‘নিখোঁজ’ দিয়েই নতুন করে খোঁজ মিললো মিমির
নব্বই দশকে টিভি অভিনেত্রী হিসেবে যে কয়টি নাম জনপ্রিয়তা ও আলোচনার দিক থেকে প্রথম সারিতে থাকবে তাদের অন্যতম আফসানা মিমি। মিষ্টি হাসির লাবণ্যময়ী মেয়েটির অভিনয় দক্ষতা ও সহজাত সৌন্দর্য মুগ্ধ করেনি ওই সময়ের এমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
মঞ্চ এবং টেলিভিশনের সেই জনপ্রিয় অভিনেত্রী চলচ্চিত্র মাধ্যমেও নিজের দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন; তবে সেটা খুবই সামান্য। এরপর পরিচালকের আসনে বসে নিজেকে নিয়ে যান এক অন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশে মেগা সিরিয়ালের যাত্রা শুরু আফসানা মিমির হাত ধরেই। তারপর আস্তে আস্তে অভিনয় থেকে দূরে সরে যাওয়া এই গুণী অভিনেত্রীকে দেখা যায় মাঝে-মধ্যে বিশেষ দিবস উপলক্ষে বা তার মনমতো চরিত্রের দেখা মিললে। গত বছর পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে, সেই ব্যস্ততা তো আছেই।
তবে ভক্তদের জন্য খুশির খবর হলো বিনোদনের নতুন মাধ্যম ওটিটিতে যাত্রা শুরু করেছেন মিমি। ‘নিখোঁজ’ নামের ছয় অ্যাপিসোডের ওয়েব সিরিজ দিয়েই এই মাধ্যমে পথচলা শুরু তার।
আফসানা মিমির শুরুটা মঞ্চ দিয়ে। ১৯৮৬ সালে ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠীর হয়ে প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন মনোজ মিত্রের ‘রাজদর্শন’ নাটকের রানি চরিত্রে। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রয়াত সৈয়দ মহিদুল ইসলাম। একই নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য গাজী রাকায়েতের মাধ্যমে পরবর্তীকালে তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হন। নাগরিকের হয়ে প্রথম মঞ্চে উঠেছিলেন শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ অবলম্বনে আলী যাকের রচনা ও নির্দেশনায় ‘দর্পণ’ নাটকের কোরাস দলের একজন হয়ে। পরে অভিনয় করেন ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’, ‘দর্পণে শরৎশশী’, ‘ঈর্ষা’ প্রভৃতি নাটকে।
টেলিভিশনের পর্দায় মিমির মিষ্টিমুখটি সবার প্রথমে দেখা যায় বিজ্ঞাপনচিত্রে। ‘পেপস জেল’ টুথপেস্টটি এখন বাজারে না দেখা গেলেও নব্বইয়ের দশকে এই একটি বিজ্ঞাপন করেই পেয়ে যান ব্যাপক পরিচিতি। প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘জিরো পয়েন্ট’ নাটকের মাধ্যমে ছোটপর্দায় প্রথম অভিনয় করেন। এ নাটকে তার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন আমজাদ হোসেন। তিনি তার ‘বউ কথা কও’ নাটকে আফসানা মিমিকে প্রধান চরিত্রে কাস্ট করেন। এটাকে আফসানা মিমি ছোটপর্দায় তার অভিনয়ের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন। তবে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করেই তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি নিজেই। যার শুরুটি ছিল ‘কোথাও কেউ নাই’ দিয়ে।
এরপর নক্ষত্রের রাত, বন্ধন, সবুজ সাথী, বউ কথা কও, এবং বনলতা সেন, বিবর্ণ ভালোবাসা, ঝিনুক নীরবে সহো, বেদনার রং নীল, শেষ চিঠির পরে, নাটের গুরু, অন্তরায়, অফবিট, অতিক্রম, বোকাট্টা, ভালোবাসার তিন বেলা ইত্যাদি। ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘সবুজ সাথী’ নাটকে তার অভিনয় দক্ষতার আবেদন এখনো অটুট।
১৯৯২ সালে আজিজুর রহমানের ‘দিল’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক হয় মিমির। বাণিজ্যিক সিনেমায় নায়িকা হিসেবে তার উপস্থিতি আলোচনায় আসলেও এরপরে বেশ কিছু ভিন্নধর্মী সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় করে প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। তার মধ্যে ‘নদীর নাম মধুমতি’ ও ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ ‘কাজলের দিনরাত্রি’ ‘প্রিয়তমেষু’ উল্লেখযোগ্য। তবে প্রায় এক দশকের বিরতি শেষে গুণী নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘পাপ-পুণ্য’ চলচ্চিত্রে সামনে আবারও তাকে দেখা যাবে।
নব্বইয়ের দশকের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী আফসানা মিমি ২০০০ সালে ধারাবাহিক নাটক ‘বন্ধন’ দিয়ে পরিচালনায় আসেন। টেরেস্ট্রিয়াল একুশে টিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিকটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেসময়। এই নাটকটি মিডিয়ায় তৈরি করে দীর্ঘ ধারাবাহিক নির্মাণের ট্রেন্ড। আফসানা মিমি এরপর একে একে নির্মাণ করেন দীর্ঘ ধারাবাহিক ‘গৃহগল্প’, ‘সাড়ে তিনতলা’, ‘কাছের মানুষ’ ও ‘ডলস হাউস’-এর মতো বেশকিছু ফিকশন।
তবে এতো কিছুর মাঝেও তার ভক্ত এবং সাধারণ দর্শকদের আক্ষেপ বা হতাশা ছিলো যে অভিনেত্রী আফসানা মিমির সেলুলয়েডে দেখা না পাওয়া নিয়ে। বিশেষ দিবসে মাঝেমধ্যে দুই একটি নাটকে অভিনয় করেছেন তবে তা সংখ্যার দিক দিয়ে খুবই কম। নব্বই দশকের বিনোদনের ধরনের পরিবর্তন এসেছে একবিংশ শতাব্দীতে। চলচ্চিত্র, টেলিভিশনের পাশাপাশি এখন বিনোদনের নতুন মাধ্যম হলো ওটিটি। এই ওয়েব সংস্কৃতির যুগে একটু দেরিতে হলেও দেখা দিলেন তিনি ‘নিখোঁজ’ নামক ওয়েব সিরিজের মধ্য দিয়ে।
নব্বই দশকেই একদিন হঠাৎ করে উধাও হয়ে যান একজন ভদ্রলোক। স্ত্রী, কন্যা এবং পুত্র তাকে খুঁজে খুঁজে নাজেহাল কিন্তু কোথাও খোঁজ পান না তারা তাদের পরিবারের প্রধান মানুষটির। তারপর সময়ের নিয়মে দিন যায়, মাস যায়, যায় অনেকগুলো বছর। প্রায় দুই দশক পরে হঠাৎ করেই নিজের হারিয়ে যাওয়া বাবাকে নিয়ে কিছু ঘটনা সামনে আসলে বাবা হারানো সেই কিশোরী মেয়ে যে কিনা এখন এক মধ্যবয়সী নারী সেই নারীর চরিত্রে আফসানা মিমির অভিনয় এই সিরিজটিকে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে নিঃসন্দেহে।
সাধাসিধে শাড়িতে মধ্যবয়সী নারীর লুকে এবং বডি ল্যাংগুয়েজ হোক বা ডায়ালগ ডেলিভারি অথবা এক্সপ্রেশন আফসানা মিমি প্রমাণ করেছেন তিনি ফুরিয়ে যাননি। এখনো বয়স এবং ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই গল্প এবং চরিত্রে সুযোগ পেলে নিজের সেরাটাই দিতে সক্ষম এই গুণী শিল্পী। সঙ্গে আছেন শ্যামল মাওলা, দীপান্বিতা মার্টিন বা ইন্তেখাব দিনার অথবা খায়রুল বাসারের মতো নিয়মিত অভিনেতারা। নির্মাণ বা গল্প বলার কৌশল, কারিগরিসহ অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও মিমি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন নতুন সময়ের এই কাজের ধরনের সঙ্গে। যা মিমিকে নতুন মাধ্যমে নতুনভাবে পাওয়ার আশা বাঁচিয়ে রাখলো। সামনের দিনে আফসানা মিমি এবং তার সমসাময়িক শিল্পীদের নিয়ে ভিন্নধর্মী কনটেন্ট ও ব্যতিক্রমী চরিত্রে উপস্থাপনের বিষয়টি নতুন করে আমাদের গল্পকার এবং নির্মাতারা নতুন করে ভাববেন এটাই কামনা।