. নিম্ন মধ্যমানের।
৫. নিম্নমানের।
৬. অতি নিম্নমানের।
এর মধ্যে অতি নিম্নমানের কিছু সিনেমাহলের পরিবেশ এতোটাই খারাপ যে, টিকেট কেটে ভেতরে ঢোকার সৎসাহস পাইনি। তাই আমার এই লক্ষ্য পুরণ হওয়ার পর ভাবলাম, সিনেমাহলগুলোর বর্তমান অবস্থা প্রকৃতপক্ষে কেমন সেটা সম্পর্কে অনিয়মিত দর্শকদের কিছুটা ধারণা দিয়ে সাহায্য করা উচিত। এতে করে তাদের বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে না। তো
চলুন কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক…
১. টপ ক্লাস কোয়ালিটি
ধানমন্ডির সীমান্ত সম্ভারে অবস্থিত স্টার সিনেপ্লেক্স, পান্থপথের বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত ব্লকবাস্টার সিনেমাস, শ্যামলীতে অবস্থিত শ্যামলী সিনেমা এবং নিউমার্কেটে অবস্থিত বলাকা সিনেওয়ার্ল্ড এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। এই ৫ সিনেমা হলে আপনি এককথায় ডিজিটাল সিনেমার পরিপূর্ণতা খুজেঁ পাবেন। উন্নতমানের প্রজেক্টর, উন্নতমানের সাউন্ড কোয়ালিটি, আরামদায়ক আসনব্যবস্থা, পরিষ্কার টয়লেট, খুবই টিপটপ গোছানো পরিবেশ ইত্যাদি আপনার মনে একপ্রকার শান্তি এনে দিবে। এসব সিনেমাহলে ছোট শিশু হতে শুরু করে বৃদ্ধ অব্দি সব দর্শকদের সমাগম দেখা যায়, তবে তরুণ টিনএজ দর্শকদের সমাগম এসব সিনেমাহলে কিছুটা বেশি।
টিকেটের দাম সাধারণত ২০০-৪০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, দাম তুলনামূলক একটু বেশি হওয়ায় এখানে উচ্চবিত্তের সমাগম বেশি। এই ক্যাটাগরির সবগুলো হল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং বলাকা বাদে বাকি সবগুলো হলের টিকেট অনলাইনে বুক করা যায়। বলাকার সুযোগ-সুবিধা এদিক থেকে কিছুটা আলাদা, তারা প্রতিদিন সকালের শো এর টিকেটের দাম অর্ধেক রাখে। সম্প্রতি মহাখালী এবং মিরপুর-১ এ স্টার সিনেপ্লেক্সের আরো দুটি শাখার কাজ চলছে, পাশাপাশি মধুমিতা সিনেমাকে আধুনিকায়নের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এগুলো বাস্তবায়ন হলে এই তিনটি হলও এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত হবে।
২. উন্নতমানের:-
এই সিনেমাহলগুলির পরিবেশ বেশ ভালো। ভালো সাউন্ড কোয়ালিটি, পরিষ্কার পর্দা, মোটামুটি আরামদায়ক আসনব্যবস্থা ও মোটামুটি মানের টয়লেট সিনেমাহলগুলোতে ভালো দর্শক সমাগম করতে সহায়তা করে।
এই ক্যাটাগরির সিনেমাহলগুলোর ভিতরকার পরিবেশ যতটা ভালো, বাইরের পরিবেশ ততটা ভালো পাইনি। তাই তাদের এই ক্যাটাগরি অন্তর্ভুক্ত করা। মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা এবং টিকাটুলির অভিসার সিনেমা এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। দুটি হলই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, তবে ভালো দর্শক সমাগম নাহলে সাধারণত এসির ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করার সৌভাগ্য আপনার হবে না। টিকেটের দাম ৬০-১৫০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই হল দুটিতে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি অডিয়েন্সের সমাগম বেশি দেখা যায়, পাশাপাশি কর্মরত অফিসার ও স্টাফদের একটা বড় অংশকে এই দুই সিনেমাহলে দেখা যায়।
৩. মধ্যমমানেরঃ
এই ক্যাটাগরিতে ৪ টি সিনেমাহলকে তালিকাভুক্ত করতে পেরেছি। বনানীর সেনা সিনেমা (সৈনিক ক্লাব), পুরান ঢাকার নয়াবাজারে অবস্থিত চিত্রামহল সিনেমা, জিঞ্জিরায় অবস্থিত পাশাপাশি দুই হল নিউ গুলশান সিনেমা ও মিনি গুলশান সিনেমা এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে চিত্রামহল বাদে বাকি তিন হলের বাইরের পরিবেশ যথেষ্ট ভালো। সৈনিক সিনেমা হলের বাহিরে একটা বড় জায়গাজুড়ে গাছের ছায়াতলে দর্শকদের বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, বিষয়টি বেশ অন্যরকম লাগলো। এছাড়া চিত্রামহলের ভেতরকার রকমারি আলোকসজ্জা এককথায় দারুণ, বাইরের পরিবেশ ভালো না লাগলেও ভেতরকার এই আলোকসজ্জা আমার মন কেড়েছে।
টিকেটের দাম সাধারণত ৫০-১০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, এ সিনেমাহলগুলোতে স্থানীয় তরুণ ও কর্মজীবীদের যাতায়াত সবথেকে বেশি হয়। মোটামুটি মানের সাউন্ড কোয়ালিটি, মধ্যমমানের পর্দা ও ভিতরকার ভালো পরিবেশ এসিনেমাহল গুলোকে এই ক্যাটাগরিতে স্থান পেয়েছে। তবে এই ক্যাটাগরি সহ পরবর্তী তিন ক্যাটাগরির টয়লেটের অবস্থা বেগতিক।
৪. নিম্ন-মধ্যমানেরঃ
এ ক্যাটাগরিতে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ ৮ টি সিনেমাহল জায়গা পেয়েছে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শাহীন সিনেমা, পুরান ঢাকার হাজারীবাগে অবস্থিত বিজিবি অডিটোরিয়াম, কাকরাইলের রাজমনি সিনেমা, নয়াপল্টনের জোনাকী সিনেমা, রায়েরবাগের পুনম সিনেমা, যাত্রাবাড়ীর গীত সিনেমা এবং ডেমরার পাশাপাশি দুই হল রানীমহল ও মতিমহল এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। এসিনেমাহলগুলোর বাইরের পরিবেশ মধ্যমমানের সিনেমাহলগুলোর তুলনায় যথেষ্ট ভালো, কিন্তু ভেতরকার পরিবেশ ততটা ভালো না। কিছুটা ঘোলাটে পর্দা, মোটামুটি ধরণের সাউন্ড কোয়ালিটি ও ভাঙ্গাচোরা আসন ব্যবস্থা এহলগুলোকে এই ক্যাটাগরিতে স্থান দিয়েছে।
টিকেটের দাম সাধারণত ৪০-১০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। শাহীন, রাজমনি, জোনাকি ও বিজিবি অডিটোরিয়ামে চাকরিজীবী যুবকদের উপস্থিতি কিছুটা বেশি, অন্যদিকে গীত, পুনম, রানীমহল ও মতিমহলে স্থানীয় শ্রমিকদের উপস্থিতি কিছুটা বেশি। এ ক্যাটাগরির সবগুলো সিনেমাহলের টয়লেটের অবস্থা খারাপ। বিলাস (ড্রেস সার্কেল বা ডি.সি) এ সিনেমা দেখলে কিছুটা বেটার এক্সপেরিয়েন্সে উপভোগ করতে পারবেন।
৫. নিম্নমানেরঃ
বাসার কাছাকাছি হওয়ায় এই ক্যাটাগরির সিনেমাহলগুলোতে আমার সবথেকে বেশি সিনেমা দেখা হয়েছে। তাই অতি দুঃখবোধ সহকারে এগুলোর নাম লিখতে হচ্ছে। মিরপুর-১১.৫ এ অবস্থিত পূরবী সিনেমা, গাবতলী-টেকনিক্যাল মোড়ে অবস্থিত এশিয়া সিনেমা এবং রায়েরবাজারে অবস্থিত মুক্তি সিনেমা এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। এই তিন সিনেমাহলের বাইরের পরিবেশ ও ভেতরকার পরিবেশ দুটিই খারাপ। বলা যায় এই তিন হল একপ্রকার মুমূর্ষু অবস্থায় এখনো নতুন ছবি চালাচ্ছে। হয়তো খুব শীঘ্রই এই সিনেমাহলগুলো পুরোনো সিনেমা চালানো শুরু করবে।
টিকেটের দাম সাধারণত ৪০-৮০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ঘোলা পর্দা, পীড়াদায়ক সাউন্ড, নড়বড়ে আসন এবং বাজে টয়লেট এই তিন হলকে এই ক্যাটাগরিতে স্থান দিয়েছে। তথাকথিত বখাটে যুবকদের উপস্থিতি এহলগুলোতে কিছুটা বেশি, তাই এই সিনেমাহলগুলোতে বন্ধুবান্ধব ছাড়া অন্যকোনো সঙ্গী সঙ্গে থাকলে কিছুটা আনকমফোর্টেবল ফিল অনুভুত হয়।
৬. অতি নিম্নমানেরঃ
এই ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৮ টি সিনেমা হল জায়গা পেয়েছে। এর প্রায় সবগুলোই নতুন ছবি হলে চালানো বন্ধ করে দিয়েছে, পুরোনো ছবিই তাদের এখনকার রুটিরুজির জোগাড় করে। অবশ্য এ অবস্থার জন্য তাদের অতীত কর্মকান্ড দায়ী। দুটি নীতিকথা তাদের ক্ষেত্রে খুব সুন্দর খাটে; প্রথমটি, ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। দ্বিতৗয়টি, অতি লোভে তাতি নষ্ট।
ফার্মগেটের পাশাপাশি দুই হল আনন্দ সিনেমা ও ছন্দ সিনেমা, মালিবাগের পাশাপাশি দুই হল পদ্মা সিনেমা ও সুরমা সিনেমা, কাকরাইলের রাজমনি সিনেমার ভেতরে অবস্থিত রাজিয়া সিনেমা, টিকাটুলির মোড়ে অভিসার সিনেমার ভেতরে অবস্থিত নেপচুন সিনেমা, সদরঘাটের জনসন রোডে অবস্থিত আজাদ ম্যানশন এবং যাত্রাবাড়ীর গীত সিনেমাহলের পাশে অবস্থিত সংগীত সিনেমা এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে শুধুমাত্র আনন্দ সিনেমা হল এখনো নিয়মিত নতুন ছবি চালিয়ে যাচ্ছে, বাকিরা চালায় পুরোনো সস্তা বাণিজ্যিক ছবি। এই ৮ সিনেমা হলের মধ্যে ছন্দ ও সুরমার বাইরের পরিবেশ এতটাই জঘন্য যে, ভেতরে ঢোকার সৎসাহসটুকু আমার মধ্যে আসেনি। গুমোট পরিবেশ, ফাটা-ছেঁড়া পর্দা, বাজে সাউন্ড কোয়ালিটি, ভঙ্গুর আসন ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য এ ক্যাটাগরির সিনেমাহলগুলোকে পুরাতন কাছারি ঘরে রূপদান করেছে।
টিকেটের দাম ৩০-৫০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এসব সিনেমাহলে বখাটে যুবক এবং সুযোগসন্ধানী শ্রমিকদের আগমন সবথেকে বেশি হয়। দিনেরবেলা একদমই দর্শক সমাগম হয়না বললেই চলে, তবে সন্ধ্যা এবং রাতের শোতে ভালো দর্শক সমাগম হয়। সন্ধ্যার পর কিছু হলে সাধারণত বরখা পরিহিত পতিতাদের আগমন ঘটে, যাদের সাথে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে চাইলে অন্ধকার হলের এক কোনায় পাশাপাশি বসে রোম্যান্স করতে পারবেন। বরখাওয়ালাদের অর্জিত অর্থ থেকে মাঝেমধ্যে একটা অংশ হলের দেখভালে নিয়জিত কর্মচারী ও আশেপাশে থাকা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা পায়, যার ফলে এসব ন্যাক্কারজনক কর্মকান্ড এখনো চলমান। পাবলিক প্লেস রূপ নিয়েছে পতিতাবৃত্তিতে।
৮ হলের মধ্যে নেপচুন সিনেমাহলের পরিবেশ কিছুটা মন্দের ভালো। এখানে ইংরেজী ছবি প্রদর্শন করা হয়, দুই টিকেটে এক ছবি নামে। একটি থাকে এ্যাডভেঞ্চারধর্মৗ এ্যাকশন ছবি, অন্যটি থাকে ইরোটিক রোম্যান্সের রোম্যান্টিক ছবি। মাঝেমধ্যে দুই/একটা কাটপিস ঢুকিয়ে দিলেই হয়ে গেলো লুঙ্গিপরিহিত বিশেষ পাবলিকদের জন্য পরিপূর্ণ বিনোদন।
সিনেমাহলগুলোর বর্তমান বেহাল দশার জন্য আমার চোখে এর প্রধান কারণ পাঁচটি-
১. নব্বই দশকের এফডিসি/চলচ্চিত্র সমিতির পরিকল্পনাহীন কর্মকান্ড।
২. অসৎ প্রযোজকদের সাথে মিলেমিশে থাকা।
৩. সাময়িক লাভের খাতিয়ে সিনেমা ব্যবসার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ফেলা।
৪. যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সামনে না এগিয়ে উল্টোপথে হাটা ধরা।
৫. সঠিক সময়ে সরকারি সহযোগিতা না পাওয়া।