দেশের সম্পদ রক্ষার শপথ ‘অপারেশন সুন্দরবন’
র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন তথা র্যাবের পৃষ্ঠপোষকতায় অ্যাকশন থ্রিলার ‘অপারেশন সুন্দরবন’ আদতে পূর্ণদৈঘ্য বাংলা সিনেমা নাকি থ্রিলার ঘরানার তথ্যচিত্র (শুধু গানের অংশগুলো বাদ দিলে) সে প্রশ্ন পরিচালক দীপংকর দীপনের প্রতি রেখে আজকের মুভি রিভিউ শুরু করলাম।
পরিচালক হিসেবে অনেক আগেই প্রথম সারিতে নাম লিখিয়েছেন দীপন। তার সফল নাটক বা টেলিফিল্মের সংখ্যা লিখতে হলে রীতিমতো আঙুলে গুনতে হবে। যারা ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দেখেছেন তারা নিঃসন্দেহে জানেন দীপংকর দীপনের ফ্রেম মানেই দুর্দান্ত সব কাজ যা দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিতে বাধ্য।
ক্যামেরার কথা যদি শুরুতে লিখতে হয় তাহলে বলবো, দীপন মোটেও হতাশ করেনি। এক-একটা শটে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যনগ্রোভ বন যেভাবে তুলে ধরেছেন তাতে করে ছবিটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দারুণ প্রশংসিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বাঘের আক্রমণের দৃশ্য, ড্রোনের মাধ্যমে পুরো বনকে ক্যাপচার করা, রাতের দৃশ্য, হরিণের পদচারণা, সাপের ফনা তোলা , বানরের ঘুরে বেড়ানো প্রত্যেকটি বিষয় বেশ ডিটেইল এসেছে। সিনেমা জুড়ে র্যাবের মহড়া এবং শপথ নিয়ে মিশনে নামা এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে; আমার কাছে ‘অপারেশন সুন্দরবন’ অনেকখানি থ্রিলার তথ্যচিত্র হিসেবে ধরা দিয়েছে।
সুন্দরবনে জলদস্যুর বিরুদ্ধে র্যাবের দুঃসাহসিক অভিযান নিয়ে গল্প সাজিয়েছেন দীপংকর দীপন, বাংলাদেশের প্রথম ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাকশন থ্রিলার হিসেবে সত্যি প্রশংসার দাবী রাখে। মাঝিদের জীবন সংগ্রাম ছাড়া বাকি সব চরিত্র ছাড়া ছাড়া, দর্শককে বুঝে নিতে হয়েছে সম্পর্কগুলো আসলে কী। একেক জায়গা থেকে একেকটি চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে, তাই দর্শকের আসনে বসে মনে মনে গল্পটা আন্দাজ করতে হয়েছে।
প্রশাসনের কাজের সফলতা নিয়ে অনেক দেশেই দারুণ সব সিনেমা তৈরি হয়েছে। তবে আমার চোখে বাংলাদেশে ‘অপারেশন সুন্দরবন’ প্রথম সিনেমা বা প্রামাণ্যচিত্র যা কি-না রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তথ্যচিত্রগুলোতে আরো একটি বাড়তি ফাইল সংযুক্ত হলো। সেদিক থেকে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার দীপংকর দীপন সাধুবাদ পাবার যোগ্য। অমন একটি গা ছমছমে জায়গায় এত বড় টিম নিয়ে শুটিং করা চাট্টিখানি কথা না, যারা সুন্দরবনের ভেতরে পা রেখেছেন তারা জানেন ভেতরে কী গহীন অরণ্য আর সবগুলো হাঁটার পথই প্রায় এক রকম।
সিনেমাতে তারকা অভিনেতাদের অভাব ছিল না, তার মধ্যে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন জিয়াউল রোশন, পুরো ছবিতে তাকে সত্যিকার অর্থেই আর্মি অফিসার বা কমান্ডার লেগেছে। একজন কমান্ডারের শারীরিক গঠন, কণ্ঠের ওঠা-নামা যেভাবে হওয়া উচিৎ রোশনের আছে পুরোটাই, পাশাপাশি রোমান্টিক দৃশ্যেও দর্শনার সাথে দারূন রসায়ন হয়েছে। মিষ্টি মেয়ে দর্শনা বণিক গ্রামের চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন সাবলীল।
খুব বিরক্ত হয়েছি সিয়াম আহমেদকে দেখে। এত অতি অভিনয়, অভিব্যাক্তিতে কোথাও সেনা কর্মকর্তা মনে হয়নি। আর বাংলা সিনেমার সেই একই নিয়ম থেকে দীপন বাদ যাননি; বাঘ গবেষণা করতে বিলেত থেকে আসা বাংলাদেশি মেয়ে তানিয়া চরিত্রে নুসরাত ফারিয়াকে কেবলই প্রেমিকা করে রাখলেন। সে কোন এনজিও থেকে এসেছে বা তার মূল কাজ কী সেটা দেখানোর চাইতে প্রেমের সম্পর্ক দেখানোতে ব্যস্ত রাখা হয়েছে। থ্রিলার মুভিতে নারী চরিত্র আরো বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করলে আধুনিক দর্শক খুব প্রশংসা করতো, মেয়েদের ন্যাকান্যাকা কথা আর ফুল মেকআপ নিয়ে জঙ্গলে ঘোরাটা কেউ আজকাল আর হজম করতে পারে না।
সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিল পাপড়ি। তুষা চক্রবর্তী দেহ ব্যবসায়ী চরিত্রে মগজ দিয়ে যে অনেক কিছু করা সম্ভব তা প্রমাণ করেছেন। চিত্রনাট্যকার এখানে বাহবা পেতে পারেন, পাপড়িকে দিয়ে কেবল দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত না দেখিয়ে চরিত্রকে যথার্থ কাজে লাগিয়েছেন। আরমান পারভেজ মুরাদ নেতিবাচক চরিত্রে আগেও সফল ছিলেন, এই সিনেমাতে ধারাবাহিকতা রেখেছেন। রাইসুল ইসলাম আসাদ অনেক দিন পর ক্যামেরার সামনে এসে বুঝিয়ে দিলেন জাত অভিনেতার কোন মৃত্যূ নেই। আর রিয়াজ আহমেদ আর্মির সিইও হিসেবে সেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি।
সাংবাদিক চরিত্রে রওনক হাসান অনবদ্য, মাথায় যখন শক দেওয়া হয় তার অভিব্যক্তি দর্শকদের যথেষ্ট স্পর্শ করে। এহসানুর রহমান সত্যিকার অর্থেই যাকে ডাকাত মনে হয়েছে। মনা ডাকাত যে কি-না বছরের পর বছর অসহায় জেলেদের ধরে অমানুষিক নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করছে পরিবারের কাছ থেকে তার চেহারা অনেক ভয়ংকর হবে ধারণা করেছিলাম আমরা। কিন্তু হতাশ করে সাধারণ চেহারায় পর্দায় আবির্ভূত হলেন শতাব্দী ওয়াদুদ, ডাকাতের চিহ্নমাত্র তার চোখে-মুখে কোথাও নেই। শুধুমাত্র মনোজ প্রমাণিকের চরিত্রে গতি ছিল। এ চরিত্রে শুরু আছে এবং শেষটাও সম্পূর্ণ, মনোজ ভালো কাজ করেছেন।
সব শেষে আমার অনেক পছন্দের তাসকিন রহমান; তিনি কেন এমন গতানুগতিক চরিত্রে কাজ করছেন সে ব্যাপারে একটু মন খারাপ রেখে গেলাম। একজন পোক্ত অভিনেতা হতে হলে সিনেমা বুঝে চরিত্র নির্ধারণ করতে হবে।
শুরুতেই লিখেছি, ‘অপারেশন সুন্দরবন’ আমার কাছে থ্রিলার তথ্যচিত্র লেগেছে। তাই এখানে প্রেমের দৃশ্য বা গানের কথাগুলো কোনটাই আমাকে ছুঁয়ে যায়নি, আমি কেবল আসল হোতাকে খুঁজছিলাম– কে সেই লোক যে কি-না এত সুন্দর একটা বনের ভেতর এমন অত্যাচার করছে! বারবার আমার চোখ আটকে যাচ্ছিল র্যাব অফিসারদের পোশাকের দিকে, এমন ভয়ংকর চ্যালেঞ্জিং একটা মূহূর্তে এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাপড়ে বনের ভেতর! কীভাবে সম্ভব! নুসরাত ফারিয়ার মেকআপ-ড্রেস এতটাই টিপটপ ছিল যে; তারা বনের ভেতর ঝড়ের মধ্যে আটকে আছে এটা পরিচালক এসে কানের কাছে বলে না দিলে বোঝা সম্ভব নয়। তাদের ওপর গুলি চালালো ডাকাত তাও কোন কিছু অগোছালো হলো না, ব্যাপারটা অদ্ভূত। শুধু রিপোর্টার আর জেলেদের পোশাক দেখে এবং সাগরের পানি দেখে বুঝতে পেরেছি পুরো সিনেমার শ্যূট গহীন জঙ্গলে হয়েছে। কিন্তু আর কাউকে দেখে বোঝার কোন উপায় ছিল না যদি না সুন্দরবন আমাদের দেখা থাকতো।
পরিশেষে ‘অপারেশন সুন্দরবন’ বাংলা সিনেমাপ্রেমীদের হয়তো দুর্দান্ত কিছু মুহূর্ত উপহার দিতে পারবে না, তবে যথেষ্ট বার্তা দিতে পেরেছে। শত্রুর আগ্রাসন থেকে নিজের দেশকে রক্ষা করতে চাওয়ার যে আকুতি কাজ করে সেই উপলব্ধি নিয়ে ফিরতে পারবেন সিনেমা হল থেকে। তাই সন্তানদের হলে নিয়ে সিনেমাটা দেখান। তাদের ভেতর দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগানোর দারুণ একটা সুযোগ এটাই।