‘দহন’ নিয়ে বাহাস প্রয়োজন
‘যাহা মৌলিক গল্প তাহাই বিকল্প ধারা!’ কিংবা ‘নাচ-গান-অ্যাকশন যেসব সিনেমায় আছে সেটাই বাণিজ্যিক ধারা!’–এমন অর্থহীন বাক্য প্রায়শই বলে থাকেন সিনেপাড়ার অনেকেই। অথচ সিনেমা সবসময়ই সত্যিকারের ‘সিনেমা’ হওয়ার আন্দোলনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। যেসব সিনেমাকে আমরা ‘বিকল্প ধারা’ বলে বিবেচনা করে থাকি, লক্ষ করবেন তার মূলশক্তি কিন্তু গল্প, যেখানে বাজার কাটতি নায়ক-নায়িকার উপস্থিতি খুব কমই থাকে। আবার অধিকাংশ ‘বাণিজ্যিক’ সিনেমায় গল্প বলে তেমন কিছু থাকে না, তবে পর্দাজুড়ে নায়ক-নায়িকা-ভিলেনের আস্ফালন থাকে প্রচুর। আর গল্প থাকলেও সেটি অন্য কোনও সিনেমা থেকে ‘কপি’ করা, নয়তো ‘কপিরাইট’ নেওয়া।
এমনই বাস্তবতায় গল্পের শক্তিকে পুঁজি করে ভালো সিনেমা কি তাহলে তৈরি হয়নি বাংলাদেশে? হয়েছে। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, হুমায়ূন আহমেদ, তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, সালাউদ্দিন লাভলু, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অনিমেষ আইচ, অমিতাভ রেজা, তৌকীর আহমেদ, রুবাইয়াত হোসেন, দীপঙ্কর দীপন, অনম বিশ্বাস- এমন আরও অনেক নির্মাতা রয়েছেন উদাহরণের তালিকায়। ফর্মুলার (নাচ-গান-ফাইট) বাইরে গিয়ে যারা গল্পসমৃদ্ধ সিনেমার মাধ্যমে এক এক করে পালক যুক্ত করেছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পে। সেলুলয়েডে বলার চেষ্টা করেছেন এই দেশ ও মানুষের নিজস্ব কিছু গল্প। তবে এরমধ্যে ঘাটতিও ছিল কোথাও কোথাও। সেটা অন্য আলাপ।
এত কথার পসরা সাজানোর পেছনে উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা হলো, সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া রায়হান রাফীর পরিচালনায় ‘দহন’ সম্পর্কে বলা। কারণ, এটি একটি মৌলিক গল্পসমৃদ্ধ সিনেমা। আর এই গল্পটা বলা হয়েছে ট্র্যাডিশনাল ব্যবসায়িক ফরমেটে। অর্থাৎ নাচ-গান-অ্যাকশনে ভরপুর সিনেমার মধ্য দিয়ে বলা হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্প। যেখানে আছে এই সমাজ, নৃশংসতা, কিছু মানুষের জীবন, আছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হিমশিম খাওয়া অসহায়ত্বের বিষয়। তাই ‘দহন’ সিনেমাকে আমরা বাংলাদেশের জন্য একটি ‘মাইলফলক’ সিনেমা হিসেবেও দাঁড় করাতে পারি।
একই নামে বাংলাদেশে এর আগে ১৯৮৬ সালে শেখ নিয়ামত আলীর কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় নির্মিত হয়েছিল একটি ছবি। সেই দহনে ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাস্তবতার সঙ্গে জীবনযুদ্ধ দেখানোর গল্প, যেখানে ফুটে উঠেছে মধ্যবিত্তরা রয়ে যায় জয়-পরাজয়ের ঠিক মাঝখানটাতে।
গল্প আর প্রেক্ষাপট একেবারে আলাদা হলেও পরিচালক রায়হান রাফী তার নতুন ‘দহন’ দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেছেন একটি শ্রেণি সংগ্রামের সিঁড়ি ধরে। যে চিত্রে তিনি হাজির করেন রাজনীতির বীভৎস আঘাত। এবারের ‘দহন’ ২০১৩/২০১৪ সালের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালের সমাজ বাস্তবতার পর ২০১৩/১৪ সালের সমাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বীভৎস ক্ষমতার রাজনীতির সহিংসতা। যার বাইরে কোনও শ্রেণিই বাদ পড়ে না। না নিম্নশ্রেণি, না মধ্যবিত্ত, না উচ্চবিত্ত- সকলেই শিকার হয় ক্ষমতার রাজনীতির আগুনের। সেই চিত্র তুলে ধরতে শতভাগ সফল এবারের ‘দহন’ টিম। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার মধ্য দিয়ে যেমন সফল ছিল নিয়ামত আলীর ‘দহন’ও।
যাহোক, আসা যাক কেমন হয়েছে ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দহন’। কারণ, দেশের স্বার্থেই এই সিনেমার সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে বাহাস প্রয়োজন।
যেখানে সফল ‘দহন’
১.
দহনের বড় সফলতা হলো বর্তমান সময় এবং রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ধারণ করা। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো রাজনৈতিক সহিংসতায় সাধারণ মানুষের দুর্দশা। যার প্রতিটি ক্ষেত্রকে কিছুটা হলেও সংযোগ করাতে চেষ্টা করেছেন পরিচালক। ক্ষমতার গদিতে বসার মোহে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলার যে অপচেষ্টা, তা সকলে জানেন। রুপালি পর্দায় এই বিষয়টি এর আগে টুকটাক এলেও সেসব ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো। তাছাড়া এসব বিষয়ে জটিলতা ছিল সেন্সরবোর্ডের পক্ষ থেকেও। সম্ভবত এবারই প্রথম শুধু রাজনৈতিক ভায়োলেন্স নিয়ে সাজানো হলো সিনেমার গল্প। পেয়েছে আনকাট ছাড়পত্রও, যা সত্যিই সাধুবাদযোগ্য।
২.
হরতাল অবরোধে থমকে আছে পুরো দেশ। যার প্রভাব পড়েছে নিম্নবিত্তের ওপর। যারা দিন এনে দিন খায় তাদের কাজ নেই। কিন্তু পেট তো চালাতে হয়। তারা হাজির হয় পাড়ার মুদি দোকানে। বাকিতে বাজার চায়। দোকানদার বিরক্ত। তবু সে জানে লোকগুলো নিরুপায়। এখানে এক মানবিক চিত্র হাজির করেন পরিচালক। দেখানো হয়, এরা একে অপরের সাহায্যে পাশে আছে। দোকানদার বিরক্ত হলেও বাকিতে বাজার ঠিকই দেয়। ভাবে, অন্তত লোকগুলো এই অস্থির সময়টা পার তো করুক। আবার এও দেখা যায়, অবরোধের কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ। দাম বেড়ে গেছে সবকিছুর। যার প্রভাব পড়ে খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। অন্যদিকে গার্মেন্টকর্মীদের এক মাসের অর্ধেক বেতন দিয়ে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই আফসোস থেকে এক কর্মী মন্তব্য করেন, ‘দেখলি আধা মাসের বেতন দিয়া বন্ধ কইরা দিল।’ তখন নায়িকা আশা উত্তরে বলেন, ‘তাও তো দিছে, অনেকে তো বেতনই পায় নাই।’
রাজনীতির সহিংসতা কীভাবে মানুষের অর্থনীতিতে আঘাত করেছিল তার পরিষ্কার একটি চিত্র তুলে ধরতে পেরেছেন পরিচালক। এই অর্থনীতির প্রেক্ষাপট হাজির করার প্রক্রিয়াটি এক কথায় দুর্দান্ত লেগেছে।
৩.
নিম্নবিত্ত নারীদের নিগ্রহের বিষয়টাও উঠে আসে। মুদি দোকানদার একদিকে মানবিক, অন্যদিকে তার রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক লোভী মন। যে মনের চোখ দিয়ে সে নারীকে পেতে চায়। আমরা এই দিকটি বুঝতে পারি যখন দেখি সিনেমার নায়িকা আশা তার দোকানে হাজির হয়। আশার সঙ্গে মুদি দোকানির কথোপকথন ও অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করে নারীর প্রতি তার কামনার দৃষ্টি। অন্যদিকে নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর আরেকটি চরিত্র ফুলবানু যখন সিনেমার পোস্টার দেখছিল তখন এলাকার বখাটেদের উত্ত্যক্ত করার চিত্রটিও হাজির হয় দহনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো নারীর বিরুদ্ধে যখন নিপীড়ন হয়, তখন রুখে দাঁড়ানোর আলাপ আমরা সবাই করি। এই দহনে সূক্ষ্মভাবে ফুলবানুর পাশে এসে দাঁড়ায় সাংবাদিক চরিত্র মায়া। সে এসে বখাটের গালে চড় বসিয়ে দেয়। অর্থাৎ নারীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কণ্ঠস্বরও হাজির হয় দহনে, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
৪.
দহনে অনেকের গল্প আছে। গল্পকার চমৎকারভাবে শ্রেণি আর ধর্মকে স্থান দিয়েছেন এখানে। পুরো সমাজ যাদের নিয়ে গঠিত তাদের তেমন কাউকে আড়াল করা হয়নি। এওবা ক’টি বাংলাদেশি সিনেমায় আমরা দেখতে পাই?
৫.
উচ্চবিত্ত শ্রেণির কিছু দালালের মাধ্যমে এই সমাজ কাবু হয়ে থাকে। যাদের কাজই মানুষ ঠকানো। মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া। এটা আমরা বুঝতে পারি, যখন দেখতে পাই নায়ক তুলা মিয়াকে মাত্র কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা হয় গাড়ি ভাঙচুর করতে। আর সেই কথিত নেতা তারও বড় নেতার কাছ থেকে এই কাজের জন্য হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। আবার বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়ার জন্য ছেলে যখন কিডনি বিক্রি করতে যায়, দাম পায় দুই লাখ টাকা। সেই দালাল একই কিডনি বিক্রি করে হাতিয়ে নেয় দশ লাখ টাকা। এই যে অন্যায্যতা, মানুষ ঠকানোর উৎসব চলে চিকিৎসা ব্যবস্থায়, তাও তো কোনও অংশে কম সহিংস নয়। সেই সুতোটা সুন্দর করেই যৌথভাবে টেনেছেন দহনের গল্পকার ও নির্মাতা।
৬.
গল্পের নায়ক ও ভিলেন দুই চরিত্রে একজনকেই দাঁড় করানো হয়। তুলা মিয়া এই গল্পের নায়ক, আবার তিনিই ভিলেন। অথচ তুলা মিয়ারও একটা নিজস্ব গল্প আছে। আমরা তো মনে করি অপরাধীদের জীবনে কোনও গল্পই থাকে না। অথচ দহনে দেখা যায়, অপরাধকারীর একটা প্রেম থাকে, সুন্দর মায়াময় মন থাকে, তার ভেতর অপরাধবোধও কাজ করে। এসব মিলেমিশে একাকার হয়ে দহন তার দর্শক মনে এক অন্যরকম প্রেক্ষাপট তৈরি করতেও সক্ষম হয়।
৭.
সিয়াম আহমেদ অভিনয় করেছেন তুলা মিয়ার চরিত্রে, পূজা চেরি করেছেন আশা বেগম, জাকিয়া বারী মম করেছেন সাংবাদিক, ফজলুর রহমান বাবু করেছেন কবির চরিত্রে অভিনয়। মূল চরিত্রগুলো এই কয়েকটিকেই বলা চলে। যারা মোটামুটি বিস্তার করার সুযোগ পেয়েছেন দহনজুড়ে।
সিয়াম সম্পর্কে বলতে হয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বহুবছর পর একজন পূর্ণাঙ্গ নায়ক পেতে চলেছে। তার অভিনয় দক্ষতা সিনেমার জন্যই প্রস্তুত বলে মনে হয়েছে। অন্যদিকে পূজা চেরির খুব বেশি কিছু করারও ছিল না এখানে। যতটুকু সুযোগ ছিল ঠিকঠাক নিজেকে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। তবে সিয়ামের পর সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করতে হয় মমকে নিয়ে। পুরো চরিত্রটিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে মুনশিয়ানারও প্রয়োজন। যেখানে শতভাগ সফল জাকিয়া বারী মম। অথচ এই চরিত্র নিয়ে কতটা জল ঘোলা হয়েছে। কখনও বাঁধন, কখনও পূর্ণিমার নাম এসেছে শুটিংয়ের আগে। এখন বলাই যায়, চমৎকার একটি চরিত্রে কাজ করা হলো না তাদের। একই সঙ্গে দহনের মতো সিনেমার অংশীদার হওয়ার বেদনা নিশ্চিত এরইমধ্যে অনুভব করছেন তারা।
৮.
সিনেমাটোগ্রাফি ও গ্রাফিক্স নিয়ে কথা বলার খুবই প্রয়োজন। তবে সিনেমাটোগ্রাফিতে যারা দক্ষ তারা আরও ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন বলেই মনে হয়। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে সবকিছুকেই পারফেক্ট মনে হয়েছে। টপভিউ শটগুলো খুবই চমৎকার ছিল। এমনকি ক্লোজশটে যখন তুলা মিয়া বলছিল, ‘আমি আমাগো নেতাগো পায়ে ধইরা একটা কথা কই, আপনারা ক্ষমতায় যাওনের লাইগা আর কাউরে মাইরেন না’— তখন প্রেক্ষাগৃহজুড়ে নেমে এসেছিল পিনপতন নীরবতা। অনেক দর্শকই থমকে ছিল কিছুক্ষণ। তবে সবচেয়ে দুর্দান্ত ছিল ভিএফএক্স-এর কাজ। পেট্রোলবোমা মারার পর গাড়ির যে ভিএফএক্স শট ছিল, তা এক অর্থে দুর্দান্ত মনে হয়েছে। বাংলাদেশের সিনেমায় মনে হয় দর্শক প্রথমবার এমন কোনও হৃদয়গ্রাহী শট দেখতে পেয়েছেন। যা তার চোখ ভেজাবে, হৃদয়কে নাড়া দেবে।
যেখানে ব্যর্থ ‘দহন’
১.
দহনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো–গল্পের শুরু থেকেই সবাই জানে তুলা মিয়া একটা বাসে পেট্রোলবোমা মারবে। যেখানে থাকবে তার প্রেমিকা আশা। অথচ এটাই সিনেমার সবচেয়ে ট্র্যাজিক পয়েন্ট হওয়ার কথা। অথচ এই গল্পটাই দর্শক জানে ট্রেলার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই। কিংবা না জানলেও বুঝে যাবে সিনেমার শুরুতেই।
২.
দহনের গল্প অনেকটা নন-লিনিয়ার ফরমেটও বলা চলে। কখনও অতীত, কখনও বর্তমানে এসেছে। এই নন-লিনিয়ারিটি কিছুটা হলেও শুরুতে বিরক্তির কারণ হয়েছে।
৩.
অনেকগুলো মানুষের গল্প বলে তারপর তাদের একটি বাসে হাজির করান পরিচালক। কিন্তু প্রতিটি গল্প বলতে গিয়ে অনেক সময় খাপছাড়া খাপছাড়া মনে হয়েছে। বিরতির সময়কাল পর্যন্ত গল্পটাকে অনেক ঢিমেতালে চলতে হয়েছে। যদিও বিরতির পর টানটান উত্তেজনা ফিরে পেয়েছিল দহন। অর্থাৎ গল্পে খাপ খাওয়াতে কিছু বেগ পেতে হয়েছে দর্শককে।
৪.
শুরুতেই বলেছি ব্যবসায়িক ফরমেটে আনতে হলে সিনেমায় গান-নাচও জরুরি উপাদান। কিছুটা গ্ল্যামারও আনতে হয়। এক্ষেত্রে নায়িকার ভূমিকা তো আছেই। তো গান-নাচ আনা হয়েছে যেসব জায়গায়, প্রতিটি জায়গাতেই অহেতুক গানের ব্যবহার মনে হয়েছে। অনেক দর্শকই বলছিলেন, ‘কথা নাই বার্তা নাই গান হাজির!’ এমনকি বহুল বিতর্কিত ‘হাজির বিরিয়ানি’ গানটিও হুট করেই শুরু হয়। গার্মেন্টকর্মী আশা আর মাস্তান তুলা মিয়াকে পুরো সিনেমাতেই তাদের শ্রেণি অনুযায়ী পোশাকে হাজির করা হয়। অথচ গানে দেখা যায় তাদের আধুনিক তথা বলিউড স্টাইলের পোশাক! যা দেখতে খটকাও লেগেছে।
৫.
প্রতিটি গল্পে চরিত্রের বিস্তার খুব বেশি জরুরি। চরিত্র বিকাশে অনেকটাই ব্যর্থ ‘দহন’। একমাত্র তুলা মিয়া এবং আশা ছাড়া কোনও চরিত্রই বিকাশ লাভ করার সুযোগ পায়নি। যদিও সুমন ও তার মায়ের চরিত্রটি কিছুটা জায়গা করতে পেরেছে। বাকি সবগুলো চরিত্রই অসম্পূর্ণ। যেমন ফজলুর রহমান বাবু, জামিল হোসেন, রিপা রাজ—এরা যে চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন সেগুলো তেমন কোনও বিস্তারই করেনি।
৬.
গল্পের সমাপ্তি কোন দিকে যায় সেটা জানতেই বিরতির পর দর্শকের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। অনেকেই ভেবে বসতে পারেন তুলা মিয়া না বুঝে মানুষ মেরেছে, সুতরাং বেঁচে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। এখানে গল্পের একটা ঘাটতিও রয়েছে। তুলা মিয়ার লিডার কবির তাকে কাজ দেয়। একটা বোতল ফেলতে বলে বাসে। সেটা যে পেট্রোলবোমা তা নাকি তুলা মিয়া বুঝতে পারেনি! এটা কি সম্ভব? তাকে একটা বোতল মারতে বললো, আর তা-ই সে মেরে আসলো! এত ‘সহজ-সরল’ পেট্রোলবোমা হামলাকারী মনে হয় সিনেমাতেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব, বাস্তবে নয়।
যাহোক, এছাড়া একজন সাংবাদিকের সঙ্গে খুনের মামলার আসামির কারাগারের ভেতর ওয়ান-টু-ওয়ান মিটিং ফিক্স করা বাস্তবে আদৌ সম্ভব কিনা সে বিষয়েও জ্ঞান আমার নেই। ধরে নিলাম সিনেমাতে এমন অনেক কিছুই থাকে।
কারাগারে বসে তুলা মিয়ার সঙ্গে সাংবাদিকের আলাপ যেভাবে কলমের তৈরি গোপন ক্যামেরায় ধারণ করলেন, সেটা তাহলে কোন কাজে ব্যবহার হলো? এটা অবশ্য জানা হলো না। এমন অনেক ‘কেন’ তৈরি হবে দহন দেখলে।
তবুও অনন্য ‘দহন’
সমালোচনা সিনেমার জন্য মন্দ নয়। বরং আরও শক্ত ভীত তৈরি করতে পারে যেকোনও গঠনমূলক সমালোচনা। তবে শেষ পর্যন্ত গর্ব করেই বলতে হয়, দহন আমাদেরই সিনেমা। যেখানে নিজস্ব গল্প আছে, দেশের বাস্তবতাও আছে। চুলচেরা বিশ্লেষণ সাধারণ দর্শক করবে অথবা করবে না। আদতে বিবেচ্য বিষয় হলো সিনেমাটা উপভোগ্য হলো কিনা। সেটা বাংলাদেশের সিনেমা হয়ে উঠলো কিনা। ‘দহন’ অনন্য এই কারণে যে, এই সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সিনেমা হয়ে উঠেছে।
একনজরে ‘দহন’-
চরিত্রগুলো: সিয়াম আহমেদ (তুলা মিয়া), পূজা চেরি (আশা বেগম), জাকিয়া বারী মম (সাংবাদিক), ফজলুর রহমান বাবু (কবির), শিমুল খান (পুলিশ ইন্সপেক্টর), তারিক আনাম খান (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), রাইসুল ইসলাম আসাদ (ইমাম), শহীদুল আলম সাচ্চু (চেয়ারম্যান), মুনিরা আখতার মিঠু (আশার মা), হারুন-অর-রশিদ (পাড়ার দোকানদার), জামিল হোসেন (গুপ্তচর), রাশেদ মামুন অপু (মর্গের কর্মী), সুষমা সরকার (ডাক্তার), ববি (সুষমার বাবা), জামশেদ শামীম (কাওসার), রিপা রাজ (ফুলবানু), জাহিদ হোসেন শোভন (সাংবাদিক), মেহেদী হাসান পিয়াল (ডাক্তার) প্রমুখ।
গল্প: দেলোয়ার হোসেন দিল
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: রায়হান রাফী
সিনেমাটোগ্রাফি: সাইফুল শাহীন ও রিপন
সম্পাদনা: এমডি কালাম
প্রযোজনা ও পরিবেশনা: জাজ মাল্টিমিডিয়া
মুক্তি: ৩০ নভেম্বর, ২০১৮
লেখাটি বাংলা ট্রিবিউন ডটকমে প্রকাশিত