নেপথ্য কাহিনি: আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’
ডিসেম্বর ১৯৭১। কলকাতা। ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের ওপর দুটো প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন জহির রায়হান। ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’ (১৯৭১)। আলমগীর কবির ও বাবুল চৌধুরীকে দিয়ে বানিয়েছেন আরো দুটো। ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ (১৯৭১) ও ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’ (১৯৭১)। এবার পরিকল্পনা করেন একটি কাহিনিচিত্রের। নাম ‘এবং ধীরে বহে মেঘনা’।
কাহিনি একটি বাঙালি পরিবারকে নিয়ে। প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তান সেনাবাহিনির গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে পালাচ্ছে পরিবারটি। নৌকাযোগে। সেই যাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবে তুলে ধরা হবে যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রামাণ্যরূপ। পরিকল্পনায় সঙ্গে ছিলেন আলমগীর কবিরও।
পাকিস্তানের পরাজয় তখন সময়ের ব্যাপার। সারা দেশ থেকে তাদের সেনাবাহিনি পিছু হটছে। পালাচ্ছে ঢাকার দিকে। জহির রায়হান পরিকল্পনা করেন চূড়ান্ত বিজয়ের দিনগুলো সেলুলয়েডে ধরে রাখার। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের চালানো ধ্বংসযজ্ঞের প্রামাণ্য ফুটেজ নেয়ার। সেগুলো ব্যবহার করা হবে ‘এবং ধীরে বহে মেঘনা’য়। সেজন্য ক্যামেরা জোগাড় করে দেন বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্রকার হরিসাধন দাশগুপ্ত। কথা ছিল তিনজনে দৃশ্যধারণ করবেন। তাদের মধ্যে নারায়ণ ঘোষ মিতা শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। ক্যামেরাম্যান কমল নায়েককে নিয়ে আলমগীর কবির মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ঢাকার পথে এগোন যশোর-খুলনা হয়ে। আর অরুণ রায়কে নিয়ে জহির রায়হান সরাসরি শত্রুমুক্ত ঢাকায় পৌঁছান বিশেষ বিমানে। ধারণ করেন বিজয়ের আনন্দে উত্তাল ঢাকার রাজপথের দৃশ্য।
এরই মধ্যে শোনেন ভাইয়ের খবর। তার প্রিয় বড় ভাই নিখোঁজ। শহীদুল্লাহ কায়সার। ১৪ তারিখ থেকে। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে ফেরেন ভাইকে। গঠন করেন ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’। দায়ী করেন মার্কিন ষড়যন্ত্রকে। পরের দিকে কেমন ক্ষেপে যান। দাড়ি রাখেন। ঘন ঘন যেতে থাকেন আজমীর শরীফে। সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘোষণা দেন শ্বেতপত্র প্রকাশের। ৩০ জানুয়ারি জোর করে অংশ নেন এক সামরিক রেইডে। মিরপুর তখনো সিভিল আর্মড ফোর্সেসের নিয়ন্ত্রণে। বিহারিদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। রেইডটি ছিল তাদেরই ধরতে।
সেদিন সকালে কে একজন ফোন করে জহির রায়হানকে। সম্ভবত বিহারি নৃত্যপরিচালক মাস্তানা। জানায়, মিরপুর ১২ নম্বরে বন্দি আছেন শহীদুল্লাহ কায়সার। আরও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে। তখনই বেরিয়ে পরেন জহির রায়হান। সেদিন রেইডে অংশ নেয় সেনাবাহিনী ও পুলিশের মিলিত দল। তারা কোনোভাবেই বেসামরিক কাউকে সঙ্গে নিতে রাজি ছিল না। কিন্তু জহির রায়হানের একগুঁয়েমির কাছে তাদের নতি স্বীকার করতে হয়। না করলেই বোধহয় ভালো হতো। কারণ সেদিন ঘাপটি মেরে থাকা বিহারিরা কাপুরুষোচিত আক্রমণ করে মিলিত বাহিনীর ওপর। শহীদ হন প্রায় পঞ্চাশজন। তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। জহির রায়হান।
স্বাধীন দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ছিল জহির রায়হানের। তার মৃত্যুতে সে সবই হারিয়ে যায়। কেবল হারায়নি ‘এবং ধীরে বহে মেঘনা’। সে দায়িত্ব কাঁধে নেন আলমগীর কবির। ঠিক করেন ছবিতে কোনো কাল্পনিক ঘটনা রাখবেন না। মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য ধারণ করাই আছে। বাকি দৃশ্যগুলোও হবে সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। ছবিটি হবে একাধারে ফিকশন ও নন-ফিকশন। কমপ্লিট সিনেমা। তাতে ভাঙবেন গতানুগতিক গল্প বলার ঢং। সেভাবেই লেখেন চিত্রনাট্য। রোবের্তো রোসেলিনির ‘রোম, ওপেন সিটি’ (১৯৪৫) মাথায় রেখে। অনেকটা ডকুমেন্টারি স্টাইলে। ওতর রীতিতে। তুলে ধরেন বিজয় পরবর্তী ঢাকার হাসি-কান্না মাখা দিনগুলো।
কিন্তু শুটিং শুরুর পর থেকেই দেখা দেয় পুঁজির অভাব। শেষ পর্যন্ত সাহায্য নিতে হয় বাণিজ্যিক ছবির এক পরিবেশকের। তিনি টাকার জোগান দেন বটে। কিন্তু নাকও গলাতে থাকেন। অন্তত তিনবার বদলাতে হয় চিত্রনাট্য। ছবিতে ঢোকাতে হয় প্রেম। কমেডি। এমনকি গানও। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঢাকায় এলে রাতারাতি তাকে রাজি করিয়ে ফেলেন। একদিনের মধ্যে গান লিখে সুর করে গাইয়ে নেয়া হয়। ওদিকে কলাকুশলী নিয়েও চলে টানাপোড়েন। ক্যামেরাম্যানই বদলাতে হয় চারবার! কাঁচামালের অভাব, ক্যামেরা নষ্ট— এসব তো ছিলই।
তবে দুটো বিষয়ে কিছুতেই আপোষ করেননি আলমগীর কবির। পরিবেশকের আপত্তি সত্বেও ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ফুটেজ ব্যবহার করেন। আর মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে নেননি কোনো অভিনেতা। অভিনয় করতে গেলে যদি মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটিকে অবাস্তব মনে হয়! ময়দানের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এতটাই ছিল তার শ্রদ্ধা।
১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় ‘ধীরে বহে মেঘনা’। ব্যবসা তেমন একটা করতে পারেনি। তবে পরিচালকের মতে শুরুটা ভালোই হয়েছিল। কিছু হলে হাউজফুলও হয়েছিল। বলাকার মতো হলগুলোতে চালানো যেত আরও কিছুদিন। কিন্তু পরিবেশক নিজেই ছবিটা তুলে নেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে।
/ লেখাটি দৈনিক ইত্তেফাকে পূর্ব প্রকাশিত।