Select Page

মাতৃভক্তির মাস্টারপিস

মাতৃভক্তির মাস্টারপিস

আম্মাজান
পরিচালক – কাজী হায়াৎ
শ্রেষ্ঠাংশে – মান্না, মৌসুমী, আমিন খান, শবনম, জ্যাকি আলমগীর, দারাশিকো, ডিপজল, মিজু আহমেদ প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান – আম্মাজান আম্মাজান, স্বামী আর স্ত্রী বানায় যে জন মিস্ত্রী, তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়।
মুক্তি – ২৫ জুন ১৯৯৯

নায়ক মান্না আর কাজী হায়াৎ ছিল কমপ্লিট প্যাকেজ। ঢালিউডে যত নায়ক-পরিচালক রসায়ন আছে তার মধ্যে অন্যতম সেরা তারা। এ জুটির রাজনৈতিক ছবির সংখ্যা বেশি কিন্তু ফ্যামিলি ড্রামার উপর ‘আম্মাজান’ ছবিটি মাস্টারপিস হয়ে আছে। একটা ছেলের মাতৃভক্তির অসামান্য নিদর্শনের ছবি।

ছবির পেছনের গল্পটা একটু জটিলই ছিল। একটা সময় ইন্ডাস্ট্রিতে মান্না ও ডিপজল দ্বন্দ্ব ছিল। দ্বন্দ্বের জন্য এ ছবির প্রযোজক ডিপজল প্রথমত মান্নাকে কাস্ট করতে চায়নি। ডিপজলের ভাবনায় ছিল রুবেল। কিন্তু কাজী হায়াতের এক কথা এ চরিত্রের জন্য মান্না ছাড়া কাউকে তিনি নেবেন না। কাজী হায়াৎ মান্নাকে জানায় সমস্যাটা তখন মান্না ডিপজলের বাড়িতে গিয়ে তার সাথে কথা বলে। সেদিনই ডিপজল জানিয়ে দেয় মান্নাই চূড়ান্ত।

‘আম্মাজান’ চরিত্রে নাম ভূমিকায় শবনম। কিংবদন্তি এ অভিনেত্রীও মান্নার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করাকে তার অন্যতম অর্জন মনে করতেন। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন-‘আমার মা চরিত্রের জন্ম সার্থক হয়েছে মান্নার আম্মাজান হবার পর।’ বোঝাই যাচ্ছে ছবিটির পেছনে অম্লমধুর গল্প লুকিয়ে আছে।

ছবির নামকরণেও একটা শ্রদ্ধা বা ভক্তিমূলক ব্যাপার আছে। ‘আম্মা’ বলতে ‘মা’ বোঝায় তার সাথে ‘জান’ যুক্ত করে ভক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন – আব্বাজান, বাপজান এরকম প্রচলিত আছে।

ছবির গল্পে মান্নার মা শবনমকে ছোটবেলায় অফিসের বড়কর্তা দারাশিকো অসম্মান করে। শবনম ছেলেকে দোষী ভাবে ভুল বোঝে, সে ভুল ভাঙে না। তাই ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। মান্না তার আম্মাজানের সাথে কথা বলে কিন্তু আম্মাজান বলে না। তারপরেও মায়ের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। মায়ের মুখের কথা তার কাছে আইনের মতো, পালন করতেই হবে। শবনম ও মান্না ছবির কেন্দ্রীয় গল্পের অংশ। মান্নার নাম থাকে বাদশা।

মান্না-র চরিত্রটিকে কাজী হায়াৎ ঢেলে সাজিয়েছেন। আম্মাজান শবনমের সাথে যে অন্যায় হয়েছে সমাজে সেসব অন্যায় মান্না সহ্য করতে পারে না। নিজে শাস্তি দেয়। তাই অসহায় মানুষ যারা দুর্নীতির শিকার, অবিচারের শিকার তাদের পাশে থাকে এবং অপরাধীদের শাস্তি দেয়। তার এসব কর্মকান্ডের বিশ্লেষণ পয়েন্ট করে বলা যায় –

১. সাইকো অ্যাকটিং
কাজী হায়াৎ খুব সূক্ষ্মভাবে মান্নার চরিত্রটিকে পোট্রে করেছেন সাইকো বৈশিষ্ট্য দিয়ে। সাইকো বলতে অনেকে পাগল ভাববে কিন্তু এটার একটা বিশেষত্ব তুলে ধরা হয়েছে মান্নাকে দিয়ে। আম্মাজানের যে কোনো আদেশ তার কাছে শিরোধার্য। আদেশ পালন করার জন্য তার ব্যস্ততার ব্যাপারটাকে সাইকো করে তুলে ধরা হয়েছে অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে।

২. সিচুয়েশন তৈরি করা
ভয়ঙ্কর সিচুয়েশন তৈরি করা হয়েছে মান্নাকে দিয়ে। যেমন – ধর্ষণকারীকে হত্যা করে তারই জানাজা করার জন্য নিজেই যায় মান্না।

৩. ডায়লগ বেসিস অ্যাকশন
‘এই যে নারী নির্যাতন, এই যে এই কলঙ্কটা এইটা নিয়া কেউ বাঁইচা থাকতে চায় না। ভালো করছে মইরা গিয়া ভালো করছে’ – মান্না এই ডায়লগ দেয় ধর্ষণের শিকার হওয়া একটা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে। মেয়েটি আত্মহত্যা করে। তার লাশের সামনে মা-বাবার আহাজারি দেখে মান্না এসব রিয়েলিস্টিক ডায়লগ দেয়।

– কালাম, আয় দোস্ত, আমি খুন করছি।
– তুই?
– হ দোস্ত, কিছু কওয়ার থাকলে পরে কইস। বেশিক্ষণ রাখলে মুর্দার কষ্ট হয়।
এই কালাম, কলেমা শাহাদাত পড়তো।
ধর্ষণকারীকে মেরে তারই জানাজায় গিয়ে ডিপজলের সাথে মান্নার ডায়লগ বিনিময় হয় এভাবেই। কোনো ফাইট বা ভায়োলেন্স ছাড়াই শুধুমাত্র ডায়লগ ডেলিভারির মাধ্যমে দুর্দান্ত অ্যাকশন দেখানো হয়।
– আপনি তো অনেক লোকের হাত দেখেন। আপনার হাতটা দেখে কনতো এখন থেকে দুই মিনিটের মধ্যে আপনার জীবনে বিরাট কোনো ফাঁড়া আছে কিনা
– কি কন বাবা!, আপনার কথাবার্তা তো আমি বুঝতে পারতেছি না
– বাইশ বছর আগে আপনি যেখানে চাকরি করতেন সেইসময় আপনার উপর যে শনির গ্রহটা আঁচড় করছিলো সেইটা এখন কোন জায়গায় অবস্থান করতেছে দেখেন তো। বাইশ বছর আগের শনির গ্রহটা আপনার সামনে কিনা দেখেন তো।
আম্মাজান শবনমের উপর হওয়া নির্যাতনে অফিসের বড়কর্তার কেরানি পরে ভোল পাল্টে জ্যোতিষী হয়ে যায়। সেই জ্যোতিষীকে মারতে মান্না যায়। মারার সময় এই ডায়লগগুলোর ব্যবহার ছিল মারাত্মক।
প্রশাসনিক দুর্নীতিতে পুলিশের রাজনীতি বিষয়ক অজুহাতের সময় মান্না বলে-‘এদেশে রাজনীতি নামে অনেক বড় একটা গাধা আছে। আপনারা সমস্ত অপকর্ম তার ঘাড়ে চাপায়া খালাস হইয়া যান।’ সেই লেভেলের স্যাটায়ার ছিল।

৪. স্ল্যাং
স্ল্যাংকে লজিক্যালি তুলে ধরেছেন কাজী হায়াৎ। মান্না যখন জ্যোতিষীকে মারে মুখ চেপে সেখানে স্ল্যাং-এর ব্যবহার ছিল। তখন তাঁর অ্যাঙ্গার এক্সপ্রেশন জাস্ট অ্যামেজিং।

ছবিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সংলাপ-‘আম্মাজান কইছে।’ রিপিটেশন ছিল মাতৃভক্তির প্রকাশ হিসেবে। জ্যাকি আলমগীর নবাব চরিত্রে অভিনয় করেছে। আম্মাজানের কথাগুলো জ্যাকির কাছ থেকেই জেনে নিত বেশিরভাগ। মৌসুমীকে বন্যার ত্রাণ বিতরণের সময় দেখে আম্মাজানের ভালো লেগেছিল। তার মতো পুত্রবধূ চায় সেটা জ্যাকির কাছে জেনে নেয় মান্না। জ্যাকি আম্মাজানকে বোকা ও বুদ্ধি নেই বলাতে মান্না বলেলে-‘আম্মাজানের বুদ্ধি নাই কে কইল! আমার আম্মাজানের কত বুদ্ধি তুই জানিস! আমার আম্মাজান দেশটা চালাইতে পারে।’ এ ডায়লগটিও ছিল মাতৃভক্তির অসাধারণ ডায়লগ। এরপর মৌসুমীকে পুত্রবধূ করার জন্য তোলপাড় শুরু করে মান্না। সেখান থেকে মান্না-মৌসুমী-আমিন খান মিলিয়ে আরেকটা গল্পের সূত্রপাত হয়। মিজু আহমেদও ছিল এ দ্বন্দ্বের মধ্যে।

মান্না-মৌসুমী জুটির রসায়নের পাশাপাশি তাদের পজেটিভ-নেগেটিভ ক্যারেক্টারাইজেশনের অভিনয়ও অসাধারণ এ ছবিতে। স্পেশালি ‘স্বামী আর স্ত্রী’ গানটিতে মৌসুমীর রাগী ভূমিকা দেখার মতো।

মান্না-ডিপজল নায়ক-খলনায়ক জুটির অন্যতম সেরা কাজ এ ছবি। তাদের রসায়ন জমজমাট এ ছবিতে। ফিনিশিং-এ হাসপাতালে মান্নাকে পেছন থেকে গুলি করার পর ডিপজলকে বলা সংলাপ-‘হায় হায় কালাম, কি করছ!’ শুনতে অসাধারণ লাগে। ডিপজলকে একবার খুন করার মুহূর্তে আম্মাজান শবনম বাঁচায়। ডিপজলের মুখের রক্ত মুছিয়ে দেয়। ঐ সিকোয়েন্সটি অসাধারণ ছিল। মায়ের মমতা যে কত বড় দেখানো হয়েছে।

‘আম্মাজান আম্মাজান
চোখের মণি আম্মাজান
বুকের খনি আম্মাজান
প্রাণের খনি আম্মাজান
জন্ম দিছেন আমায়
আপনার দুগ্ধ করছি পান’
মান্নার লিপে টাইটেল সংটি লিজেন্ডারি। আইয়ুব বাচ্চুর অন্যতম সেরা প্লেব্যাক ছিল। গানটি যে কোনো মা-ভক্ত সন্তানের জন্য টাচি।

সব মিলিয়ে মাস্টারপিস ছবি ‘আম্মাজান।’ ইমোশনাল তো অবশ্যই শিক্ষণীয়ও বটে। ছবি দেখতে দেখতে অনবদ্য অভিনয় করা অকালপ্রয়াত মান্না-র জন্য দর্শক হিসেবে আপনার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলে সেটি হবে স্বাভাবিক ঘটনা।
আর যারা আজও দেখেনি এ ছবি তাদের অতি শীঘ্রই উচিত এ মাস্টওয়াচ ছবিটি দেখে নেয়া।


মন্তব্য করুন