পাতালপুরীর রাজকন্যা ও ইবনে মিজান
বাংলা চলচ্চিত্রে মনে রাখার মতো এক নাম ‘ইবনে মিজান’ । দর্শক ভেবে নিতো ইবনে মিজানের ছবি মানে রূপকথা কিংবা লোক নির্ভর কোন গল্পের চিত্রায়ন।
দৃষ্টিনন্দন রাজপ্রাসাদ, মাথার মাঝখানে বেনী করা অথচ ন্যাড়ামাথা দৈত্যর হাতে রাজপ্রাসাদ কিংবা রাজকন্যা নিয়ে ওড়া, সাপুড়ের বাঁশিতে সাপের নাচন, রাজকুমারের তরবারি যুদ্ধ, পরীর উড়ে যাওয়া কিংবা পরীস্থান আর পাতালপুরীর রাজকন্যার নাচ ছিল ইবনে মিজানের ছবির উপজীব্য!
তার ‘রাখাল বন্ধু’ ছবির কাহিনিতে দেখা যায় রাজার মেয়ে সুজাতা এক দরিদ্র বাঁশিবাদক আজিমের প্রেমে পড়ে এবং রাজমহল থেকে বার বার ছুটে আসে। গরীব ধনীর প্রেম ও বিয়ে নিয়ে হাজারো ছবি হয়েছে বাংলাদেশ বা অন্যত্র। ১৯৬৮ সালের সাদা কালো ‘রাখাল বন্ধু’ ১৯৮৬ সালে ‘রঙ্গীন রাখাল বন্ধু’ নামে রিমেক করেছিলেন ইবনে মিজান।
ইবনে মিজান যে ছবি দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেটা কখনো মুক্তি পায়নি। ছবিটা উর্দু ভাষায় নির্মিত হয়েছিল এবং নাম ছিল ‘আওর গাম নেহি’। প্রয়াত চিত্রনায়ক আজিমকে ব্রেক দিয়েছিলেন তিনি এই ছবির ভিলেন চরিত্রে। অথচ আজিম পরে জনপ্রিয় হয়েছিলেন নায়ক চরিত্রে। ‘রূপবান’ জনপ্রিয় হবার পরে ইবনে মিজান পরিচালনা করেন ‘আবার বনবাসে রূপবান’। ছবিটি জনপ্রিয় হলে তিনি এই ধারার ছবির দিকে ঝুঁকে পরেন। এরপর পরিচালনা করেন-জরিনা সুন্দরী,একালের রূপকথা, পাতালপুরীর রাজকন্যা,চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, রাজনর্তকী, রাজকুমারী, বাহাদুর, বসন্তমালতী, কমল রানীর দীঘি, আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী, দুই রাজকুমার, তাজ ও তলোয়ার, শাহজাদা, সাগর কন্যা ও দুই রাজকুমার।
লোক-গল্প কিংবা রূপকথার কাহিনীর বাইরেও তিনি কয়েকটা অ্যাকশান ছবি পরিচালনা করেছিলেন। জনপ্রিয় হয়েছিল এবং আলোচনার জন্ম দিয়েছিল এমন দুটো ছবির নাম ‘এক মুঠো ভাত’ এবং ‘নিশান’। দুটো ছবিই ছিল হিন্দি ফিল্মের সরাসরি নকল বা কার্বন কপি। হিন্দী ‘এক রোটি’ থেকে তৈরি করেছিলেন ‘এক মুঠো ভাত’ এবং ‘কালা আউর গোড়া’ থেকে তৈরি করেছিলেন ‘নিশান’। ‘নিশান’ ছবির গানটা এখনও ধুন্দুমার জনপ্রিয়-‘চুপিচুপি বলো কেউ জেনে যাবে! জেনে যাবে কেউ জেনে যাবে’! সত্তর দশকের ছবিতে খুল্লাম খুল্লা নাচ ও গান এর প্রচলন করেছিলেন তিনি। এখনও ‘বাহাদুর’ ছবির সেই গান- ও সাগর কন্যারে কাঁচা সোনা গায়/ তোর রূপের ঝলকে পরান উড়ে যায়…আরও দেবরে হাহহা/আমার রানীরে হাহহা..দেখলে এসময়ের জব্বর আইটেম সং এর মতোই মনে হবে। জিঘাংসা ছবির ‘পাখির বাসার মতো দুটো চোখ তোমার ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন’ গানটাও সমান জনপ্রিয়।
ফিল্ম আর্কাইভের সংগ্রহে ইবনে মিজানের প্রথম যে ছবির পোস্টার পাওয়া গেল সেটা ‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’। নায়ক-নায়িকা ছিলেন সুজাতা ও আজিম। ১৯৮৯ সালের দিকে পরিবারসহ আমেরিকায় চলে যান ইবনে মিজান। তার একটা ছবিতে ছেলে টিটো মিজানকে তিনি নায়ক বানিয়েছিলেন। ইবনে মিজান মারা গিয়েছেন আমেরিকাতেই ২০১৭ সালে।
যারা বাবার পকেট মেরে কিংবা পরিবারের বাজার খরচের পয়সা মেরে ছবি দেখা শিখেছি তাদের ইবনে মিজান নামটা মনে পড়বেই। কবি গান,পালা গান,জারি সারি ভাটিয়ালি কিংবা যাত্রাপালার জনপ্রিয়তা এখন আর তেমন নেই।
লোক নির্ভর ছবির জনপ্রিয়তা কমে গেছে বুঝতে পেরেই হয়তো দেশ ছেড়েছিলেন ইবনে মিজান।
লোডিং জোন ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ।
পান্থপথ
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১