‘দেবী’ ঝকঝকে গল্প-বলা ছবি
জয়া আহসান প্রযোজিত, অনম বিশ্বাস পরিচালিত, ‘দেবী’ আমার দেখতে যাবারই কথা। তা ছবিটির প্রযোজকের তারকাখ্যাতির কারণে নয়; তিনি আমার স্ত্রীর বান্ধবী বলেও নয়। (বাংলাদেশী) চলচ্চিত্রে নারীর পক্ষে প্রযোজনা (বা পরিচালনা) অসম্ভবপ্রায় এক কাজ বলে খানিকটা। তার চেয়েও বড় কারণ এই শেষ দু’তিন বছরে আমি নিয়মিতই চেষ্টা করছি নানাবিধ ছায়াছবি হলে গিয়ে দেখতে। আমার এই দর্শক-ভূমিকা পরিচিত কেউ কেউ “বাংলা ছায়াছবি জেগেছে” দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করছেন। আদতে তাঁরা আসলে মধ্যবিত্ত ‘রুচি’ বিষয়ক এক কষ্টিপাথর দিয়ে ছায়াছবির দিকে তাকান। তাই হলসমূহের এই পরিমাণ বিনাশের পরও “জাগা” বিষয়ক হাস্যকর থিসিসটা জাগরুক রেখেছেন। বাস্তবে আমার রুচির কোনো বাতিক নাই। আমি নানাবিধ ছবিই দেখছি, আগেও দেখতাম। ‘অবুঝ মন’ থেকে ‘সবুজ সাথী’; ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’ থেকে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’; ‘বেদ্বীন’ থেকে ‘চাচ্চু’।
তারপরও ‘দেবী’র পয়লা শো’তে ঢুকতে পারা আমার সাধ্যাতীত হতো। এজন্য আমার গিন্নি, জয়া ও আমি সকলেই ধন্যবাদার্হ। ভাগ্যিস আমি জয়ার সেসব বান্ধবীর একজনকে বিয়ে করতে পেরেছিলাম যাঁরা জয়ার খাস টিকেটগুলোর দুটো করে দাম্পত্যমূলক সংগ্রহ করতে পেরেছেন! সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে আমার কম ভালো লাগে। মূলত এর বাইরে স্মৃতির সিনেমা হলগুলোর কোনো লক্ষণা দেখা যায় না বলে। তবে আমি ঢাকার বাইরে একাধিক হলে সাম্প্রতিক কালে সিনেমা দেখতে গিয়ে একই বেদনার মুখোমুখি হয়েছি। সেসব হলের হতশ্রী দশার কারণে; আর সিনেপ্লেক্সে বাজারীয় ও আর্কিটেকচারের জৌলুসের মধ্যে হলটাই অদৃশ্য হয়ে যাবার কারণে। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে সিনেপ্লেক্সের উদ্যোক্তারা ঝকঝকে একটা পর্দা দেখান। সেটা ছায়াছবির জন্য অতীব জরুরি।
“দেবী” নিয়ে অনেকের আগ্রহ এর গল্প হুমায়ূন আহমেদের অতিজনপ্রিয় সাহিত্য থেকে নেয়া বলে। সাহিত্যকর্ম থেকে বানানো ছায়াছবিতে আমি সাহিত্যিককে মাথায় নিয়ে যাই না। বড় হবার পর কোনোদিনই। এ দুটো মাধ্যম এত আলাদা যে আমার কখনো ওই বয়ে-নিয়ে-চলা কাজের কাজ মনে হয়নি। হুমায়ূন-সাহিত্য আমার অল্পই পড়া। কিন্তু ‘দেবী’ আমার পড়া ছিল। মনে ছিল না। মনে থাকলেও তা কোনো ঝামেলা করত না। আমি ছায়াছবিতে আদিগল্প খুঁজিই না। মনে থাকলে নিজমনে তুলনা করতে পারি। কিন্তু সেটা ছবির মেরিট বোঝার কোনো মানদণ্ড হিসেবে দেখি না। কথাটা এলো এজন্য যে এরই মধ্যে কারো কারো মন্তব্যে প্রসঙ্গটা কানে এসেছে।
‘দেবী’ ঝকঝকে একটা গল্প-বলা। পরিশেষে আমার জন্য সিনেমার সংজ্ঞা খুব সরল। পর্দায় গল্প দেখা। আমি জেনেছি অনম বিশ্বাসের এটা প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য পরিচালনা। সেটা না জানলেও গল্প-বলার দায়িত্বে তাঁকে আমার ছিমছামই লাগত। সাফ মাথায় দৃশ্যগুলো তিনি কল্পনা করতে পেরেছেন বলেই মনে হয়। চিত্রনাট্য কার এখন ভুলে গেছি, কিংবা সম্পাদনা। কিন্তু পরিচালক-চিত্রনাট্যকার-চিত্রসম্পাদক এই ত্রয়ীর যোগসাজশ ঠিকঠাক ছিল সেটা দর্শক হিসেবে প্রথমেই মনে হয়েছে। একাধিক ছবি দেখতে বসে যোগাযোগহীনতা বা টানাপড়েনের গন্ধ পাওয়া যায়। বা বলা চলে সাজুয্য/কোঅর্ডিনেশনহীন টিমের কাজ দেখছি।
একটা আধিভৌতিক/অলৌকিক গল্পে একজন কঠোর বিজ্ঞানমনস্ক লোক আছেন – মিসির আলি। এই চরিত্রে অভিনয়ের চ্যালেঞ্জ এমনিতেই অনেক। কিন্তু চঞ্চল চৌধুরীর জন্য বিষয়টা আরো কঠিন ছিল। হাজার হাজার লোক হুমায়ূন আহমেদের কিতাবের ‘মিসির আলি’কে দেখতে গেছেন। সেটা এই চরিত্র করার জন্য অত্যন্ত চাপের (ছিল)। এর কাছাকাছি বাংলা ভাষায় এত চাপ হয়তো ফেলুদাসমূহেরই বহন করতে হয়েছে। কিন্তু চঞ্চলের অভিনয়দক্ষতা এখন আলাপের জন্য বাহুল্য। তাঁর কণ্ঠস্বর ও কণ্ঠভঙ্গি এমনিতেই আধাকাজ সোজা করে দেয়। গত কয় বছরে এমনসব ছবিতে এমন বিভিন্ন কাজে একই রকম দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি, তাঁর কাছ থেকে ‘মিসির আলি’ লোকে বেশিই আশা করবেন। তিনি দারুণ করেছেন। অন্তত লাগাতার চরিত্রে নিবিষ্ট, একরকম। সেটা এই চরিত্রের জন্য কঠিন। নির্মাতা এবং অভিনেতা মিসিরকে উপন্যাসের তুলনায় কম ‘উদ্ভট’/অবনক্সাস বানিয়েছেন। যাঁরা হুমায়ূনের ‘মিসির আলি’ মাথায় নিয়ে হলে ঢুকেছেন তাঁদের সেটা খানিক হতোদ্যম করতে পারে (বলেছিলাম যে আমি মাথায় বহন করি না; কিন্তু আদিগল্পের বিষয় আশয় মাথায় আলাদা করে রেখে তুলনা করতে পারি)।
তবে যদি গভীরভাবে ভাবতে বসি, মিসিরের অপেক্ষাকৃত কম উদ্ভটতা (উপন্যাস/সিরিজের তুলনায়), বেশি প্রেডিক্টিবিলিটি অন্তত দুটো কারণে ছবিতে জরুরি ছিল। এক) ছায়াছবির দৃশ্যায়নে যুক্তিশীলতা সুলভ করবার জন্য; দুই) চলচ্চিত্রটিতে ‘দেবী’র উপর অধিক গুরুত্ব দেবার জন্য। আমার দুয়েক নারীবাদী বন্ধুকে বলতে শুনেছি ছবিটি নারীবাদী। নারীবাদের নানান মাত্রা/গুণ বিবেচনা করে এই দাবিকে আমি সমর্থনই করব। আর মিসিরের বাসগৃহটা দৃশ্য হিসেবে দুর্দান্ত। ভোরের আলো বা মধ্যরাতের সাজে ঘরটা মায়াবী হতে পেরেছে।
আনিসের চরিত্রে অনিমেষ আইচ অনবদ্য। নানান কারণে অনবদ্য। অনিমেষকে সামনাসামনি দেখেছি বলে তিনি যে ‘সুপুরুষ’ সেটা জানতাম। কিন্তু পর্দায় না দেখলে তিনি কত রূপবান খেয়াল করা হতো না। আমি টিভি নাটকে কখনো তাঁকে দেখে থাকলেও ভুলে গেছি। আনিসের চরিত্রে বেপরোয়া উৎকণ্ঠা আর গভীর বেদনাময় নির্লিপ্তি দিয়ে তিনি রূপদান করেছেন। রানু/দেবীর স্বামী হিসেবে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট রূপায়ন হয়েছে। আনিসকে তাঁর কর্মজগতে, এমনকি গৃহস্থালি কাজকর্মে দেখা যায় না। ফলে স্ত্রীর সঙ্গে ও স্ত্রীর “অসুখ”জনিত উৎকণ্ঠাই তাঁর একমাত্র উপায় ছিল। তিনি দারুণভাবে নিয়েছেন।
নীলুর চরিত্রে শবনমকে আমার খুব ভালো লেগেছে। ওর সংশয়, দ্বিধা, প্রেমে পড়ার আড়ষ্টতা, নতুন একটু বয়সে-বড় সখীকে পাবার আনন্দ, ছোটবোনের সঙ্গে খুনসুটি এসবে মায়াকাড়া লেগেছে। শবনমের অভিনয় এই প্রথম দেখছি। নীলু হিসেবে তাঁর পর্দা উপস্থিতি মিত ও সুন্দর।
তুলনায় ইরেশ যাকেরের দক্ষতা দেখার সুযোগ কম পেয়েছি বলে মনে হলো। তিনি এমন তিনটা মাত্র স্থানে/সেটিংয়ে দৃশ্যমান হয়েছেন যা খোলতাই হবার জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁকে দেখা গেছে রেঁস্তোরায়, নীলুর সাথে। গাড়িতে, নীলুর সাথে। আর অতি অবশ্যই নিজ ল্যাবে, নীলুর সাথে, যখন নীলুকে তিনি খুন করবেন। সেই ল্যাবের বস্তুপিণ্ড/প্রপস অনেক লাউডও ছিল।
আর রইলেন ‘দেবী’ ওরফে রানু। জয়া আহসান, ছবির প্রযোজক। দুই বাংলায় অমিত জনপ্রিয় জয়া ভালো করবেনই, এটা সকলেরই ধারণা বা আশা ছিল। জয়াকে এই চরিত্রে লাগতই বোধহয়, তিনি প্রযোজক না হলেও। মানুষের মাথায় দেবীমূর্তির যে কল্পনা, সেরকম একটা রূপ জয়ার মুখে বছরের পর বছর ধরে আছে। তিনি এই চরিত্রে ‘ন্যাচারাল’ কাস্ট। রানুকে তিনি স্পষ্টতা, সারল্য, (নিজ ‘অসুখ’ বিষয়ে) উৎকণ্ঠাহীন. মমতাময় আবার কিশোরীসুলভ, জড়তাহীন (মিসির আলির সঙ্গে ভয়ডরহীন কথাবার্তা) দিয়ে সাজিয়েছেন। অবশ্যই ভয় পাবার মুহূর্তগুলো বাদে। জয়ার উপস্থিতি বরাবরই নজরকাড়া। এখানেও ব্যতিক্রম নয়।
আদাবর।। ২৪ অক্টোবর ২০১৮