Select Page

দেশের ছবি, দশের ছবি ‘চন্দ্রাবতী কথা’

দেশের ছবি, দশের ছবি ‘চন্দ্রাবতী কথা’

ছবি নির্মাণের স্বপ্ন অনেকের। কিন্তু তা বাস্তব করতে পারেন ক’জন? করোটির তীব্র উত্তেজনায় ঘুম পালায়। যা অগণন প্রহর জাগিয়ে রাখে নিখাঁদ স্বপ্নবাজকে। চিত্রমাধ্যমে গল্প খোঁজার এ নেশা বড় মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ।

শিল্পের আয়েসী মসৃণ পথে না হেঁটে ‘চন্দ্রাবতী কথা’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরীর যাত্রা কারো পা না ফেলা পথে। ছবির আঙিনায় তিনি নবাগত কেউ নন। আশির দশকের শেষ দিক থেকে পরিচিত ফিল্ম অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে। যুক্ত ছিলেন দেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনে আসামান্য ভূমিকা রাখা সংগঠন শর্ট ফিল্ম ফোরামে। একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সিনেমা নিয়ে অধ্যায়ন ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। রক্ষণশীলতার ব্যুহ চূর্ণ করা দেশের প্রথম নারী ভাস্কর নভেরা আহমেদকে নিয়ে ডকুমেন্টরি নির্মাণ করেছেন। তার নির্মিত শর্ট ফিল্ম ‘বিস্মরণের নদী’ সমাদৃত হয়েছে ভিন দেশে আয়োজিত বহু চলচ্চিত্র উৎসবে। এন রাশেদ চৌধুরী বরেণ্য চিত্রকর শহীদ কবিরকে নিয়েও ডকু নির্মাণ করেছেন। ২০১০ সালে তার নির্মিত টিভি ফিকশন ‘আমি শুধু একটি খুন করতে চেয়েছিলাম’ পুরস্কৃত হয়েছে ভিন্নতার কারণে। এসব কীর্তিগুণেই তিনি খেয়ে-পরে খ্যাতি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন। কিন্তু তার বুকে ছিল সিনেমা নিয়ে দূরযাত্রার স্পৃহা। নিজের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণে তিনি ফিরেছেন অনেকের না তাকানো ইতিহাস পর্বে। শুধু ৫২, ৭১ নয়, শত শত বছরের লড়াইয়ে বাঙালির রক্তে পাওয়া ভাষার প্রথম নারী কবি হিসেবে গ্রাহ্য চন্দ্রাবতীকে তিনি আলেখ্য করেছেন।

ষোড়শ শতকের নারী কবি চন্দ্রাবতীর জীবন ও সৃষ্টি ভুলে গেলে বিশ্বাসঘাতকতা হয়। আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম ভাটি বাংলার কিশোরগঞ্জের পাতুয়ারি গ্রামে। তিনি বাংলা ভাষায় রামায়ণ লিখেছেন। তার লেখা মলুয়াগীতি ও দস্যু কেনারামের পালা মুখে মুখে বিস্তৃত হয়েছে জনপদে। তার পিতা দ্বিজ বংশীদাস ভট্টাচার্যও ছিলেন কবি। মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা তিনি। কবি চন্দ্রাবতী কাব্যগুণে সমাদৃত। কিন্তু হৃদয় নিংড়ানো বেদনা তার জীবন জুড়ে। নারী জন্মের এ বেদনা বিধুঁরতা পর্বের জন্যই তিনি ইতিহাসে অম্লান। প্রান্তিক বাংলার মানুষের এখনো অশ্রু ঝরে চন্দ্রা মেয়েটির জন্য।

অনেকেরই জানা চন্দ্রাবতীর দুঃখগাঁথা। খুব অল্পেই আবার তা বর্ণনা করা যায়।

চন্দ্রাবতীর সঙ্গে প্রেম হয় কবি জয়ানন্দের। তখন তাকে সাত পাকে বাঁধার প্রতিজ্ঞা করেন জয়ানন্দ। কিন্তু প্রেম দু’জনার থাকে না। প্রতিশ্রুতি ভেঙে সে বিয়ে করে এক বিধর্মীকে। হৃদয়ভাঙা মেয়ে চন্দ্রা তা মেনে নিতে পারে না। বাবার নির্মিত শিব মন্দিরে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। নিজেকে রাখে ধ্যানস্থ। আর অশ্রুর কালি দিয়ে লিখতে থাকেন বাংলায় রামায়ণ। যে মহাকাব্যে উপেক্ষিত সীতা। চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়ণে সীতা হয়ে ওঠে মূল উপজীব্য। এখানেই শেষ নয় ট্র্যাজিডির। অনুশোচনায় পুড়ে আবার চন্দ্রার কাছে ফিরে আসে জয়ানন্দ। কিন্তু চন্দ্রার ভাঙা মন এতে জোড়া লাগে না। আহত প্রেমিক জয়ানন্দ মন না পেয়ে নিজেই নিজের জীবনের অবসান ঘটান। পরে চন্দ্রাবতী তা জ্ঞাত হন। আবেগ ধরে রাখতে পারেন না তিনি। অন্য জীবনে সমাধান খোঁজেন। প্রেমিকের সঙ্গে পরলোকে চিরমিলনের কামনায় ফুলেশ্বরী নদীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন।

দীনেশচন্দ্র সেন সংগৃহীত ময়মনসিংহ গীতিকার পাতায় পাতায় চন্দ্রা-জয়ার মিলনহীনতা ও মৃত্যুর বিবরণে বাঙালি কাঁদে হু হু করে। মরণ তো সত্য। কিন্তু কে মানতে পারেন এমন চলে যাওয়া? অশ্রু যে অনিবার্য তখন।

এই ষোড়শ শতকের লোকায়ত গল্প নিজের ছবির উপজীব্য করেন এন রাশেদ চৌধুরী। মারমার কাটকাট ফর্মুলায় যে ছবি তৈরির সুযোগ নেই কোনো মননশীল নির্মাতার। শুধুমাত্র চিত্রভাষায় বাংলার নিজস্বী গল্প তুলে ধরার জন্য ‘চন্দ্রাবতী কথা’কে একটি অনবদ্য সৃষ্টি বলতে পারি।

সাত্যকী ব্যানার্জীর সঙ্গীত আয়োজনে অভূতপূর্ব এক মিউজিক্যালও বলতে পারি এ ছবিকে। সিনেমায় একটি বিচ্ছেদী ভাটিয়ালি গান গেয়েছেন রামায়ণ-পালা শিল্পী শংকর। ছবির শুরুতে সুরসঙ্গীত, শেষেও তা। নির্ভেজাল পালা গানে গানে সিনেমার গল্প এগিয়েছে। সব ধর্মের মিলনের সে বাংলা বিশ্বাসযোগ্যতায় চিত্রায়িত হয়েছে ছবিতে। সনাতন ধর্মের বিভিন্ন পর্বের সাথে সেকালের বাংলায় শোকাবহ মুহররম পালনের দৃশ্য আছে। আছে মা ফাতেমার (রা.) বন্দনা। স্বেচ্ছাচারী একনায়কের পেয়াদা, লাঠিয়ালবেষ্টিত শাসন-শোষণপর্ব চিত্রায়িত এতে। কখনো শোষিত উপেক্ষিত, কখনো শক্তিমান নিরাবরণ নারী সমাজের প্রতিলিপি এ ছবি। 

২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর ঢাকার চারটি ও ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামের একটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এ সিনেমা। দেশের বাইরের একাধিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু দেশে বিরাজমান সিনেমা সিন্ডিকেট, পরিবেশক, হল মালিকদিগের নানা মারপ্যাঁচে স্বদেশের শেকড়ে কতটুকু ‘চন্দ্রাবতী কথা’ পৌঁছেছে তা জানা নেই। কথায় কথায় দেশবাসীকে শুনতে হয় হাজার বছরের বাঙালি জাতির ইতিহাসের শাসকীয় বয়ান। জনযুদ্ধকে অস্বীকার করে কেবলই যেন চেতনার সিল মারা এক নেতার এক দেশের একাত্তরই আমাদের সম্বল। শিল্পকলা ও সংস্কৃতি আঙিনা থেকে খবর আসে জনগণের কষ্টের ট্যাক্সের টাকা লুটের। জানা নেই এ দায়হীন ও বিচারহীনতার বাস্তবতায় কী করে হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস প্রতিফলিত হবে?

দায় বোধ করেছেন ‘চন্দ্রাবতী কথা’ ছবির নির্মাতা এন. রাশেদ চৌধুরী ও তার সহযোদ্ধারা। চন্দ্রাবতী চরিত্রে পণ্য বেচাকেনা পেশার মডেল দিলরুবা হোসেন দোয়েল নিজেকে উপস্থাপন করছেন অনন্যতায়। অভিনয়শিল্পী হিসেবে তার গড়ে ওঠার ভবিষ্যৎ গন্তব্যের দিকে চোখ থাকবে অনেকের। সোনাই চরিত্রে কাজী নওশাবা আহমেদ, জয়ানন্দ চরিত্রে এহসান রহমান বর্ষণ ইমতিয়াজ নজর কেড়েছেন। দ্বিজ বংশী দাস ভট্টাচার্য চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় যথারীতি তার শক্তিমান অভিনেতা পরিচয়ের সাক্ষর রেখেছেন। দেওয়ান চরিত্রে গাজী রাকায়েত, কাজী চরিত্রে আরমান পারভেজ মুরাদ ও বিশাখা চরিত্রে জয়িতা মহলানবিশ তাদের মান বজায় রেখেছেন।

ভাটিবাংলার অপরূপ নৈস্বর্গের নদী, হাওর, পাহাড় লেন্সে তুলে আনার জন্য বিশেষ কৃতিত্ব পাবেন ছবির চিত্রগ্রাহক কাশেফ শাহবাজী। ছবি সম্পাদনায় স্থির পটচিত্রের মাধ্যমে গল্পের বয়ানের জন্য সম্পাদক ধন্যবাদ পাবেন। চোখ ফেরালেই মিস হয়ে যাবে এ ছবির অনেক কিছু। শব্দ সম্পাদনায় রতন পাল আবারো নিজের দেশের চলচ্চিত্রের প্রতি তার মমত্ববোধের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন।

এমন পিরিয়ডিক্যাল ছবি এ সময়ে ফ্রেমে ফ্রেমে স্থাপনের জন্য যাবতীয় সাধুবাদ পাবেন দেশখ্যাত চিত্রকর ও শিল্প নির্দেশক তরুণ ঘোষ। লিখনীর দীর্ঘতা এড়াতে হয়তো অনেকের নাম বাদ পড়ে গেল। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। সিনেমা টিম এফোর্ট এটি দর্শক বোঝেন। ‘চন্দ্রাবতী কথা’র প্রতিটি নেপথ্য কর্মী শুভাশীষ পাবেন শিল্পের প্রতি মমত্ববোধের জন্য।

ব্যক্তিগতভাবে চাই, সরকারি অনুদানে নির্মিত এ ছবি দেশের প্রান্তমূলে ছড়িয়ে যাক। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে তার দায় এড়াতে পারে না।

আমরা কেউ ‘চন্দ্রাবতী কথা’ দেখে শুধু শোকে কাঁদব না। চলচ্চিত্র ভাষায় লোকায়ত ছবির অভূতপূর্বতায় দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ে নতুনভাবে গর্ব চলুক বরং। ‘চন্দ্রাবতী কথা’ হোক দেশের ছবি, দশের ছবি।   


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

হাসান শাওন

লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হাসান শাওনের জন্ম, বেড়ে ওঠা রাজধানীর মিরপুরে। পড়াশোনা করেছেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি বাঙলা কলেজ, বাংলাদেশ সিনেমা ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। ২০০৫ সাল থেকে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। কাজ করেছেন সমকাল, বণিক বার্তা, ক্যানভাস ম্যাগাজিন ও আজকের পত্রিকায়। ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর হাসান শাওনের প্রথম বই “হুমায়ূনকে নিয়ে” প্রকাশিত হয়।

মন্তব্য করুন