পর্যবেক্ষণ : দুই যুগের শাকিব খান
আজ ২৮ মে। ১৯৯৯ সালের ২৮ মে মুক্তি পেয়েছিল শাকিব খানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘অনন্ত ভালোবাসা’। আজ তার ক্যারিয়ারের দুই যুগ পূর্ণ হলো। শাকিব খানের এই দীর্ঘ জার্নি কেমন ছিল, কি তার ক্যারিয়ারের তাৎপর্য।
নব্বই দশকে যারা বিনোদনজগতে পা রেখেছে তারা সবাই ছিল ট্রু ট্যালেন্টেড। এ সময়টি চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে নাটক, গান সবক্ষেত্রে স্বর্ণময় একটা সময় ছিল। চলচ্চিত্রে এ সময়টাতেই সালমান শাহ-র মতো বিরল রত্নও এসেছিল। এ দশকের শেষের বছরে ১৯৯৯ সালে এসেছিল নতুন এক নায়ক শাকিব খান। তার প্রথম ছবি ‘অনন্ত ভালোবাসা’-র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। তিনি সালমান শাহ, শাকিল খানেরও প্রথম ছবির পরিচালক। তারকা চিনতে তার ও তার টিমের ভুল তাই হয়নি। শাকিব খান সেই নব্বই দশকের শেষ প্রোডাক্ট হিসেবে দেশের চলচ্চিত্রে জায়গা করে নেয়। সেই সময়ের চাহিদা অনুযায়ী শাকিব খান পুরোপুরি নিজের সেরাটি দিয়ে জায়গা করতে থাকে দেশের চলচ্চিত্রে। তার জায়গাটি অবশ্যই তার নিজের যোগ্যতায় তৈরি করা।
মান্নার পর শাকিবই দ্বিতীয় নায়ক যাকে অনেকটাই স্ট্রাগল করতে হয়েছে এককভাবে প্রভাবশালী জায়গা করে নিতে। অনেকদিন দ্বিতীয় নায়ক হয়ে কাজ করতে হয়েছে। ব্যর্থ প্রেমিকের গতানুগতিক চরিত্রে কাজ করেও নিজের দিকে মনোযোগ নিতে পেরেছে দর্শকের। এটা তার বিশেষত্ব ছিল। মান্নার ক্যারিয়ারের পিক টাইমেও ব্যবসায়িক দিক থেকে শাকিব কয়েক বছর এগিয়ে যেতে থাকে চলচ্চিত্রে। এভাবে তার জায়গা আরো শক্ত হতে থাকে। মান্নার মৃত্যুর রিয়াজ, আমিন খান, শাকিল খানদের ইন্ডাস্ট্রিতে কমার্শিয়াল ছবি ছেড়ে দেওয়ার পর শাকিব খানের একক রাজত্ব শুরু হয় যা এখন একটি চলমান প্রসেস হিসেবেই আছে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
শাকিব খানের আজ পর্যন্ত পুরো ক্যারিয়ারে তার পূর্বের ইমেজের সাথে বর্তমান ইমেজের সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। সিংহভাগ দর্শকই মনে করে তার আগের পারফরম্যান্সই বেটার ছিল বর্তমানের চেয়ে। একজন উঠতি নায়কের যে পরিমাণ ডেডিকেশন থাকা উচিত তার সবটাই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। মান্না, আমিন খান, রিয়াজ, ফেরদৌস, শাকিল খান-রা থাকার পরেও নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করতে পেরেছিল শাকিব এটাই তার আর্লি ক্যারিয়ারের অর্জন।
শাকিব খানের আর্লি ক্যারিয়ারের ভিত মজবুত করেছিল ত্রিভুজ প্রেমের কিছু ছবি এবং একক পারফরম্যান্সে অনবদ্য আর দু’একটি ছবি। ত্রিভুজ প্রেমের ছবিগুলোর মধ্যে শাবনূরের বিপরীতে ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবি। এ ছবিটি তার ওয়ার্ড অফ মাউথে পরিণত হয়েছে নিজের অসাধারণ অভিনয়ের কারণে। একজন প্রেম দিওয়ানা প্রেমিকের আচরণ যেমন হয়ে থাকে ঠিক সেটাই ছিল এ ছবিতে। ছবির ক্লাইমেক্সের নাটকীয়তাই শাকিবকে এ ছবিতে ওয়ার্ড অফ মাউথে পরিণত করে। এর বাইরে ‘বাধা, সবার উপরে প্রেম, ও প্রিয়া তুমি কোথায়, স্বপ্নের বাসর’ এরকম আরো কিছু ত্রিভুজ প্রেমের ছবিতে ব্যর্থ প্রেমিকের চরিত্রে শাকিব দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। বাপ্পারাজ একসময় যে ছবিগুলো দিয়ে দর্শকের সফট কর্নারে পরিণত হয়েছিল পরবর্তীতে শাকিব ঠিক সেভাবেই ঐ চরিত্রগুলো দিয়ে তার মতো জায়গা করে নিয়েছিল।
এর বাইরে একক অসাধারণ পারফরম্যান্সে ‘খুনি শিকদার, সিটি টেরর, প্রিয়া আমার প্রিয়া, টাইগার নাম্বার ওয়ান’-এর মতো কিছু ছবি ভূমিকা রেখেছিল শাকিবের সক্ষমতার প্রমাণ রাখতে। ‘সুভা’-র মতো সাহিত্যভিত্তিক ছবিতেও অসাধারণ ছিল শাকিব কিন্তু সমস্যাটা ছিল এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট আর কখনোই করেনি যার জন্য একজন অভিনেতার থেকে হিরোর ইমেজেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশি। এর বাইরে তার আর্লি ক্যারিয়ার খুব শক্তভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। একটা মজবুত পাটাতনে দাঁড়িয়েই শাকিব খান তার পরবর্তী সময়ের ক্যারিয়ারে এগিয়ে যায়।
অনেক নায়িকাদের সাথে কাজ করার যে রেকর্ড রুবেলের ছিল তারপরেই সেটা শাকিব খানের দখলে। প্রথম ছবির ইরিন জামান থেকে শুরু করে শাবনূর, মৌসুমী, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, মীম থেকে ডিজিটাল সময়ের মাহী, পরীমণি, বুবলী হয়ে দেশের বাইরের শ্রাবন্তী, শুভশ্রী, সায়ন্তিকা, নুসরাত, দর্শনা বণিক পর্যন্ত লম্বা সারির নায়িকাদের নায়ক শাকিব খান।
ডিজিটাল আমলের শাকিব খান যত না কাজের মাধ্যমে আলোচিত হয়েছে তার থেকে বেশি ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে আলোটিত হয়েছে। সেটা তার জন্যই ক্ষতিকর হয়েছে কারণ সব মহলের দর্শকদের মনোযোগ রক্ষা করতে পারেনি শুধুমাত্র ফ্যানবেজ ছাড়া। যৌথ প্রযোজনার কিছু ছবি দিয়ে সব ধরনের দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল যার মধ্যে শুরুটা হয়েছিল ‘শিকারী’ দিয়ে। তবে সেখানেও কিছু সমালোচনা ছিল। ডিজিটাল পূর্ববর্তী সময়ে বিশেষ করে যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টিকে থাকতে হয়েছিল শাকিবকে তখন তার অভিনয়ের প্রতি মনোযোগ ছিল দারুণ কিন্তু পরে ডিজিটাল সময়র সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সময়টা না থাকাতে তার অভিনয়ের শক্তি পূর্বের মতো আর থাকেনি। সিংহভাগ সচেতন দর্শকেরই এই মতামত এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই পূর্বের শাকিব খানকেই পছন্দ করত। এটা তার ক্যারিয়ারের মাইনাস পয়েন্ট। তবে যদি শাকিব খান শুধুই তার ফ্যানবেজের কাছে নিজেকে মেলে ধরার কথা বলে তবে শতভাগ সফল।
দু’একটা জনরার বাদ দিলে শাকিব খান ওভারঅল কম্বো-প্যাকেজের কমার্শিয়াল হিরো। তার প্রায় সব ধরনের চরিত্র করার মতো দক্ষতা আছে কমার্শিয়াল হিরো হিসেবে। তার ফ্যানবেজদের সিংহভাগই মনে করে শাকিব তার জায়গায় ঠিক আছে কারণ তারা তাকে সবসময় হিরোই দেখতে চেয়েছে এবং শাকিব ঠিক সেটাই তাদেরকে উপহার দিয়েছে। একজন অভিনেতার থেকে হিরোর ইমেজই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের যুক্তিমতো দেখলে অবশ্যই শাকিব ঠিক আছে হিরো হিসেবে। এর বাইরে যে অংশটি থাকে দর্শকের তারা সার্বিকভাবে শাকিবকে দেখতে চেয়েছে একজন অভিনেতা হিসেবে এই যা।
অবশ্যই লংটার্ম সদর্পে কাজ করার রেকর্ড ঢালিউডে এখন শুধুই শাকিব খানের। এটি তার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। নায়করাজ রাজ্জাকের একক নায়ক হিসেবে কাজ করার ২৮ বছরের যে রেকর্ড সেটাও ছুঁই ছুঁই পর্যায়ে আছে শাকিব খান। আর চার বছর পূরণ হলেই শাকিবের সেটা হাতে চলে আসবে যদিও নায়করাজের মতো লিজেন্ডারি ইমেজ হওয়াটা কঠিন। তবে একজন হিরো হিসেবে এতদিন রাজত্ব করাটাও প্রাপ্তির মধ্যে পড়ে। বাকি ক্যারিয়ারে মনে রাখার মতো ছবি বেশি থাকলে তার ক্যারিয়ার বিশ্লেষণে ভবিষ্যতে অভিনেতার ইমেজটা আসলেও আসতে পারে, আপাতত না।
দুই যুগ পূর্তিতে শাকিব খান-কে উষ্ণ অভিনন্দন।