তারেক মাসুদ সমগ্র
‘আমাদের জীবন হয়তো চলে যাবে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ তৈরি করতে করতে’ – তারেক মাসুদ
তারেক মাসুদ ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম মেকিং-এ একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে। তাঁকে আদর্শ মেনে কত যে নাম না জানা তরুণরা চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখে বড় হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে তা বলাই বাহুল্য।
তারেক মাসুদের জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬, ফরিদপুরের ভাঙায়। তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল মাদ্রাসায়। অনেক বিধিনিষেধের মধ্যে তাঁকে থাকতে হয়েছিল সেখানে। মাদ্রাসার উল্টোদিকে পার্ক ছিল সেখানে ছেলেরা খেলত আর তিনি তাকিয়ে শুধু দেখতেন। সাহস করে খেলতে গেলে শাস্তি পেতে হত। ১৯৭১ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করেন। ম্যাট্রিক পাশ করেন ফরিদপুর থেকেই আর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক করেন, স্নাতকোত্তর শেষ করেননি।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। বাংলাদেশে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে তিনি পথিকৃৎ।
তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ :
সোনার বেড়ি (১৯৮৫)
আদম সুরত (১৯৮৯)
সে (১৯৯৩)
ইউনিসন (১৯৯৪)
মুক্তির গান (১৯৯৬)
ভয়েসেস অফ চিলড্রেন (১৯৯৭)
শিশুকণ্ঠ (১৯৯৭)
ইন দ্য নেম অফ সেফটি (১৯৯৮)
নিরাপত্তার নামে (১৯৯৯)
মুক্তির কথা (১৯৯৯)
নারীর কথা (২০০০)
অ্যা কাইন্ড অফ চাইল্ডহুড (২০০২)
মাটির ময়না (২০০২)
অন্তর্যাত্রা (২০০৬)
কানসাটের পথে (২০০৮)
নরসুন্দর (২০০৯)
রানওয়ে (২০১০)
‘আদম সুরত’ বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান-কে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র। এটি একটি অসাধারণ কাজ। এস এম সুলতানের নিজের বয়ানে তাঁর আদর্শ, মানুষের সাথে মেশা, দেশীয় সংস্কৃতিকে বৈশ্বিকভাবে তুলে ধরার গল্প বর্ণিত হয়েছে। ‘সে’ একটি শর্টফিল্ম যেখানে একজন আগন্তুকের হঠাৎ উপস্থিতি ঘটে একটি পরিবারে এবং একটি সত্য জানা যায়। ‘ইউনিসন’ অ্যানিমেশনের মাধ্যমে নির্মিত ভিডিওচিত্র। ‘মুক্তির গান’ মুক্তিযুদ্ধের ভ্রাম্যমাণ গানের দলকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র যারা অনেক ঘটনার সাক্ষী ছিল। মার্কিন নির্মাতা লিয়ার লেভিনের ক্যামেরা ওয়ার্কের সাথে অন্যান্য ফুটেজের সমন্বয়ে নির্মিত। ‘ভয়েসেস অফ চিলড্রেন’ ছিন্নমূল, খেটে খাওয়া, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র। ‘মুক্তির কথা’ মূলত ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্রের বিভিন্ন গল্প, প্রদর্শনীর বাস্তবতা, মুক্তিযুদ্ধের উপর গণমানুষের সাক্ষাৎকার এসবের সম্মিলিত একটি প্রামাণ্যচিত্র। ‘নারীর কথা’ মুক্তিযুদ্ধের সাহসী নারী, বীরাঙ্গনা, বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী যারা তাদের সাক্ষাৎকার ও অভিজ্ঞতার উপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র। ‘অ্যা কাইন্ড অফ চাইল্ডহুড’ ছিন্নমূল, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শৈশবের, বেড়ে ওঠার মর্মস্পর্শী গল্পের প্রামাণ্য চিত্র। ‘মাটির ময়না’ তারেক মাসুদের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। তাঁর নিজের মাদ্রাসা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে নির্মিত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ছবিটি। দেশের বাইরে অনেকগুলো উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হবার পর বহির্বিশ্বের মিডিয়ার চাপে বাংলাদেশে ছবিটি মুক্তি দেয়া হয়। প্রথমদিকে প্রায় চার সপ্তাহ চলে রেকর্ড গড়ে ছবিটি। কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেয়া প্রথম বাংলাদেশী ছবি এটি যা ‘ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট’ জেতে এছাড়া অস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়। ‘অন্তর্যাত্রা’ তাঁর দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। একটি পরিবারের বিদেশ গমন এবং বিশেষ কারণে আবার দেশে ফেরার গল্প এটি। ‘কানসাটের পথে’ নারায়ণগঞ্জের কানসাটের উপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র। ‘নরসুন্দর’ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি শর্টফিল্ম। ‘রানওয়ে’ বহুল প্রশংসিত ছবি তারেক মাসুদের। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ছবিটি নির্মিত হয়েছে। ‘কাগজের ফুল’ নামে আরেকটি ছবির কাজ শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু শেষ করতে পারেননি।
তারেক মাসুদ পুরস্কার পান অনেক :
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার – মুক্তির গান (১৯৯৬), মাটির ময়না (২০০৩)
ফিল্ম সাউথ এশিয়া – মুক্তির গান (১৯৯৭)
কান ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট – মাটির ময়না (২০০২)
থ্রি কন্টিনেন্টস ফেস্টিভাল – মুক্তির কথা (২০০২)
বাচসাস পুরস্কার – মাটির ময়না (২০০৩)
কেরালা চলচ্চিত্র উৎসব – মাটির ময়না (২০০৬)
ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল – অন্তর্যাত্রা (২০০৬)
মেরিল প্রথম আলো – রানওয়ে (২০১০)
তারেক মাসুদ বিয়ে করেন ক্যাথরিন মাসুদ-কে। ক্যাথরিন মার্কিন নাগরিক। দুজনে মিলে নির্মাণে যুক্ত ছিলেন, তারকা নির্মাতা দম্পতি যাকে বলে। দুজনে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানও খোলেন ‘অডিও ভিশন’ নামে। তারেক মাসুদ ‘বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরাম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ‘কাগজের ফুল’ ছবির লোকেশন দেখতে গিয়ে মানিকগঞ্জের ঘিওর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তারেক মাসুদের। তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীরও তাঁর সাথেই মারা যান। বিপরীত দিক থেকে আসা মাইক্রোবাসের সরাসরি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তাঁদের মৃত্যু ঘটে।
মৃত্যুর পর তাঁর কাজ নিয়ে ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয় যার ভূমিকা লেখেন ক্যাথরিন মাসুদ। প্রসূন রহমানের পরিচালনায় ‘ফেরা’ নামে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে তারেক মাসুদ দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু ভবিষ্যৎ বাণী করেন যার অনেককিছুই আজকে সত্য হয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের যে স্কুলিং তা যদি না থাকে তাহলে অনেকেই এটিকে সহজভাবে গ্রহণ করবে বলেছেন তিনি এবং আজকে অনেকের কাছেই চলচ্চিত্র নির্মাণ সহজ কাজে পরিণত হয়েছে। সাধারণ সিনেমাহলের ভবিষ্যত নেই এবং মাল্টিপ্লেক্সেই এগিয়ে যাবার যে সম্ভাবনা তিনি বলেছিলেন আজকে সেটিও ফলেছে।
‘চলচ্চিত্র যদি দর্শন হয় তবে আমার প্রিয় দার্শনিক তারেক মাসুদ’ – জনৈক সমালোচক
জনৈক সমালোচকের এই উক্তির মধ্য দিয়েই একজন তারেক মাসুদ বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জনজীবনের সাথে মিশে সাংস্কৃতিক একটি পরিচয় তৈরি করেছিলেন নিজের কাজের মধ্যে। তিনি দূরদর্শী নির্মাতা ছিলেন। তাঁকে হারিয়ে দেশের চলচ্চিত্র নিঃস্ব হবার পথে অনেক বেশি এগিয়েছে।