নব্বই দশকের গানে অবিস্মরণীয় জুটি আইয়ুব বাচ্চু-জুয়েল
রতনে রতন চেনে— বাংলা সংগীত প্রবাদটির যথাযথ ও বাস্তব উদাহরণ হলো ‘আইয়ুব বাচ্চু-জুয়েল’ । এক সময় বাচ্চু ভাই ও জুয়েল ভাই দুজনের জুটিটা এত বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, আমার মতো অনেক নাদান শ্রোতারা জুয়েলকে ভেবেছিল বাচ্চু ভাইয়ের আপন ছোট ভাই।
বাংলা আধুনিক সংগীতের ৯০ দশকের একটি সেরা ও অসাধারণ প্রাপ্তি ‘জুয়েল’ নামের একজন কণ্ঠশিল্পী। যিনি ৮০র দশকের অকাল প্রয়াত জনপ্রিয় ‘জুয়েল’-এর স্থান দখল করে নেন।
বাংলা আধুনিক সংগীতে দুঃখ বিরহের মেলোডি গানের অসাধারণ এ কণ্ঠধারীর পুরো নাম হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল। ব্যান্ড সংগীতের কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চুর কাছে যেমন বাংলা সংগীত চিরঋণী হয়ে থাকবে, তেমনি জুয়েলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও তার অবস্থান তৈরিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য আধুনিক ও ব্যান্ড সংগীত চিরকাল আইয়ুব বাচ্চুর কাছে ঋণী হয়ে থাকবে।
বাচ্চু যদি নিজের ব্যস্ত ও দুর্দান্ত সময়ের মাঝে তরুণ কণ্ঠশিল্পীর জন্য সময় না দিতেন, সমর্থন না দিতেন তাহলে হয়তো জুয়েলকে পুরোপুরি চিনতে পারতাম না।
সেই ৯১ থেকে প্রথম অ্যালবাম ‘কুয়াশা প্রহর’ শুরু করে একটানা ‘দেখা হবে না ‘ অ্যালবাম পর্যন্ত আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন তার ছায়াসঙ্গী। নব্বই দশকে প্রকাশিত ‘কুয়াশা প্রহর’ থেকে ‘দেখা হবে না’ ৫টি যেন ৫ টি বিরহগাঁথার এক মহাকাব্য। সুর ও সংগীত পরিচালনায় ছিলেন সেই সময়ের মহাব্যস্ত তারকা আইয়ুব বাচ্চু। তারা হয়ে যান সুপার জুটি।
পরবর্তীতে প্রণব ঘোষের সুর-সংগীতে একাধিক সলো অ্যালবাম প্রকাশিত হয় জুয়েলের। এর মাঝে আইয়ুব বাচ্চুর সুর ও সংগীতে জুয়েলের ‘বেশি কিছু নয়’ প্রকাশ হয়। এ অ্যালবামও শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল।
জুয়েল-বাচ্চু জুটির ৪র্থ অ্যালবাম ‘একটা মানুষ’ বের হয় ১৯৯৬ সালে। শিরোনাম যেমন গানগুলোও তেমন। সবগুলো গান যেন কোন অজানা-অচেনা একটি মানুষের জীবন থেকে নেওয়া ১২টি স্মৃতির ১২ টুকরো ছবি ও ১২টি গল্প। অসাধারণ এই অ্যালবামের জনপ্রিয় গান হলো— কেন জানি, ফুলগুলো তোমারই থাক, নতুন পুরনো দুঃখ আমার, একটা মানুষ, কথা ছিল তুমি আসবে, সাধ করে বাধলাম আমি , এত গল্প নয় কবিতা নয় , ঘরে ফেরা এবং অচিন পাখি। এক-একটি গান যেন একটি গল্প হয়ে হৃদয়ে গেঁথে যায়। এই অ্যালবামটিও আগের তিনটি অ্যালবাম এর মতো শ্রোতাদের মনে খোরাক মেটাতে সমর্থ হয়।
আইয়ুব বাচ্চুর নিজের কণ্ঠের গানগুলো ছাড়াও বাংলা গানে যদি অসাধারণ ও সেরা গানের তালিকা করতে হয় তাহলে ওপরের উল্লেখিত ৫টি অ্যালবাম রাখতেই হবে।
অ্যালবামগুলো মেজাজের কারণে আলাদা। ৫টি অ্যালবামে যেন খুব চেনা ও দুরন্ত আইয়ুব বাচ্চু খুব অচেনা শান্ত একজন মানুষ। তার সুরে বহু শিল্পী গান গেয়েছেন, জনপ্রিয় হয়েছেন কিন্তু জুয়েল এর মতো ভাগ্যবান আর একজনও নন। কারণ বাচ্চুর সেরা কাজের বিশাল একটা অংশ জুড়ে শুধুই তার গানগুলো।
জুয়েল গানের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো মানসম্পন্ন গীতিকারদের অসাধারণ ও অগতানুগতিক কথা। তার অ্যালবামে নিয়মিত থাকতেন বাপ্পী খান, নিয়াজ আহমেদ অংশু, সৈয়দ আওলাদ, খোশনূর আলমগীর, মাসুম রেজা, মাস মাসুম, যায়েদ আমীন, জুলফিকার রাসেলের মতো জনপ্রিয় গীতিকাররা।
আমরা যারা সেই ৯০ দশক থেকে গান শুনে আসছি তারা আজও জুয়েলের সবগুলো অ্যালবাম সযত্নে রেখে দিয়েছেন ও চিরদিনের প্রিয় গানের তালিকায় রেখে দিয়েছেন। এ জুটির গানগুলো আবাল-বৃদ্ধ, বনিতা সব সব বয়সের সব যুগের শ্রোতাদের ভালো লাগবেই এবং বারবার শুনতে ইচ্ছে করবে।
বলতে গেলে, ৯০ দশকের আধুনিক গানে একমাত্র জুয়েলই ছিলেন সস্তা কথার সস্তা সুরের গানবিহীন একমাত্র ভরসা। তার গানগুলো ৯০ দশকের গানের ভান্ডারের এক অমূল্য সম্পদ।
এই জুটির কিছু গান— আবার নতুন করে, দৃষ্টিহীনের কাছে, মধ্যরাতের চিঠি, নতুন পুরনো, পাতা ঝরা সেই বিকেলে, কোথায় রাখো আমাকে, ছোট্ট একটা ঢেউ, দিন কেটে যায়, ফুলগুলো তোমারই থাক, কথা ছিল তুমি আসবে, তুমি গেছো চলে, সবুজ মৌনতা, নীরবে চেয়ে দেখেছি, দুটি মন দুটি প্রাণ, কেন জানি কোনো দিন আমাকে, এই গল্প তোমাকে, দেখা হবে না এবং ফেরানো গেল না।