পেশার সঙ্গে শ্রেণী-ভাষার সম্পর্ক ও ‘কাইজার’
কাইজার (২০২২)। মার্ডার মিস্ট্রি। ডিরেক্টেড বাই তানিম নুর।
‘মহানগর ১’র মত কাইজারেও বাঙলাদেশ পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ ফুল মার্কস পাইছে। ‘কাইজার’-এ আরো একধাপ আগায়ে, বাঙলাদেশের পলিটিকাল লিডাররাও নতুনভাবে প্রেজেন্টেড হইছেন। ঢাকার আপার মিডল ক্লাশ এরিয়ায় প্রাইভেট ভার্সিটির অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাবান দুই মাইয়ার খুনের ইনভেস্টিগেশনে বাধ সাধার বদলে, দেশের একজন মন্ত্রী পদত্যাগ করারেই যে ভাল মনে করলেন, এবং পদত্যাগ করলেনও শেষপর্যন্ত, এইটা তো খুবই আশার সংবাদ আমাদের জন্য! হাহাহা। আর্টে অবশ্য অনেক কিছুই দেখানো যায়; বাস্তবতার সাথে অ্যালাইন করা লাগবে সবসময়, তা না। তবে আর্ট যেহেতু এক ধরনের অল্টারনেটিভ রিয়ালিটি ক্রিয়েটও করে, ফলে আর্টরে সোশাল ফ্যাক্টগুলার লগে মিলায়ে দেখা যাইতে পারে। তাতে কিছু ব্যাপার ক্লিয়ার হয় আরকি।
‘কাইজার’র কাহিনীটা খুব ডিপ কিছু না। ‘কে করছে’ (whodunit) ঘরানার একটা মার্ডার মিস্ট্রি এইটা; এই কোশ্চেনের আন্সার বাইর করা ছাড়া, কাইজারের ওভারঅল প্লট মোটামুটি প্রেডিক্টেবল ছিল। ‘কাইজার’ যে একটা সফিস্টিকেটেড ড্রাগ মাফিয়ার লগে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ ও সিভিল সোসাইটির ক্ল্যাশের কাহিনী, এইটা কিছুদূর দেখার পর এভারেজ থ্রিলার দর্শকের বুইঝা ফেলার কথা।
তবে খুনটা কে করল, আর কীভাবে করল— এইটা বের করার জন্য ‘কাইজার’ যে আয়োজনটা করছে, সেইটা দর্শকের পছন্দ হবে। মানে, কাহিনীটা শেষ পর্যন্ত দেখতে চাইবে দর্শক, তেমন রসদ আছে কাইজারে। কিন্তু কাইজারের কাহিনী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওই ‘খুনটা কে করল’ কোশ্চেনরে ঘিরাই তৈয়ার হইছে৷ এর বাইরে ‘কাইজার’র মিস্ট্রিতে আর তেমন কোন আসপেক্ট বা ডায়মেনশন নাই।
আফরান নিশো আমার প্রিয় অভিনেতাদের একজন; ‘কাইজার’-এ মেন্টালি ডিস্টার্বড একজন এডিসি ক্যারেক্টারে তার অভিনয় ভাল লাগছে। নিশো যেটা করতে পারছে, এডিসি চরিত্রে ওর নিজের অভিনয়ের ইউনিক ফ্লেভারটা অ্যাড কইরা ক্যারেক্টারটারে আরো ইন্টারেস্টিং করছে। অন্যান্য ক্যারেক্টারের ওভারঅল পারফরম্যান্সও ভাল লাগছে আমার।
‘কাইজার’-এর ডায়লগ লেখছেন আয়মান আসিব স্বাধীন। ডায়লগগুলা খুবই প্রশংসিত হইছে দর্শকদের কাছে। অবভিয়াসলি, এক বিচারে দেখলে, ইংরেজি ও হিন্দি ওয়েব সিরিজ দেখা দর্শকের কাছে কাইজারের ডায়লগ ফুল মার্কসই পাবে। এই সিরিজের ডায়লগ বেশ সফিস্টিকেটেড। হিউমার, পাঞ্চ, বুদ্ধিবৃত্তিকতা— আপার মিডল ক্লাশের এই সবগুলা ব্যাপারই আছে ডায়লগে। যেহেতু সিরিজের লিড ক্যারেক্টারগুলার প্রায় প্রত্যেকেই আপার মিডল ক্লাশ, প্লট লোকেশনটাও তাই— ফলে, এই জিনিশগুলা একরকম খাপ খেয়ে গেছে বলা যায়। অবশ্য বেশ কিছু জায়গায় এই সফিস্টিকেশন দর্শকের কাছে ‘অতিরিক্ত বুদ্ধিদীপ্ত’ মনে হইতে পারে, তেমন সম্ভবনা ‘কাইজার’-এ আছে।
কাইজারের ডায়ালগ সফিস্টিকেটেড, বাট সর্বদা ওয়েল কন্টেক্সুয়ালাইজড কিনা— তা নিয়া আলাপ হইতে পারে। ধরা যাক, নারী পুলিশের ক্যারেক্টারটা। দুইটা ডিফরেন্ট রোলে এই ক্যারেক্টারের যে ডিফরেন্ট ভাষাভঙ্গি (গোয়েন্দা ক্যারেক্টারে খুব পলিশড ও ভদ্র ভাষা; আবার মাফিয়া ক্যারেক্টারে গালিগালাজ ও আনপলিশড ভাষা), তা ভাষার ক্লাশ ও কন্টেক্সট নিয়া আমাদের চালু ভাবনাটা বুঝতে হেল্প করে। দেশি সন্ত্রাসী, সাবেক ছাত্রনেতা ও বাস মালিক সমিতির নেতা বাচ্চুর ল্যাঙ্গুয়েজে কোন আরবান ব্যাপার নাই; বাচ্চু পুরাপুরি লোকাল বাঙলা বলে। আবার, বিলাতফেরত ব্যারিস্টার সন্ত্রাসী গ্যাংয়ের পার্ট হওয়া সত্ত্বেও বেশ সফিস্টিকেটেড। প্রফেশনের সাথে ক্লাশ, ও তার সাথে ল্যাঙ্গুয়েজের এই সম্পর্কগুলার যে রিপ্রেজেন্টেশন দেখা গেছে কাইজারে, তা ইন্টারেস্টিং।
যদিও নিশো এইক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম, সম্ভবত নিশোর ক্যারেক্টারটার কারণেই। এডিসি হওয়া সত্ত্বেও নিশোর অ্যাটিচুড, ল্যাঙ্গুয়েজ ইত্যাদিতে একটা খাপছাড়া ব্যাপার আছে; তার ক্লাশের সাথে ঠিক যায় না, এইরকম অনেকগুলা জিনিশ নিশোর ক্যারেক্টারে পাওয়া যায়। আর এই পাওয়া যাওয়ার কারণ সম্ভবত এটাও যে, নিশো একটা ‘মেন্টালি ডিস্টার্বড’ ক্যারেক্টার। মানে, মিডল ক্লাশরে সার্টেইন লেভেলের পাগল বানানো ছাড়া, তারে দিয়া ওই কাজগুলা করানো বা কথাগুলা বলানো, ঠিক যেন যায় না আরকি। এইটা অবশ্য আমাদের মিডল ক্লাশ মনের একটা ট্রু রিফ্লেকশনও বটে!
‘কাইজার’র মেকিং বেশ ভাল হইছে। প্যারালাল ন্যারেটিভের মত করে ফ্ল্যাশব্যাকের যে ব্যবহার, সেটা আমার অন্তত বেশ লাগছে। ওয়েব সিরিজে বাঙলাদেশের নানাবিধ সম্ভাবনা দেখি আমি। এই দেখাটা শেষমেশ কই গিয়া দাঁড়ায়, দেখা যাক।