Select Page

‘দহন’-এর সাধারণ যুবক থেকে বহুরূপী ভিলেন

‘দহন’-এর সাধারণ যুবক থেকে বহুরূপী ভিলেন

‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’ নাটকের দৃশ্য

আশির দশকের যারা নিয়মিত টিভি দর্শক… তাদের অবশ্যই মনে আছে ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নামের একটি জনপ্রিয় নাটকের কথা? সেলিম আল দীনের রচনায় ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় নাটকটিতে হ‌ুমায়ূন ফরীদিকে দেখা যায় সেরাজ তালুকদার নামে ভয়ংকর এক মন্দ চরিত্রে।

‘আরে আমি তো জমি কিনি না, পানি কিনি, পানি’, ‘দুধ দিয়া খাইবা না পানি দিয়া খাইবা বাজান’ নাটকের এই ডায়ালগটি সে সময় তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল, এটা সম্ভবত ৮৩ সালের কথা। এরপরই সেই বিখ্যাত চরিত্র ‘কান কাটা রমজান’রূপে আসেন শহীদুল্লাহ কায়সারের রচনায় আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় ‘সংশপ্তক’ (১৯৮৭) ধারাবাহিকে।

নাটকের সেই ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রে ফরীদির অনবদ্য অভিনয় সময়ের চাহিদা মিটিয়ে যুগান্তকারী হয়ে আছে সব শ্রেণির দর্শকদের কাছে, এখনো তার কর্মময় জীবন নিয়ে কোন আলোচনা হলেই এই ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রটি সবার আগে চলে আসে৷

হ‌ুমায়ূন ফরীদির সেরা দশ নাটক

হ‌ুমায়ূন ফরীদি প্রথম মঞ্চ নাটক করেন ‘সংবাদ কার্টুন’ নামের নাটকের ছোট্ট একটি চরিত্রে, নির্দেশনায় ছিলেন সেলিম আল দীন সাহেব। টিভি নাটকে বড় চরিত্রে আসেন আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটকের মধ্য দিয়ে। এর আগে সেলিম আল দীনের ‘ওহে দেবদূত’ নাটকের ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। আর চলচ্চিত্রে অভিষেক হন তানভীর মোকাম্মেলের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘হুলিয়া’ (১৯৮৫) দিয়ে, একই বছর শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’ (২৭/১২/১৮৯৫) দিয়ে হন আলোচিত।

‘সংশপ্তক’ নাটকে ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে ফরীদি

মঞ্চ টিভি চলচ্চিত্র… সব ক্ষেত্রেই ফরীদি ছিলেন একজন সব্যসাচী অভিনেতা, সব ক্ষেত্রেই অভিনয় প্রতিভা দিয়ে গড়েন নতুন ধারা, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রে মন্দ চরিত্রের পাশাপাশি তার কমেডি অভিনয় ছিল আলাদাভাবে বলার মতো। সিনেমার মন্দ চরিত্রে তিনি নিজেকে এতটাই জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন যে দর্শকেরা নায়ক নয় বরং ভিলেন ফরীদিকেই দেখতে ছুটে যেতো সিনেমা ঘরে।

চলচ্চিত্রে একেবারে সাদামাটা চরিত্রে অভিষেক হলেও তার ভেতরের থাকা প্রতিভা ভয়ংকর চরিত্রকে বের করে এনেছিলেন গুণী নির্মাতা মরহুম শহীদুল ইসলাম খোকন ‘সন্ত্রাস’ (১৭/০৪/১৯৯১) ছবিতে। সরাসরি প্রধান মন্দ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে, বাংলার দর্শক দেখলো নতুন এক ফরীদিকে, যেখানে তার ভয়ংকর রূপ গোটা সিনেমা হল দর্শকদের মাতিয়ে তুললো। বাংলার দর্শক সাদরে গ্রহণ করে নিলো এই  অভিনেতা সম্রাটকে।

‘জয়যাত্রা’ ছবির দৃশ্য

 

তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া ফরীদির চলচ্চিত্রের পরের অধ্যায়টি ছিল শুধুই সাফল্যে গাঁথা। সে সময় বাংলা সিনেমায় মন্দ চরিত্রে সিংহাসনে বসা রাজীবের ঘাড়ে যেন গরম নিশ্বাস ফেললেন তিনি, যার পরবর্তীতে বাংলা সিনেমা দেখলো মন্দ চরিত্রের সিংহাসনে বসা দুই রাজাকে। তবে চরিত্র বৈচিত্র্যের বিন্যাসে প্রায় একচেটিয়াই ফরীদি রাজত্ব করেছেন বাংলা সিনেমাতে। এমনও হয়েছে শুধু মাত্র ফরীদির জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখে তার চরিত্রকে ফোকাস করে একটি পুরো সিনেমাও তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য করতে হয় ‘বিশ্ব প্রেমিক’ ও ‘পালাবি কোথায়’।

ফরীদিকেন্দ্রিক যত ছবি

‘বিশ্ব প্রেমিক’ ছবিতে সাইকো চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় এখনো মানুষ মনে রেখেছে। ছবিতে ব্যবহৃত সুপারহিট গান মৌসুমীর সঙ্গে ‘তোমরা কাউকে বলো না, কাউকে বলো না, এইতো প্রথম একটি মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে’ শিরোনামের গানটির আবেদন যেন এখনো একই রকম রয়ে গেছে। রুবেলের পাশাপাশি ফরীদিকেও মৌসুমীর নায়ক হিসেবে দর্শক দারুণভাবে উপভোগ করেছে। অন্য দিকে, ‘পালাবি কোথায়’ ছবিতে অফিসের বসের ভূমিকায় তার কমেডি চরিত্র দর্শকদের যেমন হাসিয়েছে, তেমনি কর্মক্ষেত্রে নারী নিপীড়নের চিত্রও তার চরিত্রে উঠে এসেছে। এ ছাড়া ‘সন্ত্রাস’সহ ‘ঘাতক’, ‘কমান্ডার’, ‘টাকার অহংকার’, ‘রাক্ষস’, ‘দুনিয়ার বাদশা’, ‘দুঃসাহস’ ছবিগুলো ছিল অন্যতম৷

বিশ্বপ্রেমিক ছবির পোস্টার

হ‌ুমায়ূন ফরীদি ২০০৫ সালে জাহিদ হোসেনের পরিচালনায় ‘মাতৃত্ব’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয় গুনে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়া টিভি মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় গুনে পান আরও বহু পুরস্কার। মঞ্চ টিভি ও চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান স্বরূপ ২০১৮ সালে তাকে একুশে পদকে (মরণোত্তর) সম্মানিত করা হয়।

হ‌ুমায়ূন ফরীদি ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার যোগী নগরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা এটি এম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম, চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। পড়াশোনা করেন ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে, ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েন চাঁদপুর সরকারি কলেজে, এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন অবস্থায় একটি নাট্য উৎসবের অন্যতম একজন সংগঠক ছিলেন তিনি, এটা ১৯৭৬ সালের কথা। মূলত এখান থেকেই তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহটা শুরু, যার রেশ হিসেবে ছাত্রাবস্থাতেই ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ লাভ করেন তিনি।

‘দহন’ সিনেমার দৃশ্যে হুমায়ুন ফরীদি

ব্যক্তিজীবনে হ‌ুমায়ূন ফরীদি দুবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, প্রথম ঘরে তার দেবযানী নামের একটি মাত্র কন্যা সন্তান রয়েছে। পরবর্তীতে বিয়ে করেছিলেন সুবর্না মুস্তাফাকে, তাদেরও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

হ‌ুমায়ূন ফরীদির সেরা দশ চলচ্চিত্র

এক নজরে হ‌ুমায়ূন ফরীদি অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চ-টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র—

মঞ্চ নাটক: মঞ্চ দিয়েই অভিনেতা ফরীদির অভিষেক। উল্লেখ্যযোগ্য কাজের মধ্যে কীর্তনখোলা, শকুন্তলা, কেরামত মঙ্গল, মুনতাসীর ফ্যান্টাসি অন্যতম। উনি শেষবার মঞ্চে উঠেন সম্ভবত ১৯৯০ সালের দিকে ‘ভূত’ নামের একটি নাটকে, যা ছিল ওনার নিজের নির্দেশিত।

টিভি নাটক: টিভি নাটকের কথা আসলেই বিটিভিতে প্রচারিত হ‌ুমায়ূন ফরীদির তুমুল জনপ্রিয় ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ ও ‘সংশপ্তক’-এর কথা সবার আগে আসবে। অন্যান্য জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে ‘মহুয়ার মন’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘প্রতিধ্বনি প্রতিদিন’-এর নাম বলতেই হয়। এ ছাড়া ‘নীল নকশার সন্ধানে’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, ‘বকুলপুর কত দুর’, ‘গুপ্তচর’, ‘মোহনা’ অন্যতম৷

ছবির ক্লাইম্যাক্সে ফরীদি

চলচ্চিত্র: স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দিয়ে শুরু হলেও নব্বইয়ের শুরুতে ‘সন্ত্রাস’ ছবিটি দিয়েই মূলত হ‌ুমায়ূন ফরীদি তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করেন।  তুমুল জনপ্রিয়দা পায় ছবিটি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। অন্যান্য উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘বিষদাঁত’, ‘টপ রংবাজ’, ‘লক্ষ্মীর সংসার’, ‘উত্থান-পতন’, ‘আজকের হাঙ্গামা’, ‘বেপরোয়া’, ‘শত্রু ভয়ংকর’, ‘হিংসা’, ‘লাভ’, ‘বাংলার বধূ’, ‘ত্যাগ’, ‘অপহরণ’, ‘অনুতপ্ত’, ‘দোলা’, ‘টাকার অহংকার’, ‘আত্ম অহংকার’, ‘দুনিয়ার বাদশা’, ‘দুঃসাহস’, ‘স্নেহ’, ‘ঘাতক’, ‘সবার উপরে মা’, ‘কমান্ডার’, ‘বাংলার কমান্ডার’, ‘আসামী বধূ’, ‘বিশ্ব প্রেমিক’, ‘ঘাত প্রতিঘাত’, ‘বিচার হবে’, ‘স্ত্রী হত্যা’, ‘বিশ্বনেত্রী’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘কুলি’, ‘বাপের টাকা’, ‘ভণ্ড’, ‘একটি সংসারের গল্প’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘বিদ্রোহ চারিদিকে’, ‘যোদ্ধা’, ‘মুখোশধারী’, ‘চারিদিকে শত্রু’, ‘দূরত্ব’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘জয়যাত্রা’, ‘মমতাজ’, ‘মাতৃত্ব’, ‘ব্যাচেলর’, ‘আহা’ অন্যতম। প্রায় ১৬৫টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা হ‌ুমায়ূন ফরীদির সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্রটি ছিল ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘এক জবানের জমিদার হেরে গেলেন এইবার’।

একজন হ‌ুমায়ূন ফরীদি… যিনি তার অভিনয় জাদুতে সব শ্রেণির দর্শকদের হাসিয়েছেন কাঁদিয়েছেন আবেগে ভাসিয়েছেন। যার অভিনয়ে বুঁদ হয়ে থেকেছে যুবা-বৃদ্ধ থেকে সব শ্রেণির দর্শক। অথচ ফাল্গুনের এক সকালে তিনি আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।


Leave a reply