দুর্দান্ত নয়, তবে উপভোগ্য ‘অপারেশন সুন্দরবন’
সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে বছরের পর বছর ধরে রাজত্ব করে আসছে জলদস্যুদের কয়েকটি দল। এরা ৭২ জন জেলেকে নানা জায়গা থেকে ধরে এনে আটকে রেখেছে। যারা শারীরিকভাবে দুর্বল তাদের মেরে ফেলছে, আর যারা শারীরিকভাবে একটু সবল তাদের বিনিময়ে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই দস্যু নেটওয়ার্ক ও এদের মূল হোতাকে ধরতে লে. কমান্ডার রিশান (রোশান)-এর নেতৃত্বে একটি দল সুন্দরবনে যায়।
তারা এই নেটওয়ার্কের মূল হোতা হিসেবে গজাল ডাকাতের পরিচয় পায়। কিন্তু যে গজাল ডাকাতকে ধরার মিশন ব্যর্থ হয়। এরপর আরেকটি দল সুন্দরবনে পাঠানো হয়, যার নেতৃত্বে আছে মে. জে. সায়েম সাদাত (সিয়াম)। তারা গজাল ডাকাতকে ধরতে পারলেও পরবর্তীতে আবিষ্কার করে, এদের ওপরেও অনেক বড় বড় মাথা সুন্দরবনের জলদস্যুতার সঙ্গে জড়িত। এরা কারা, এদের কাজ কী ও দাদের কীভাবে পাকড়াও করা যায়; সেই গল্পই আমরা দেখতে পাই।
স্পয়লার: এ চলচ্চিত্রের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গল্পের ক্লাইম্যাক্স প্রকাশ করা হয়েছে। ‘অপারেশন সুন্দরবন’ না দেখে থাকলে রিভিউটি পরিহার করতে পারেন। সিনেমাটি দেখে আপনিও আমাদের মতামত জানাতে পারেন। লিখতে পারেন রিভিউ।
অপারেশন সুন্দরবন; ধরন: ওয়াইল্ড লাইফ অ্যাকশন থ্রিলার; পরিচালনা: দীপংকর দীপন; অভিনয়: সিয়াম আহমেদ (মেজর সায়েম সাদাত), জিয়াউল রোশান (রিশান রায়হান, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার), রিয়াজ (ইশতিয়াক আহমেদ, ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার), নুসরাত ফারিয়া (তানিয়া কবির, বাঘ গবেষক), দর্শনা বণিক (ডাক্তার), তাসকিন রহমান (রাকিব), রাইসুল ইসলাম আসাদ, শতাব্দী ওয়াদুদ (মনা), আরমান পারভেজ মুরাদ, মনোজ প্রামাণিক (সাজু), সামিনা বাশার (পাখি), রওনক হাসান (সাংবাদিক) ও তুয়া চক্রবর্তী; প্রযোজনা: র্যাব ওয়েলফেয়ারস অ্যাসোসিয়েশন; মুক্তি: ২৩ সেপ্টেম্বর
ভালো দিকগুলো
এক. পরিচালনা: ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর প্রায় ৫ বছর পর দীপংকর দীপন দ্বিতীয় সিনেমা নিয়ে হাজির হলেন। মাঝে তার দুই-দুইটা প্রজেক্ট প্রি-প্রডাকশনে থাকা অবস্থায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ‘ডু অর ডাই’ জমকালো ঘোষণার পর শুটিং শুরু হয়নি, অন্যদিকে ‘ঢাকা ২০৪০’-এর শুটিং কিছুদূর এগিয়েও বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ‘অন্তর্জাল’ নামের আরেকটি ছবির কাজ অনেকটা শেষ। সঙ্গে ছিল কভিড পরিস্থিতি। এ সবের মাঝে প্রথম রিলিজ থেকে দ্বিতীয় রিলিজের মাঝে এই ৫ বছরের লম্বা গ্যাপ
সিনেমার ডিরেক্টরকে বলা হয়, ক্যাপ্টেন অফ দ্য শিপ। সত্যিকার অর্থেই এই সিনেমার ক্যাপ্টেন হলেন দীপংকর দীপন। বলা হয়ে থাকে, ‘অপারেশন সুন্দরবন’ অনেক কল্পনা থাকলেও এর ভিত্তি সত্য ঘটনা। সাধারণত এই ধরনের সত্যিকার মিশনের গল্পকে পর্দায় তুলে আনার ক্ষেত্রে ডকু স্টাইল বেশি ফলো করা হয়। যেন একদম রিয়েলিস্টিক ফিলটা পাওয়া যায় এবং মিশনটি যেন আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠে। দীপঙ্কর দীপন সেই পথে হাঁটেননি। সিনেমাটিকে সিনেমার মতো করে ট্রিট করেছেন। পুরোপুরি কমার্শিয়াল এপ্রোচ নিয়ে শেষ করেছেন। তিনি সুন্দরবনকে দেখিয়েছেন, সেই সাথে একটি ভালো গল্পও বলেছেন। র্যাবকে মোটামুটি হাইলাইট করেছেন, ব্যাপারটি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়নি। এ জন্যে এই সিনেমার মেইন হিরো হলেন সিনেমার পরিচালক নিজে!
দুই. কারিগরি দিক: এই সিনেমার টিম খুবই শক্তিশালী টেকনিক্যাল সাপোর্ট পেয়েছে। তবুও অনেক সময় দেখা যায় শক্ত টেকনিক্যাল সাপোর্ট থাকলেই ভালো সিনেমা হয় না। ‘অপারেশন সুন্দরবন’ দেখলেই বুঝবেন, প্রত্যেকটা ফ্রেম কতটা গায়ে খেটে বানানো!
গ্রিন স্ক্রিন ও ভিএফএক্সের ব্যবহার খুব বেশি একটা নেই। বাঘের অংশটুকু গ্রিন স্ক্রিন ও ভিএফএক্সের সাহায্যে দেখানো হয়েছে। মন্দ লাগেনি। তবে ভালো লেগেছে সিনেমাটোগ্রাফি, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও এডিটিং। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের বিবেচনায় একদম টপ নচ লেভেলের কাজ পাওয়া গেছে এই অংশে। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফির সঙ্গে মানানসই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সিনগুলোকে শক্ত বিল্ডআপ দিয়েছে। যার জন্যে সিনেমার ভিত্তি অনেক বেশি শক্তপোক্ত হয়েছে।
অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলো মোটামুটি, এই জায়গায় আরেকটু উন্নতির সুযোগ আছে। এছাড়া রাতের দৃশ্যগুলো একটু বেশি রিয়েলিস্টিক রাখতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত অন্ধকার করে ফেলা হয়েছে। আমাদের দেশের সিনেমাহল প্রজেকশন সিস্টেম বিবেচনায় এ জায়গাটুকু এমন না করলেও পারতো, দেখা যাবে অনেক দর্শক কোনো সিঙ্গল স্ক্রিনে ওই সব সিনে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারবে না।
তিন. গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ: চিত্রনাট্য অনেক বেশি গতিশীল, একই সাথে আকর্ষণীয়। থ্রিল থ্রিল ভাবটা একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে। ‘ঢাকা অ্যাটাক’-এর মতো ইমোশন নিয়ে অতিরিক্ত মাখামাখি করেনি। প্রেম-ভালোবাসা নিয়েও সিনেমাটা বেশি কচলাকচলি করেনি, যেটা দেখে বেশ অবাকই হয়েছি। একদম শুরু থেকে শেষ অব্দি সিনেমাটা টু দ্য পয়েন্টে ছিল। গল্পের আসল খলনায়ক কে, সেই রহস্য ‘অপারেশন সুন্দরবন’ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে। আর সবশেষে, প্রকৃতির প্রতিশোধ দেখানোর মাধ্যমে যেভাবে ‘অপারেশন সুন্দরবন’ শেষ করা হয়েছে, এর থেকে ভালো ফিনিশিং আর হতে পারে না।
খারাপ দিকগুলো
এক. আবেগ-অনুভূতির অভাব: ‘অপারেশন সুন্দরবন’ গল্পনির্ভর হওয়াতে চরিত্রগুলো সেরকম বিশেষ কোনো ডালপালা মেলেনি। সিনেমার চরিত্রগুলো সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতে পারি না। ‘ভালো বনাম খারাপ’ এই ফরমেট ধরে সামনে এগিয়েছে। অর্থাৎ, এখানে ভালো হোক বা মন্দ, প্রায় সব চরিত্রই প্রচন্ডরকম একমাত্রিক। যার ফলে আমরা মূল চরিত্রগুলোর দুঃখ-কষ্ট, আবেগ তেমন অনুভব করতে পারি না। এমনকি ডাকাতদের নৃশংসতাও আমরা তেমন অনুভব করতে পারি না। শুধুমাত্র মনোজ প্রামাণিক ও রওনক হাসানের অংশটুকুতে বিষয়গুলো অনুভব করতে পারি, কিন্তু এদের স্ক্রিনটাইম মূল সিনেমার তুলনায় বেশ অল্পই!
দুই. একমাত্রিক মূল চরিত্র ও সাদামাটা অভিনয়: মূল দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন সিয়াম ও রোশান। সিয়াম বেশি ফোকাস পেলেও রোশানের স্ক্রিনটাইম কম বলা যাবে না। দুজনের স্ক্রিনটাইম বলা যায় ৬০-৪০ অনুপাতে ছিল। দুজনের পারফরম্যান্সই ভালো লেগেছে, তবে ভালো মানে এই না যে পুরো ফাটিয়ে দিয়েছে। যে যার চরিত্র ঠিকঠাকমতো রূপদান করেছে। দুজনকে অনেকগুলো সিনে একসাথে দেখতে পাওয়া গেছে। একসাথে মিশনেও অংশ নিতে দেখা গেছে। এগুলো খুব উপভোগ্য ছিল।
অন্যান্য চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই। নুসরাত ফারিয়া, ভারতের দর্শনা বণিক; এদের পারফরম্যান্স মোটামুটি মানের ছিল। রিয়াজের পারফরম্যান্সও মোটামুটি। তার সংলাপ বলা নিয়ে অনেকের কাছে একটা অভিযোগ শুনেছি; তিনি আরোপিত করে ফেলছেন। উনি পুরো সিনেমা জুড়েই এমন দাঁতে দাঁত চেপে ডায়লগ দিয়েছেন, তাই আমার কাছে এটা বড় সমস্যা মনে হয়নি। টোনাল শিফট না করায় বিষয়টা ‘ওকে’ মনে হয়েছে।
অন্যান্য ছোট চরিত্রগুলোর মধ্যে মনোজ প্রামাণিক ও রওনক হাসানের কথা তো আগেই বললাম। তাসকিন রহমান, শতাব্দী ওয়াদুদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আরমান পারভেজ মুরাজ ঠিকঠাক। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ থেকে প্রশংসা পাওয়া দীপু ইমামকে এখানেও একটা কমেডি চরিত্রে পাওয়া গেছে। তার কাছ থেকে মোটামুটি কমিক রিলিফ পাওয়া গেছে।
মন্তব্য: ‘অপারেশন সুন্দরবন’ সেই অর্থে কোনো দুর্দান্ত সিনেমা হয়নি। তবে সিনেমা হলে দেখার মতো একটা দারুণ উপভোগ্য সিনেমা। এই মুহূর্তে দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে ফেরাতে হলে এরকম নির্মাণ আরো প্রয়োজন।
রেটিং: ৭/১০