Select Page

দর্শককে প্রত্যক্ষদর্শীতে পরিণত করে ‘শনিবার বিকেল’

দর্শককে প্রত্যক্ষদর্শীতে পরিণত করে ‘শনিবার বিকেল’

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী’র বহুল আলোচিত ‘শনিবার বিকেল’ দেখার পরই প্রথমেই মনে হয়েছে যেকোনো ছবি দেখার আগে তার রিভিউ বা প্রতিক্রিয়া পড়ে ফেললে তা এক ধরনের বায়াসনেস তৈরি করে। ফলত ছবিটা এক্সপেরিয়েন্স করার চাইতে নেগেটিভ পয়েন্টগুলো ফোকাস থাকে দর্শকের মনে। আমি আগে থেকে সচেতনভাবে তা এড়িয়ে যাওয়ায় পুরোপুরি উপভোগ করতে পেরেছি।

রিভিউ ঠিক না, আমি আমার ব্যক্তিগত অপিনিওয়ন শেয়ার করার চেষ্টা করছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, সরয়ার ফারুকীর গল্পটা যতটা না ইভেন্ট সেন্ট্রিক, তার চাইতে বেশি ব্যক্তি কেন্দ্রিক। কী হয়েছে, কার্যকারণ বা বাস্তব প্রতিক্রিয়ার চাইতে কুশীলবদের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ এই গল্পে অনেক সিগনিফিকেন্ট। ঠিক এই কারণেই ‘শনিবার বিকেল’ ডকুমেন্টারি না হয়ে সিনেমা হয়ে উঠে।

ঘটনার মাঝামাঝি অবস্থায় গল্পের শুরু। কিছু ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে যার ধারণা আমরা বিভিন্ন আলাপচারিতা, ফোন কল, এবং এক্সপ্রেশনে বুঝতে পারি। যে স্টাইলে গল্পটা এগিয়েছে, তাতে বাইরের দুনিয়ায় কী হচ্ছে তা দেখানো জরুরি মনে হয়নি। দর্শকও আসলে আপন মনেই ঢুকে যায় গল্পের ভেতর, এবং নিজেই পরিণত হয় প্রত্যক্ষদর্শীতে। শেষ পর্যন্ত সেই মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে পরিচালক। এর অন্যতম আরেকটা কারণ হতে পারে সিঙ্গেল শটে পুরো মুভিটা ডিল করা। পর্দায় কাট না থাকার কারণে দর্শক এক ধরনের আনডিভাইড টেনশনের মধ্যে থাকে, এবং অবচেতনভাবেই নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেয় ন্যারেটিভের সাথে।

এর আগে আমরা কোয়েন ব্রাদার্স, স্করসিস, ইনারিতুসহ আরও অনেক মায়েস্ত্রোর বিভিন্ন ছবিতে লং ওয়ান টেক শট দেখে থাকলেও বাংলা ছবিতে এই এক্সপেরিমেন্ট সম্ভবত প্রথম। আমার খুবই আগ্রহ ছিলো এই নিয়ে এবং আমি সিনেমাটোগ্রাফার আজিজ জাম্বাকিয়েভসহ টেকনিশিয়ান টিমের অসাধারন নৈপুণ্য দেখতে পাই পুরো ট্রিটমেন্টে।

অভিনয়ের ব্যপারে বলতে গেলে প্রত্যেকেই আশাতীত পারফর্ম করেছে। ন্যাচারাল অভিনয় বের করে আনার ব্যপারটা সবসময়েই ফারুকীর স্ট্রেন্থ। জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ইরেশ জাকের, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ইন্তেখাব দিনার, মামুনুর রশীদ প্রত্যেকে যার যার জায়গায় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। স্পেশালি মামুনুর রশীদ সাহেবের সাথে দিনারের কনভার্সেশন আমার কাছে পুরো ছবির চুম্বক অংশ। সিগারেটের ছাই পুড়ে পুড়ে ঝরে যাওয়ার নিস্তব্ধ মন্টাজ । ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও দিনারকে করা মামুনুর রশিদের প্রশ্ন মনে দাগ কেটে যায়, আমাকে ভাবায়। এখানেই সিনেমার সার্থকতা।

ছোট ছোট কিছু অ্যাকটিং মোমেন্ট সিনেমা থেকে দর্শকের মনে ট্রান্সেডেড হয়ার পেছনে বড় ভুমিকা রেখেছে। যেমন একটা যায়গায় দেখি গাউসুল আলম শাওন আঙুল খুঁটছে অবচেতন মনে, ঠিক অস্বস্তিকর অবস্থায় আমরা যা করি। কিংবা গুলির সাউন্ডে তিশার অভিব্যক্তি, কান্নার মাঝে দমকে দমকে ওঠা, জাহিদ হাসানের সততা, অন্যদিকে বাঁচার এবং বাঁচানোর আকুতি সবই ফুটে উঠেছে পারফেক্ট এক্সপ্রেশনে।

ধর্মকে ভালো-খারাপের বাইনারিতে না ধরার প্রবণতা ফারুকীর ‘টেলিভিশন’ সিনেমায় আমরা আগেও দেখেছি। ইসলাম’কে কি তার ফলোয়ার বা প্র‍্যাক্টিশনার্সদের অ্যাক্টিভিটি দিয়ে ডিফাইন করা যায়? তাহলে একই ধর্মের একজন মানুষ কেমন করে জীবন নেয়, আর একজন জীবন বাঁচায়? আমরা কি এক্সট্রিমিস্টদের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে ইসলামকে রিজনিং করবো নাকি সাধারণ মানুষের পার্সপেক্টিভ থেকে? আমাদের নৈতিকতার ভিত্তি ও উদ্দেশ্য, আমাদের ড্রাইভ করে কি শুধুই ধর্ম নাকি মানবিকতা, সম্পর্ক? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেয়ার দায়িত্ব দর্শকদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন পরিচালক।

আমি সরয়ার ফারুকীর মায়েস্ত্রো হবার জার্নিটা দেখতে পাই ‘শনিবার বিকাল’-এ। এর আগেও সিঙ্গেল লোকেশনে আমরা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখেছি, ধর্মীয় অনুভুতির গল্প দেখেছি ‘টেলিভিশন’-এ, কিন্তু ‘শনিবার বিকেল’-এ এসে তার সব এক্সপেরিমেন্ট পূর্ণতা পায়। এই ছবি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রাখবে। এই সিনেমা আজকে বাংলাদেশের হলে চালানো যাচ্ছে না, এর চেয়ে দুখজনক ঘটনা আর হতে পারে না। ১৯৭৭ সালের যেই নীতিমালার ওপরে ভর করে আজকের সেন্সর বোর্ড, তা কি আদৌ রেলেভেন্ট? এখনো কি সময় হয় নাই এই গ্লোবাল কালচারাল এক্সচেঞ্জের স্বর্ণ যুগে এসে এই প্রশ্ন করা?

সাউন্ড, আর্ট বা অন্যান্য টেকনিক্যাল ডিটেইলসে গেলাম না, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে শনিবার বিকেল। আমার অনুরোধ আপনারা ছবিটি দেখুন, ভালো-মন্দ আলাপ করুন। আলাপ তৈরি হয়ার জন্য জন্য আগে ছবি দেখা জরুরি।

বি:দ্র: ‘ফারাজ’ দেখার পর আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম কোন এজেন্ডায় কী ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে, এবং আমি একদমই ভালো বোধ করি নাই। ধন্যবাদ ফারুকী ভাইকে সেই অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ায়।


Leave a reply