নতুন মুখ ও বিজ্ঞাপনী চমকের নজির ‘অবুঝ দুটি মন’
প্রযোজক, পরিচালক ও প্রদর্শক মোহাম্মদ হোসেনের চলচ্চিত্র মানেই অন্যকিছু, বিশেষ করে বিশাল ক্যানভাস আর প্রচারণায় তার জুড়ি মেলা ভার। তেমনি একটি চলচ্চিত্র ছিল ‘অবুঝ দুটি মন-Innocent Love’, মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৩ সালের ১ অক্টোবর। অভিনয়ে ছিলেন ১৯৯০ সালে আয়োজিত এফডিসির নতুন মুখের সন্ধান প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া স্মার্ট হিরো আমিন খান, নায়িকা ছিলেন মডেল রথি; চলচ্চিত্রের নাম চাঁদনী, তার আরেকটি পরিচয় ছিল— জনপ্রিয় গায়ক জেমসের স্ত্রী!
নতুন মুখে নির্বাচন হয়েও প্রায় তিন বছর পর আমিন খান সুযোগ পান ‘অবুঝ দুটি মন’। আমার যদি ভুল না হয় ছবিটি দুটি ব্যাপারে বেশ আলোচনায় আসে— বিজ্ঞাপন বা প্রচারণা আর বিশাল আকারের পোস্টার নিয়ে। বলতে গেলে তখনকার সময়ের এমন কোন পত্রিকা নেই যেখানে ছবিটির বিজ্ঞাপন যায়নি, ইত্তেফাকের সিনেমা পাতাতে তো থাকতোই, এ ছাড়া সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক যেকোনো ম্যাগাজিনে কালারফুল বিজ্ঞাপন ছিলই ছিল। তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালীর বিশাল পাতার বিজ্ঞাপনটি অনেকে সংগ্রহ করে রাখেন। একটা সময় বাংলাদেশ বেতারের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনেকটা সময় জুড়ে বাংলা ছবির দশ-পনেরো মিনিটের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো; সেখানে ছবিটির বিজ্ঞাপনও প্রচার কতো ধারাবাহিক আকারে।
অবশ্য এর আগে প্রয়াত আজমল হুদা মিঠুর প্রযোজনা ও পরিচালনায় ‘চোর ডাকাত পুলিশ’ ছবির একটি বড় পোস্টার করা হয়েছিল। কিন্তু ‘অবুঝ দুটি মন’-এর ছবিটির পোস্টার ছিল আরও বড়। মূলত সেখান থেকেই শুরু হয় ছবির প্রচারে বড় বড় পোস্টারের ব্যবহার। এমনও দেখা গেছে বিভিন্ন হলের নির্ধারিত পোস্টার লাগানোর জায়গাকে আরেকটু বাড়িয়ে নিতে হয়েছে।
যাই হোক… আমাদের মধুর সময়ে ইত্তেফাকের বিজ্ঞাপন সঙ্গে ম্যাগাজিনের শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা রঙিন পোস্টার আর রেডিওর মন মাতানো দশ মিনিটের বিজ্ঞাপনের কল্যাণে ‘অবুঝ দুটি মন’ তখন বহু সিনেপ্রেমিদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে।
অবশেষে অপেক্ষা শেষ হলো রাজশাহীর উপহার হলে ফার্স্ট ডে’র ফার্স্ট শো দেখে। পরে আরও কয়েকবার দেখেছিলাম একই হলে। ছবিটি দেখার প্রধান আগ্রহ ছিল আমিন খান ও চাঁদনীর জন্য; বিশেষ করে প্রায় ছয় ফুট লম্বা সুর্দশন আমিন খানকে নিয়ে তখনকার পত্রিকায় লেখালেখি আর আলোচনা বিশেষ এক আগ্রহ তৈরি করেছিল। এদিকে তখন বাংলা চলচ্চিত্র সদ্য তরুণ দর্শকদের মনে ঝড় তোলা ‘চাঁদনী’র মাধ্যমে আলোচনায় আসা নাঈম-শাবনাজ জ্বরে আক্রান্ত, যারা সিনিয়র তারকাদের ভিড়ে হঠাৎ ঢাকাই চলচ্চিত্রের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তাই আরেকটি মোড় ঘোরানো ও ঝড় তোলা জুটি দেখতেই আমার আগ্রহ ছিল চরম। হতাশ করেননি আমিন খান-চাঁদনী। অনেকের মনে প্রথম ছবি দিয়েই জায়গা করে নিয়ে ছিলেন তারা।
ছবিটি দেখে বারবার মনে হয়েছিল, এই নায়ক বহু দিন টিকবে, তার সেই প্রতিভা আছে। ধারণা যে ভুল ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া গেল ছবিটির বড় সাফল্যের পরে আমিনের হাতে একের পর এক ছবি আসাতে, অবশ্য কোন এক অজানা কারণে দারুণ চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চাঁদনীকে আর চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি!
ছবির গল্প আহামরি নয়! হিন্দু ও মুসলিম দুটি তরুণ মনের প্রেম-ভালোবাসা আর সমাজিক মান-মর্যাদার কঠিন চিত্ররূপই ছিল ‘অবুঝ দুটি ম’। তবে উপস্থাপনা-সুমধুর সব কটি গান আর চমৎকার লোকেশন ছবিটিকে দিয়েছিল ভিন্ন মাত্রা। বিশেষ করে ঝড়ের মধ্যে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে নায়ক-নায়িকা যখন দ্বীপে আশ্রয় পায়, সেই লোকেশন ও দৃশ্যগুলো দারুণ মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল!
আরেকটি ব্যাপারে না বললেই নয়। ‘আমি মাইকেল জ্যাকসন, আমি রূপসী ম্যাডোনা’ গানটির সেট ও বিশাল আয়োজন দারুণভাবে আলোচনায় এসেছিল। গানটির কথায় বিশ্বের বড় বড় তারকাদের নাম থাকায় আর তাদের বাস্তবে তুলে ধরার লক্ষ্যে মূর্তির আদলে উপস্থাপনা—.আসলেই দেখার মতো ছিল।
স্বর্গ হতে এই জগতে তুমি এসেছো আমি এসেছি, আমি মাইকেল জ্যাকসন আমি রূপসী ম্যাডোনা, ট্রেনের দরজা খোলো না রেড সিগন্যাল তোলো না, যারা প্রেম করেছে জীবনে তো ভয় করেনি’সহ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের করা সব কটি গানই ছিল তুমুল জনপ্রিয়।