
তাণ্ডব: কমার্শিয়াল ঘরানার এক অন্যরকম সিনেমা
[স্পয়লার নেই]
একটি সাধারণ দিনের অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বদলে যায় পুরো দেশের পরিস্থিতি—দেশের নামকরা টেলিভিশন চ্যানেল “চ্যানেল বাংলা”-র অফিসে আচমকা হামলা করে বসে একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী। মুহূর্তেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে অস্থিরতা, আতঙ্ক এবং নানা প্রশ্ন। কেন এই হামলা? তাদের উদ্দেশ্য কী?—এসবের জবাব মিলবে পরিচালক রায়হান রাফী পরিচালিত এবং মেগাস্টার শাকিব খান, জয়া আহসান, সাবিলা নূর অভিনীত সিনেমা ‘তাণ্ডব’-এ।

শুরুতেই এই সিনেমার গল্পের প্রশংসা করতে হয়। আমার মনে আছে-রায়হান রাফী গতবছরের শেষদিকে টিভি ইন্টারভিউগুলোতে সিরিয়াস কিছু টপিক নিয়ে কাজ করার ব্যাপারটা জানিয়েছিলেন। সেই টপিকগুলো নিয়ে ‘আমলনামা’ জাতীয় কাজ হতে পারে বলে আমার ধারণা ছিলো। তবে এমন সিরিয়াস সব টপিক যে কমার্শিয়াল সিনেমায় দেখবো-সেটা ভাবিনি। ‘তাণ্ডব’ অবশ্যই কমার্শিয়াল ঘরানার এক অন্যরকম সিনেমা, যেখানে গল্প নিয়ে ভাবনার জায়গা আছে প্রচুর। গল্পের শুরুতেই শাকিব খানের এন্ট্রি সিনটা বেশ স্টাইলিশ লেগেছে। এরপর গল্প যতোই এগিয়েছে, ততোই টেনশন বিল্ড করে এগিয়েছে। এরকম টানটান স্ক্রিনপ্লে শুরুতেই মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। তবে স্টোরি বিল্ড আপ করতে অনেকটা সময় দেওয়া হয়েছে প্রথমার্ধে। এই ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার মনোযোগে ব্যাঘাতও ঘটাচ্ছিলো বটে। যাইহোক, গল্প আবারও ছন্দে ফেরে বিরতির আগের একটা দারুণ ফাইট সিনের মাধ্যমে। এরপর, সেকেন্ড হাফে গিয়ে গল্প আরও বেশি এনগেজিং হয়ে ওঠে। সেকেন্ড হাফের একটা লম্বা অ্যাকশন সিক্যুয়েন্স এই সিনেমায় প্রাণ সঞ্চার করেছে। এরকম হ্যান্ড টু হ্যান্ড ফাইট সিক্যুয়েন্স বাংলা সিনেমায় খুবই রেয়ার বলা যায়। এই অংশে এসে বুঝতে পারলাম যে কেন ‘তাণ্ডব’-এর সংশোধিত ভার্সন ছাড়পত্র পেয়েছে। এরপর সিনেমায় পরপর আসা টুইস্ট, ক্যামিও’স-এক আলাদাই আবহ তৈরি করেছে সিনেমাহলে। পিওর ম্যাসি ব্যাপার-স্যাপার। অতঃপর ক্লাইমেক্সে দর্শকদের অপেক্ষার পারদ অনেকটা উস্কে দিয়ে হলছাড়া করলো ‘তাণ্ডব’।
সিনেমায় শাকিব খানের কাজ দুর্দান্ত। পুরো সিনেমাজুড়ে শাকিব খানকে বেশ কয়েকটা লুকে দেখতে পাওয়া গেছে। শাকিব খান জাস্ট ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন প্রতিটি চরিত্রে, প্রতিটি লুকে। চরিত্রের প্রয়োজনে এই বান্দা নিজেকে যতোটা পারা যায় ভেঙেছেন, যেটা হাইলি এপ্রিশিয়েটিভ ওয়ার্ক। সিনেমায় একটা লম্বা সময় শাকিব খান গলার টোন পরিবর্তন করে কথা বলেছেন-যা কিনা খুবই কষ্টকর একটা কাজ। শাকিব খানের এমন ডেডিকেশনকে আবারও এপ্রিশিয়েট করছি। অ্যাকশন সিক্যুয়েন্সগুলো শাকিব খান দারুণভাবে পুল অফ করেছেন। পাশাপাশি পর্দায় শাকিব খানের সাথে সাবিলা নূরের কেমিস্ট্রি দেখতেও মন্দ লাগেনি। দুজনকে বেশ ভালোই লেগেছে। রিপোর্টার চরিত্রে জয়া আহসানের কাজও বেশ ভালো ছিল। দীর্ঘ ৯ বছর পর কমার্শিয়াল সিনেমায় ফিরলেন তিনি। বুঝতে বাকি নেই যে কেন তিনি ‘তাণ্ডব’কে হ্যাঁ বলেছেন। গল্পের মূল নারী চরিত্রটিই জয়া আহসানের এবং তিনি বেশ ভালোভাবেই তার চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাশাপাশি আফজাল হোসেন গল্পে চরিত্র অনুযায়ী যথেষ্ট স্পেস পেয়েছেন এবং বেশ ভালো করেছেন। এফ এস নাঈম আরেকটু স্পেস পেলে মন্দ হতোনা, তবে যেটুকু সময় স্ক্রিনে ছিলেন-ভালো করেছেন। বাকি শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত, রোজী সিদ্দিকী, ফজলুর রহমান বাবু, সুমন আনোয়ার, শিবা শানু চরিত্র অনুযায়ী হতাশ করেননি। আর সিনেমায় যে দুজন ক্যামিও দিয়েছেন, তাদের কাজ আসলেই বেশ ভালো ছিল। সোবহান এবং মাসুদ-দুটি চরিত্রই সিনেমাহলকে স্টেডিয়ামে রূপান্তর করেছে।

সিনেমায় মোট ৫টি গান রয়েছে। টাইটেল ট্র্যাক এবং র্যাপ সং-গুলো গল্পে আলাদা ভাইব ক্রিয়েট করেছে। অরিন্দম ভট্টাচার্যের কন্ঠে ‘তোমাকে’ এই অ্যালবামের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর গান। ‘লিচুর বাগানে’ নিয়ে সমালোচনার জায়গা রয়েছে। তবে গান হিসেবে আমার কাছে মন্দ লাগেনি। আরাফাত মহসীন নিধির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যথেষ্ট ইফেক্টিভ ছিল। টু গুড। তাহসিন রহমানের সিনেমাটোগ্রাফি বেশ ভালো ছিল। কালার গ্রেডিং এবং সেট ডিজাইন যুতসই হয়েছে।
এবার আসি এই সিনেমার নেগেটিভ দিকগুলোতে। সিনেমার প্রথমার্ধ নিয়ে উপরেও বলেছি। প্রথমার্ধে স্টোরি বিল্ড আপে অনেকটা সময় খরচ করা হয়েছে, যা কিনা কিছুটা বোর করেছে। শাকিব খান এবং সাবিলা নূরের কেমিস্ট্রি পর্দায় দেখতে ভালো লাগলেও সাবিলা নূর সিনেমায় নিজের এক্সট্রা কোনো ভ্যালু এড করতে পারেননি। ওনাকে মূল চরিত্র বলা হলেও সিনেমা দেখার সময় ওনার চরিত্রটাই ক্যামিও রোল মনে হয়েছে। এদিক থেকে বরং জয়া আহসানের চরিত্রটিকে লিড রোল বলা যায়। আর এতো কম সময়ে ওনার অভিনয় নিয়ে আলাদা করে বলার মতো কিছুই যেনো ফুটে ওঠেনি। প্রীতম-জেফারের “লিচুর বাগানে” সিনেমায় একপ্রকার ফোর্সফুলি ঢোকানো হয়েছে। একদমই খাপছাড়া লেগেছে এই অংশটুকু।

সবমিলিয়ে এই ছিল আমার দৃষ্টিতে ‘তাণ্ডব’। এই ঈদে পাওয়ার প্যাকড কিছু দেখতে চাইলে ‘তাণ্ডব’ দেখুন আপনার নিকটস্থ প্রেক্ষাগৃহে।