
‘তাণ্ডব’ শুধু থ্রিলারই নয়, উঠে এসেছে বাস্তব ও সংবেদনশীল প্রসঙ্গ
[স্পয়লার নেই]
হঠাৎ করে একদিন দেশের একটি বড় টেলিভিশন চ্যানেলে হামলা চালায় মুখোশধারী একটি দল। শুরু হয় আতঙ্ক, তৈরি হয় হাজারো প্রশ্ন! কেন এই হামলা? কারা তারা? আসল উদ্দেশ্য কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই দর্শককে টেনে নিয়ে যায় তাণ্ডব, যেখানে গল্পটা শুধু থ্রিলারে সীমাবদ্ধ নয় বরং উঠে আসে সমাজের অন্ধকার দিক, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, গুম আর আয়না ঘরের মতো বাস্তব ও সংবেদনশীল প্রসঙ্গ।

পরিচালক রায়হান রাফী এখানে শুধু একটা সিনেমা বানাননি বরং বাংলা সিনেমায় সাহসী এক ভাষা যোগ করেছেন। শাকিব খান, জয়া আহসান এবং সাবিলা নূরের মতো তারকাদের নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্র একদিকে যেমন কমার্শিয়াল ফ্লেভার দেয়, তেমনি অন্যদিকে অনেক গভীর চিন্তার জায়গা তৈরি করে দেয়।
শাকিব খান তার অভিনয় জীবনের অন্যতম ভিন্ন ও পরিণত চরিত্রে অভিনয় করেছেন এখানে। গলার স্বরে পরিবর্তন, শারীরিক অভিনয়, মানসিক রূপান্তরের যে যাত্রা তার চরিত্রে দেখা যায়; তা সত্যিই প্রশংসনীয়। একজন সাধারণ যুবক থেকে ধীরে ধীরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া দর্শককে টেনে রাখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
জয়া আহসান তার দৃঢ় ও মেধাবী চরিত্র দিয়ে নতুন করে প্রমাণ করেছেন কেন তিনি দেশের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী। দীর্ঘদিন পর একটি কমার্শিয়াল সিনেমায় ফিরে তিনি ঠিক যতটুকু থাকা দরকার, ঠিক ততটাই দারুণভাবে দিয়েছেন।
সাবিলা নূর চরিত্রে চমক থাকলেও তার উপস্থিতি কম। তবে সাবিলাকে দেখতে দারুণ লেগেছে। তার উপস্থিতি গল্পে একটি সফট ব্যালান্স এনেছে। শাকিবের সাথে যতটুকু সময় তার রসায়ন দেখানো হয়েছে, তাতে তাদের রসায়ন পারফেক্ট লেগেছে।
সাপোর্টিং কাস্ট হিসেবে আফজাল হোসেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, গাজী রাকায়েত, রোজী সিদ্দিক, শিবা শানু সহ মোটামুটি সবার শক্তিশালী উপস্থিতি ছিলো। আর সবচেয়ে বড় চমক এসেছে ক্যামিও চরিত্রগুলোতে, যা হলে দর্শকদের বাঁধভাঙা উল্লাসে মাতিয়ে তোলেছে সিনেমাহলে।
সিনেমাটোগ্রাফার তাহসিন রহমান এই সিনেমার অন্যতম নায়ক। বিশেষ করে ওয়ান টেক অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলোতে তার ক্যামেরা হয়ে উঠেছে গল্প বলার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। পাশাপাশি আরাফাত মহসীন নিধির ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক পুরো সিনেমাকে করে তুলেছে অন্যবদ্য ও আবেগময়। প্রতিটি চরিত্রের জন্য আলাদা টোন সেট করা নিধির কাজকে আলাদা করে মনে রাখতে হয়। আরাফাত মহসীন নিধি আমার মতে বাংলাদেশের অনিরুদ্ধ! লোকটা বাংলা চলচ্চিত্রের আবহ সঙ্গীতকে অন্য লেভেলে নিয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।

ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলো খুব দারুণ লেগেছে। তবে ভালোলাগার বিষয় এই ছবিতে ওয়ান টেকের অ্যাকশন দৃশ্য আছে, যা বাংলা ছবিতে এক প্রকার বিরল। অ্যাকশন কোরিওগ্রাফি দুর্দান্ত আমার মতে।
ছবিতে অন্যান্য কমার্শিয়াল ছবির মতো অহেতুক গান নেই। গানগুলোর মধ্যে ‘টাইটেল ট্র্যাক’ ও ‘তোমাকে’ গানটি আলাদা করে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। ‘লিচুর বাগান’ গানটি আমার পার্সোনালি ফেভারিট, তবে এটার প্লেসমেন্ট আরেকটু বেটার দরকার ছিলো। লিচু’র বাগানে শাকিব এবং সাবিলার রসায়ন খুব সুন্দর লেগেছে।
শুরুটা কিছুটা স্লো-ভাবে স্টার্টিং হলেও এটি গল্প বিল্ডআপের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। বিরতির পর থেকে গল্প নিয়ে নেয় একেবারে ভিন্ন গতি! ঘটনার মোড় ঘুরে যায়, চরিত্রগুলো একে একে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করে এবং শেষ ৩০ মিনিটে আসে একের পর এক চমক। সেসব মুহূর্ত বাংলা সিনেমায় বিরল। বলা যায় টুইস্ট আর ঐতিহাসিক সব মুহুর্তের মেলবন্ধন হয়েছে শেষের দিকটায়।
ছবির নেগেটিভ বলতে গেলে, সাবিলা নূরের চরিত্রে আরও গভীরতা আনা যেত। কিছু চরিত্র (যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বা আইজিপি) আরও বাস্তবভিত্তিক বা গভীরভাবে তাদের চরিত্রটা চাইলে দেখানো যেত। আর প্রথমার্ধে কিছুটা বেশি সময় লাগছে মোমেন্টাম তৈরি করতে।
সব মিলিয়ে ‘তাণ্ডব’ শুধু আরেকটি ঈদের সিনেমা নয়, এটি বাংলা সিনেমার গায়ে লাগানো পুরনো গণ্ডি ভাঙার এক সাহসী প্রচেষ্টা। নতুন ধাঁচের গল্প, দারুণ পারফরম্যান্স, টেকনিক্যাল পারফেকশন ও স্টাইলিশ উপস্থাপনা মিলে এটি এক পাওয়ার-প্যাকড এক্সপেরিয়েন্স। শাকিব খান যে নিজেকে আবার নতুন করে নির্মাণ করছেন, সেই যাত্রার বড় এক প্রমাণ এই সিনেমা। আমি তো চোখবন্ধ করে এটাও বলতে পারি, রায়হান রাফী এবং শাকিবের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘তাণ্ডব’!