দর্শকের সিনেমার ক্ষুধা দেখিয়ে দিল ‘প্রিয়তমা’
স্পয়লার: আলোচনার সুবিধার্থে গল্প সম্পর্কে কিছু তথ্য দেয়া হয়েছে। যারা সিনেমাটি দেখেননি তারা এড়িয়ে যেতে পারেন।
দুই ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের ‘প্রিয়তমা’ একটি সিনেমা নাকি দুটি? প্রশ্নটি হাস্যকর শোনালেও যারা দেখেছেন তাদের কাছে কথাটি হাস্যকর লাগবে না। কারণ প্রথম অংশের গল্পের সঙ্গে দ্বিতীয় অংশের কোনো যোগসূত্র নেই। একবারেই দুর্বল স্ক্রিপ্ট এবং গতানুগতিক ঘরনার একটা মিনমিনে প্রেমের গল্প।
ব্যতিক্রম হচ্ছে ‘প্রিয়তমা’ই শাকিব খানের নিজেকে ভেঙে গড়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। যদিও সেই চেষ্টাই তাকে সফলও বলা যাবে না। অভিনয়ে শাকিবকে আমার বরাবরই রোবটের মতো মনে হয়, ‘প্রিয়তমা’য়ও তাই মনে হয়েছে। ইধিকার সঙ্গে তার কেমিস্ট্রি জমেছে এরকমটা একেবারেই মনে হয়নি। দুজনের বয়সের বড় ব্যবধান কেমিস্ট্রি না জমার কারণ হতে পারে। শাকিবের বড় চুলের লুক কেনোভাবেই তার সঙ্গে মানাইনি। চরিত্রের সঙ্গে এ লুক একেবারেই অনাহুত মনে হয়েছে।
তবে শাকিবকে তারচেয়ে কম মানিয়েছে এত বয়সে এসে এসব টিনেজার বয়েসী প্রেমের গল্পে। বয়স বিবেচনায় শাকিবকে এসব কম বয়েসী আবেগের প্রেম পিরীতির গল্পে অভিনয় এবার বাদ দেয়া উচিত।
‘প্রিয়তমা’য় সবচেয়ে জগাখিচুরি করেছে ভাষা। শাকিব খান কখনো পুরান ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলে আবার কখনো বলে একেবারে শুদ্ধ ভাষায়। এরচেয়ে বড় হাস্যকর হয়েছে চরিত্রের মুখে চাটগাঁইয়া ভাষায়। এই জায়গায় নির্মাতারা ইদানিং খুব হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে চলেছে। শহীদুজ্জামান সেলিম চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে গিয়ে যে অদ্ভুত একটা ভাষা বলেছে, ওটা অন্যকোনো অঞ্চলের ভাষা ছিল কি না জানি না, তবে চট্টগ্রামের মানুষ হিসেবে বলতে পারি ওটা চট্টগ্রামের ভাষা ছিল না। তারচেয়ে বড় কথা চেয়ারম্যানের চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ কখনো চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে, আবার কখনো অন্য এক আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। কিন্তু তার মেয়ে ইতি চরিত্রে ইধিকা বলে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন একটা ভাষায়।
চট্টগ্রামের একই পরিবারে একেকজন সদস্য একেক ভাষায় কথা বলাটা নির্মাতার মারাত্মক আনাড়িপনা প্রকাশ পেয়েছে। গল্পের পটভূমি যে অঞ্চলেরই হোক, ভাষা যদি চলিতরীতি বা শুদ্ধ বাংলা দেয় তাহলে কোনো ভুল নেই। কিন্তু চরিত্রের মুখে আঞ্চলিক ভাষা দিলে ভাষাটা পুরোপুরি রপ্ত করতে হয়। ভাষাটির নিজস্ব শব্দ, একসেন্ট, এক্সপ্রেশনসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলোয় সতর্ক থাকতে হয়। চট্টগ্রামের ভাষায় বা চট্টগ্রামের পটভূমিতে ইদানিং নাটক, ওয়েভ সিরিজ, সিনেমা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই অঞ্চলের ভাষাভাষী চরিত্রের ডায়ালগ ডেলিভারিতে নির্মাতাদের বড় অদক্ষতা ফুটে উঠেছে।
দুর্দান্ত অভিনয় করেছে ইধিকা পল। মেয়েটি চরিত্রের ভেতর ভালোভাবে ঢুকতে পেরেছে। তার দুরন্তপনায়, কথায়, আচরণে ছিল একেবারেই বাস্তবিক গ্রাম্য কিশোরীর সরলতা। চরিত্রে চমৎকার সাবলীল মনে হয়েছে তাকে। একেবারে সহজসরল গ্রাম্য কিশোরীর প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে ইধিকা। কিন্তু পড়াশোনায় অমনোযোগী উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী গ্রাম্য কিশোরী ইতির মুখে নির্মাতা ভুল ইংরেজি মাধ্যমে যে একটা ফানি ব্যাপার করতে চেয়েছিল সেটাই পুরোপুরি মার খেয়েছে। তার ভুল উচ্চারণের ইংরেজিকে ন্যাচারাল মনে হয়নি। মনে হয়েছে আরোপিত।
দ্বিতীয় অংশে ইতির চরিত্রে যে বিরাট টার্ন মানে গ্রামের কিশোরী থেকে হঠাৎ বদলে যাওয়া ইতিকেও বেশ পরিণত এবং সাবলীল মনে হয়েছে। বেমানান ঠেকেনি। এককথায় ইতি চরিত্রে ইধিকাকেই ‘প্রিয়তমা’ সিনেমায় সবচেয়ে সাবলীল লেগেছে।
শেষদৃশ্যে ইতি মারা গেলে কাফনে মোড়ানো তার লাশ মুখ খোলা অবস্থায় বাসার সামনে রাখা হয়েছে। মুসলমান ঘরের মেয়ে মারা গেলে তাকে যে বেগানা পুরুষের সামনে আনা হয় না; পরিচালক হিমেল আশরাফ বোধহয় এটা জানতেন না। এ দৃশ্যে দেখা গেছে শত শত মানুষ জড়ো হয়ে মৃত ইতিকে দেখছে। পুরুষ মৃতের লাশ যেমন দাফনের আগে প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয় একেবারে সেই রকম। যেহেতু সেই দৃশ্যে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। তাই দৃশ্যটা করতে পারতো এরকম, শাকিব আসার পর বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সাথে ঝড়ো বাতাসও। বাতাসে ইধিকার কাপনের মুখের অংশ সরে গেছে। তাহলে ধর্মীয় বিধিনিষেধের বিষয়ে একটা যুক্তি দাঁড় করানো যেতো। বিষয়টি সুক্ষ্ম হলেও ধর্মীয় বিবেচনায় বড় ভুল। এই ভুলগুলো চিত্রনাট্যের অনভিজ্ঞতা, অদক্ষতা প্রমাণ করে।
অ্যাকশন দৃশ্য বরাবরই হতাশাব্যাঞ্জক। আমাদের দেশের সিনেমার অ্যাকশন ডিরেক্টররা সাবজেক্টিভ বিষয়ে নিয়ে পড়াশোনা তো দূরে থাক, বোধহয় এরা খুব বেশি সিনেমাও দেখে না। শুধু অ্যাকশন দিয়ে কেরল ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রি আজ সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত হচ্ছে। আর আমাদের দেশের সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যের চেয়ে জব্বরের বলি খেলাও বোধহয় আরো বেশি উপভোগ্য।
শুরুতে কোরবানির গরুর হাট ইজারা সংক্রান্ত জটিলতায় শাকিব এসে ধমাধাম মেরে টেরে গুন্ডাদের সাফ করে দিলো। এরপর ধুম করে শুরু হলো একটা কোরবানির গান। ‘কবুল কর মোর কোরবানি’! গল্পে গানের আগে বা পরের অংশের সাথে গানের কোনো সামঞ্জস্য নাই। কোরবানির হাটের সেই গুন্ডাগুলোরও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি। শুধু কোরবানির ইদের সিনেমায় একটা কোরবানি কোরবানি ফ্লেভার দেয়ার জন্য কোরবানির হাট নিয়ে এই অ্যাকশন দৃশ্যটি আর গানটি হাস্যকরভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে।
গল্পে নতুনত্ব খুব বেশি নাই। সাদামাটা গল্প, বহুল প্রচলিত প্লট, শুধু মেকিং কিছুটা ভালো হয়েছে বলে সিনেমাটি প্রশংসিত হচ্ছে। তদুপরি সিনেমাটি দেখে যে কথাটি আমাকে খুব বেশি ভাবাচ্ছে তা হলো, ‘প্রিয়তমা’ আহামরি কোনো সিনেমা নয়, তারপরও আমাদের সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের কী ভূয়সী প্রশংসা, কী বাঁধভাঙা উল্লাস এই সিনেমা নিয়ে। এত স্বল্প চাহিদা যে দেশের দর্শকদের সে দেশের সিনেমা শিল্পের কলাকুশলী এবং শিল্পীরা দর্শকদের এই সামান্য চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারে না।
গতকাল সিনেপ্লেক্সে প্রিয়তমা দেখতে গিয়ে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে মনে হলো, এত অসামঞ্জস্য এই ‘প্রিয়তমা’ তারপরও মুক্তির বিশ দিন পরেও সিনেমা হলে দর্শক উপচে পড়ছে, সবাই তৃপ্তি নিয়ে বের হচ্ছে, প্রশংসায় ভাসাচ্ছে। অর্থাৎ ভালো সিনেমার অভাবে যেমন মানুষ হলবিমুখ হয়েছে, ভালো সিনেমা হলে মানুষ আবার হলমুখী হবে। ‘প্রিয়তমা’ আমাদের আর কিছু দিক না দিক এই বার্তাটুকু খুব জোরালোভাবেই দিয়েছে।
রেটিং: ৫/১০