Select Page

পাগলামীতে ফুরিয়ে গেলেন অভিজ্ঞ নির্মাতা

পাগলামীতে ফুরিয়ে গেলেন অভিজ্ঞ নির্মাতা

পাগলামী
ধরন: কামিং-অফ-এজ ড্রামা
গল্প, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: কমল সরকার
প্রযোজনা: হিমেল ফিল্ম ইন্টারন্যাশনাল
পরিবেশনা: কানন সিনেমা হল, ফেনী
অভিনয়: বাপ্পী চৌধুরী (প্রেম), শ্রাবণী রায় (মিথিলা), রোহান ভট্টাচার্য্য (সোহান), পারমিতা দে, শিবা শানু (লালু), গাঙ্গুয়া (বিহারী ভাই), আমির সিরাজী (রঘু চাকমা), হিমেল চৌধুরী (পুলিশ অফিসার), আমিন সরকার, সরল হাসমত, অনিক খান প্রমুখ।
শুভমুক্তি: ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

নামকরণ: পাগলামী শব্দটি মূলত ছেলেমানুষি অর্থে ব্যবহৃত হয়। এসিনেমায় একঝাঁক তরুণ-তরুণী একজন আরেকজনের প্রতি সরল প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মূলত সেই ছেলেমানুষিকে ইঙ্গিত করছে। তাই নামকরণ হিসেবে “পাগলামী” আমার দৃষ্টিতে যথার্থ মনে হয়েছে।

কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ: এসিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তিন বিভাগের দায়িত্বই সামলেছেন পরিচালক কমল সরকার নিজে। তিনি আমাদের এই ছোট ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম অভিজ্ঞ ও বয়োজ্যেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার। ফ্যামিলি-ড্রামা জনরায় তার লেখনীর হাত চমৎকার, “অজান্তে” এর মতো ছবিগুলো সেই স্বাক্ষর আজো বহন করে। আবার তারই লেখা “ডেয়ারিং লাভার” কিংবা “ডন নাম্বার ওয়ান” এর মতো ছবি চিত্রনাট্যে বহু বিদেশী গল্পকে সরাসরি তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছেন।

এমন একজন অভিজ্ঞ গল্পকারের কাছ থেকে ভালো সিনেমা না হোক, অন্তত একটা ভালো গল্প আশা করেছিলাম। কিন্তু সেই আশার পুরোটাই গুঁড়েবালি! গল্প একাধিক প্লটহোলে ভরা। এক-একটি প্লটহোলের গভীরতা এতোই বিশাল, সবকিছু বিশ্লেষণ করলে মনে হবে এগল্প নিতান্তই এক অবুজ, অপ্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাথা থেকে বের হয়েছে। এগল্প শোনা মানে বেহুদা সময় নষ্ট।

তবুও দুই-এক লাইনে গল্পের কিছু সারমর্ম আলোচনা করা যাক। গল্পে দেখা যায়, মিথিলা (শ্রাবণী) নামক একটি মেয়েকে প্রেম (বাপ্পী) পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু মিথিলা প্রেমের এসব পাগলামো একদম পছন্দ করে না। ইনফ্যাক্ট সে এসব প্রেম-ভালোবাসা-বিয়েতে বিশ্বাস করে না। কারণ হিসেবে এর একটি ব্যাকস্টোরি রয়েছে। কিন্তু প্রেম নাছোড়বান্দা, সে তাকে মনেপ্রাণে চায়। মিথিলার মা ও চায় তার মেয়ে যেনো প্রেমের ভালোবাসাকে গ্রহন করে। কেন প্রেমের ভালোবাসার প্রতি তার মায়ের এতো বিশ্বাস, কেন প্রেমের প্রতি তার এতো ভরসা.. সেরকম কোনো ব্যাখ্যা নেই। আবার, প্রেমের বাবাও তার ছেলের ছেলেমানুষি দেখে ব্যাপক মজা পায়! সে বহু আগে থেকেই মিথিলাকে তার ঘরের বউ হিসেবে মনেমনে কল্পনা করে আসছে। যেহেতু দুই পরিবার একে অপরের সাথে পরিচিত না, তবুও কেন দুইপক্ষের ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাদের মধ্যে এতো আদিখ্যেতা, তার কোনো কারণ খুজেঁ পেলাম না।

এরপর দেখা গেলো প্রেম, মিথিলা ও তাদের একঝাঁক বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার ট্যুরে যায়। সেখানে গিয়ে তারা একে অপরের সাথে রঙ্গতামাশা করে, কিন্তু বাইরে বাইরে বলে বেড়ায় তারা সবাই একে অপরের বন্ধু। ইহাকেই হয়তো জাস্ট ফ্রেন্ড বলে!

অন্যদিকে মিথিলার সৎ মামা লালুকে মিথিলার মা কোনো এক কারণে পাঁচ বছর ধরে জেলের ভাত খাওয়াচ্ছে। পাঁচ বছর পর লালু বের হয়ে মিথিলার মায়ের কাছে কিছু টাকা দাবি করলে মিথিলার মা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর লালু কক্সবাজারের স্থানীয় পাতিমাস্তানদের ব্যবহার করে চেষ্টা করতে থাকে তার ভাগ্নীকে অপহরণ করার, আর এই চেষ্টা করতে করতেই তিনি পুরো ছবি পার করে দেন। যদিও তিনি চাইলে আরো বহু উপায় ব্যবহার করে তার টাকা আদায় করতে পারতেন।

পুরো চিত্রনাট্য একদম সমতল গতিতে সামনের দিকে এগোয়। আপনি যদি নিয়মিত বাংলা ছবির দর্শক হন, চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবেন এর পরের সিনে কী হতে যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নিষ্প্রাণ সংলাপ। খুবই বাজে এবং সামঞ্জস্যহীন সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে এছবিতে। একদমই দম নেই। দম থাকার মতো পাঞ্চলাইন ও খুজেঁ পাইনি। “মারবো এক থাবা, মাংস উঠে আসবে আড়াই কেজি” এরকম আজগুবি পাঞ্চলাইন একসময় ডিপজলেরা ব্যবহার করতো, তাও আজ থেকে প্রায় দেড় যুগ আগে!

এ অংশ পাবে ১০০ তে ০

পরিচালনা ও অভিনয়: চিত্রনাট্যকার কিংবা সংলাপ রচয়িতা হিসেবে কমল সরকার যতটা সমাদৃত, নির্মাতা হিসেবে তিনি ততটা নন। ৫৮ বছর বয়সী এ পরিচালকের অতীতে পরিচালিত ছবিগুলির তালিকা দেখলেই বোঝা যায়। নব্বইয়ের দশকে টিপিক্যাল/ধার করা গল্পে সিনেমা নির্মাণ করেছেন। এরপর যখন অন্ধকার যুগ আসলো তখন “ক্ষ্যাপা বাসু” কিংবা “ওরে বাবা” এর মতো কুরুচিকর সিনেমা উপহার দিয়েছেন। তাই তার পরিচালনা নিয়ে সিনেমা দেখার পূর্বে তেমন কোনো প্রত্যাশা ছিল না। হয়েছেও তাই… শুন্য প্রত্যাশা নিয়ে দেখা শুরু করেছি, শুন্যতা নিয়েই শেষ করলাম। গল্পে যদি থাকে ত্রুটি-বিচ্যুতি, এর উপস্থাপনার ধরণে রয়েছে নিম্নমানের ছাপ! এতো দূর্বল পরিচালনা সাধারণত যারা লো বাজেটের বি-গ্রেড সিনেমা বানায়, তাদের করতে দেখা যায়।

অভিনয়ের কথা বিশেষায়িত করে বলার মতো তেমন কিছু নেই। এ সিনেমায় আমার কারো অভিনয়ই ভালো লাগেনি। একঝাঁক অনুপযুক্ত নবীন তরুণদের এরকম চরিত্রগুলোতে সুযোগ দেওয়া হলো, যাদের মধ্যে অভিনয়ের ‘অ’ টাও খুজেঁ পাইনি।

এছাড়া কোলকাতা থেকে তিনজন অভিনেতা/অভিনেত্রীকে এছবির জন্য আমদানি করে আনা হলো, কেন এদেরকে-ই আনা হলো তা তো সিনেমা সংশ্লিষ্টরাই ভালো জানেন। প্রধান চরিত্রে থাকা শ্রাবণী রায়ের মধ্যে চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার বিন্দুমাত্র কোনো চেষ্টা চোখে পড়লো না। মনে হলো তাকে হুট করেই ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা পারছেন করে দেখাচ্ছেন। অন্য অভিনেত্রী পারমিতার ও একই অবস্থা। আর সিনেমার ২য় নায়ক রোহান ভট্টাচার্য্যকে মনে হলো জোর করা হয়েছে এগুলো করার জন্য। তাদের অভিনয় আর ঐ একঝাঁক আনকোরা নতুনদের অভিনয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য পেলাম না।

সিনেমার খলনায়ক চরিত্রে থাকা শিবা শানু, গাঙ্গুয়া ও আমির সিরাজীদের পারফরমেন্স বরাবরের মতোই গতানুগতিক। এদের আর কী-বা করার ছিল? এই গল্পে তাদের কিছুই করার নেই। গাঙ্গুয়ার এন্ট্রি কিছুটা আকর্ষণীয় লাগলো, কিন্তু অভিনয়… দীর্ঘদিন ঘরের এক কোণায় কোনো খাবার ফেলে রাখার মতো।

আরেকজনের কথা তো না বললেই নয়… এসিনেমার প্রযোজক হিমেল চৌধুরীর কথা। উনি মনে হয় নিজের সিনেমাহলে নিজেকে একবার বড়পর্দায় দেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন, নিজের হলের দেয়ালে নিজের পোস্টার দেখতে চেয়েছিলেন। যার দরুণ এমন ফালতু একটি প্রজেক্ট করা। এরকম কাজে টাকা না ঢেলে যদি নিজের হলখানা সংস্কার করতেন, তবুও সিনেমাপ্রেমীদের দোয়া ও আশির্বাদ পেতেন। অভিনয়ের কথা আর না-ই বা বলি, এসব প্রযোজকদের আসলে অর্ধচন্দ্র দিয়ে দুরে ফেলে দেওয়া উচিত।

হয়তো ভাবছেন কেন্দ্রীয় চরিত্র বাপ্পী চৌধুরীর কথা কেন বলছি না? এর ওপর আমি যারপরনাই হতাশ। সবশেষ পরপর টানা তিন ছবি মুক্তি পেলো, যার একটিও বস্তাপচা ব্যতীত ভিন্ন কিছু লাগেনি। যে হারে তিনি তার ভক্তদের অখাদ্য গেলাচ্ছেন, তিনি যখন অদুর ভবিষ্যতে বেলাল সানি কিংবা দীপঙ্কর দীপনের ছবি উপহার দিবেন, তার ভক্তকুল হজম করতে পারবে তো?

এ অংশ পাবে ১০০ তে ০

কারিগরি: কারিগরি দিকে থেকেও এসিনেমা সময়ের তুলনায় অনেক পেছনে পড়ে আছে। আলী আকবর এমদাদের ক্যামেরাওয়ার্কে কোনো নতুনত্ব নেই, একদম গতানুগতিক। এডিটিং খুবই খারাপ, বেশ কয়েকটি সিক্যুয়েন্স উল্টাপাল্টা করে সাজানো। ক্লাইমেক্সের দৈর্ঘ্য সম্পাদক বেহুদা এতো বড় রেখেছেন। কালার গ্রেডিং গতানুগতিক, ঔজ্বল্যহীন। এরকম গল্প উজ্জ্বল রঙের দাবি রাখে, যেটা অনুপস্থিত।

সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়েছেন এস.ডি লাল, এখানেও কোনো নতুনত্ব নেই। পুরোনো একাধিক সিনেমার বিজিএম এখানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, একটা জায়গায় ভালো ছিল। সেটা হলো গাঙ্গুয়ার এন্ট্রি মিউজিক। ওটা শুনে মনে হয়েছে গল্পে কোনো খলনায়কের আগমন ঘটছে। কোলকাতার শিল্পীদের ডাবিং মনে হলো অন্যদের দিয়ে করানো হয়েছে, এটা আরো বেশি খারাপ প্রভাব ফেলেছে। সিনেমায় ফাইট সিক্যুয়েন্স কম, যা আছে তাও গতানুগতিক।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ৫

বিনোদন: সিনেমায় মোট গান রয়েছে ৪ টি। তন্মধ্যে পারভীন সুলতানা ও সুমনের গাওয়া “তুই আমার জান” গানটি কিছুটা মন্দের ভালো। এছাড়া সিনেমার শেষের দিকে একটি বিরহের গান শোনা যায়, সেটা মোটামুটি চলনসই। এছাড়া বাকি দুটি গান খুবই নিম্নমানের। লিরিক্সের কোনো মাথামুন্ডু নাই, এরকম গান এরা কীভাবে তৈরী করার চিন্তা করে সেটাও আমার বোধগম্য হয়না। আর গানগুলোর কোরিওগ্রাফি তো আরো এক কাঠি সরেস! এখন আমাদের সিনেমায় নিয়মিত ভারতীয় কোরিওগ্রাফাররা কোরিওগ্রাফি করছে। এরা দেখে দেখেও কিছু শিখছে না, ধরে ধরে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে যদি কিছু শিখতো…

সিনেমায় রোম্যান্স কিংবা কমেডি কোনোটাই যথেষ্ট পরিমাণে নেই। যা আছে তা-ও যথেষ্ট বিনোদনের খোরাক দেয় না। তবুও অনেকের এই অল্প ডোজেই হাসি চলে আসতে পারে। কারণ এদেরকে দেখলাম সরল হাসমতকে পর্দায় দেখলেই সুন্দর করে দাঁতের দুপাটি বের করে দেয়।

এ অংশ পাবে ১০০ তে ১৫

ব্যক্তিগত: ১০ দিন আগে হুটহাট করে সিনেমার মুক্তির তারিখ ঘোষণা দেওয়া, পরিচালকের নিজ সিনেমার মুক্তিদিন সম্পর্কে অবগত না থাকা, নায়কের নিজ ছবিকে সাপোর্ট না দেওয়া, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে বিন্দুমাত্র প্রচারণা না করা প্রভৃতি বিষয়গুলো বর্তমান জমানায় পরিকল্পনাহীনতার এক একটি বড় লক্ষণ। দিনশেষে এরাই আবার মিডিয়ায় বয়ান দেয়, দর্শকেরা আমায় অমুক লাখ টাকা লস খাইয়েছে। এরকম বস্তাপচা লেভেলের সিনেমা আর এসব সিনেমার প্রযোজকদের সাপোর্ট না দিয়ে, যে যার জায়গা থেকে এদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া উচিত এদের সমস্যা কোথায়। তাতে যদি এদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়।

রেটিং: ০.৫/১০

ছবিটি কেন দেখবেন: এ সিনেমা সাজেস্ট করার মতো বিশেষ কোনো কারণ নেই। যারা এখনো দেখেননি তাদের দেখতে না যাওয়াই ভালো; সময়, শ্রম, অর্থ তিনটাই নষ্ট হবে। আর বাপ্পী ভক্তকুলের আপাতত আপকামিং ছবিগুলির জন্য অপেক্ষা করাই ভালো হবে মনে করি, এসিনেমা তাদেরকেও পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারবে না।


মন্তব্য করুন