প্রথমার্ধ প্রচন্ডরকম নড়বড়ে হলেও বিরতির পর উতরে গেছে
কাঠবিড়ালী
কাহিনী, প্রযোজনা ও পরিচালনা: নিয়ামুল মুক্তা
অভিনয়: আসাদুজ্জামান আবীর, অর্চিতা স্পর্শিয়া, শাওন, শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীব।
অ্যালার্ট: স্পয়লারে ভর্তি
শুরু করি গল্প দিয়ে। কাহিনীর ক্রেডিট পরিচালকের আর চিত্রনাট্য ও সংলাপে তাসনীমুল ইসলাম।
ছবির প্রথমেই দেখা মিলে ঝাঁকড়া চুলের নায়ক হাসুর। আপনি যতটা বিনয়ী ভাববেন তাকে সে আপনাকে তার চেয়েও বেশি অবাক করে বিনয়ের প্রতিযোগিতায় নেমে যাবে। মাছের মাথা খাওয়াইলেই নিজের মাথা খেয়ে জমি আপনার হাতে তুলে দিবে টাইপ।
ছবির শুরুতেই ‘ভাব-ভালোবাসার’ প্রতি খুব হতাশাজনক কথা বলেই পরক্ষণে দেখা যায় গ্রামের মেয়ে কাজলের সাথে পুরো গ্রামকে প্লে-গ্রাউন্ড বানিয়ে আর আমি-আপনাকে প্যাভিলিয়নে বসিয়ে প্রেম করে বেড়াতে। তারা প্রেমের জন্য নিশ্চিন্ত মনে পুরো গ্রাম দাপিয়ে বেড়ায় আর গ্রামবাসী তখন হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকে ওদের সেই সুযোগ করে দেয়, তাই ওদের প্রেমের টাইমে মোটামুটি কখনোই ফ্রেমে কোন গ্রামবাসী ঢুকে পড়ার চান্স নেই।
তারপর দেখি আমাদের হিরো বাপ্পারাজের মতো মেলা থেকে কিনে আনে পুতুল, তবে এই পুতুলকে বাপ্পারাজের মতো টেলিফোন হিসেবে ইউজ না করে সংসারের সিম্বল হিসেবে সেট করে। এরপরই ভিলেন হিসেবে আগমন চেয়ারম্যানের ছেলে আজগরের।কিন্তু আজগরের বিধিবাম, হাসুর শুকনা গাঙ হঠাৎই জলে ভরে উঠে। আর এই জলভরা গাঙের প্রভাবে হাসু কাজলকে নিয়ে চলে যায় পাটক্ষেতে। আর পাটক্ষেত পর্ব শেষে সোজা বিয়ের পিড়িতে। মনে হয় আজগর এই ছবিতে ওমর সানীর প্রক্সি দিচ্ছিলো বলেই কেবল আমাদের বাপ্পারাজ এমন একটা রেয়ার সাক্সেস পেয়ে বসে।
এরপর আসে হাসুর পোস্ট-ম্যারেজ পর্ব। ‘লাস্ট স্টোরিজে’ লাইট জ্বলায় আমরা কিয়ারা আদভানীর পাঁচ আঙ্গুল গোনা দেখতে পাই। কিন্তু এই ছবিতে স্পর্শিয়া লাইট বন্ধ করে গোনে। তবে যত আঙ্গুলই গুণুক না কেন মনে হয় না বাইরে চাঁদের আলোয় আনিসের খেতে থাকা এক সিগারেটের টানের সমান সময়ও নয়। এরপরেই অশান্তি আর তারপর হাসুর মান্ডার তেল থেরাপি। বেচারা হাসু পরে খাট রেখে মাঠে কাবাডি খেলতে যায় আর বন্ধু আনিস অন্য প্লে-গ্রাউন্ডে আরেকটা কাবাডিতে হাসুর প্রক্সি দিতে থাকে।
যাই হোক, ছবির প্রথমার্ধ ছিলো ক্যারেক্টার বিল্ডআপের জন্য। কিন্তু পরিচালক এই ক্যারেক্টার বিল্ডআপের জন্য না পারলেন ক্যারেক্টারের উপর ভরসা করতে, না চিত্রনাট্যের। তাই মজুদ থাকা সবকয়টা গান ছেড়েছেন একের পর এক। আর বাকি দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন চিত্রগ্রাহকের হাতে। ফলে যেটা হয়েছে হাসুর মতো একটু পর পরই ছবির কাহিনী দাঁড়ায় কিন্তু আবার শীঘ্রপতন, আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা। মোটামুটি এভাবেই প্রথমার্ধ কাটালেন পরিচালক।
দ্বিতীয়ার্ধে পরিচালক আর প্রেমের পথে না হেঁটে ছবিকে নিয়ে গেলেন একটা ক্রাইম থ্রিলারে। কাজলের সংসারের সিম্বল সেই পুতুল ভেঙে যাওয়া, নিজের গায়ে না পেরে ইটের গায়ে অন্তত কাজলকে খুঁজতে গিয়েও ব্যর্থতা, কাজলের প্রেমের জন্য শরীরের বিকোনোর বদলে শরীরের জন্য প্রেম বিকোনো এবং তারপর গল্প, টুইস্ট এবং আবার গল্প। এভাবেই ছবির দ্বিতীয়ার্ধে পরিচালক আবার ইনিংসের হাল ধরেন এবং মোটামুটি দারুণভাবেই সামলান।
শেষে পুলিশ অফিসারের ভাতপোড়া কিংবা ঘর পর্যন্ত টানাহেঁচড়ার অংক মিললেও গলায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট খোঁজার মতো বহুলব্যবহৃত সূত্রের কথা ভুলে যাওয়ায় আর অংকে পাশ করা হয়ে উঠে না। শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই কক্সবাজারে ফিরে আসা ডলফিনের মতো আমাদের হাসুও ডুব মেরে মেরে জলকেলি খেলতে।
ছবির অভিনয় ডিপার্টমেন্টের কথা বললে প্রথমেই আসবে শাওনের নাম। ওকে আমি চিনতাম বান্নাহর আর্টিস্ট হিসেবে। কিন্তু এখানে অন্য এক শাওন। সত্যিই অনবদ্য।
স্পর্শিয়াও আমার এক্সপেক্টেশনের চেয়ে অনেক অনেক ভালো। কিন্তু ছবির লিড কাস্ট আসাদুজ্জামান আবীরকে কাস্ট করা হলো ইনোসেন্ট ফেইস দেখে। এতটুকু ঠিক ছিলো। তারপর মনে হয় প্রতিদিন সেটে এলে রুটিন করে ইউনিটের সবাই কানের কাছে একবার করে বলে যাচ্ছিলো যে তোমার ক্যারেক্টার কিন্তু ইনোসেন্ট। আর এর চক্করে ক্যারেক্টারটাকে মোটামুটি ফেরেশতার লেভেলে নিয়ে যায়। অভিনয়টাও এই কারণে প্রচন্ড আরোপিত ঠেকছিল।
সজীব সাহেবের অভিনয় কিছুটা লাউড টোনে হলেও ঠিকঠাকই। তবে বৃদ্ধ এম্পলয়মেন্ট স্কীমে নাম উঠা শিল্পী সরকার অপু অসহায় মায়ের চরিত্রে প্রচন্ড রিপিটেটিভ।
ছবির চিত্রনাট্য ও সংলাপ বারবারই তাল হারাচ্ছিলো। কাহিনীর একটা ভালোরকম ধাঁচ থাকলেও সেটার তাল কেটে যাবার জন্যে দায়ী কেবলমাত্র এই চিত্রনাট্য।
সম্পাদনা আমার ঠিকঠাকই মনে হয়েছে। কিন্তু কালারের জায়গায় মনে হচ্ছিলো পরিচালকই কনফিউজড হয়ে যাচ্ছেন, ন্যাচারাল কালার যাবে না সো কল্ড ‘অ্যাস্থেটিক’ বানাতে হবে।
ছবির সিনেমাটোগ্রাফি হলো সেই ডিপার্টমেন্ট যার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ ছিলেন। আমারও মনে হচ্ছিলো যে গ্রামের ব্যাকড্রপ চুজ করেছিলেন পরিচালক নিয়ামুল মুক্তা কিন্তু তার পুরো ফায়দা তুলেছেন সিনেমাটোগ্রাফার আদিত্য মনির। মনে হচ্ছিল গ্রামের দৃশ্য নিয়ে কোন ফটোগ্রাফিক এক্সিবিশনে ঘুরে যতগুলো ছবি দেখেছিলেন তার সবকটাই তোলার চেষ্টা করেছেন নিজের ফ্রেম। সাবজেক্ট যতক্ষণ গ্রামের পরিবেশ ততক্ষণ একেবারে ফ্রন্টফুটে খেলে গেছেন কিন্তু যখনই সাবজেক্ট হিসেবে ক্যারেক্টারগুলো হাজির হচ্ছে সংলাপ নিয়ে তখনই কেমন যেন খেঁই হারিয়ে ফেলছেন। উপরন্তু রায়হান রাফির প্রেতাত্মা ভর করায় কিছু আননেসেসারি ড্রোন ওড়ানোর লোভ মনে হয় সামলাতে পারছিলেন না।
যদি বলি ডেব্যুট্যান্ট হিসেবে নিয়ামুল মুক্তা কেমন করেছে,বলতে হয় ভালোই।আর যাই হোক গল্পের প্রতি অনেস্টিটা ছিলো। প্রথমার্ধ প্রচন্ডরকম নড়বড়ে হলেও দ্বিতীয়ার্ধে উতরে গেছে।
এখনকার বাংলা রোমান্টিক ছবির নামে আমাদের যা গেলানো হচ্ছিল তাতে আমরা ভুলতে বসেছিলাম ছবিতে গল্প বলে কিছু থাকতে পারে।এই বাজে সময়টায় কাঠবিড়ালি একটা দারুণ চেষ্টার নাম হয়েই থাকবে।
পুনশ্চ: শুনেছিলাম নিয়ামুল মুক্তা রেদওয়ান রনির শিষ্য ছিলেন। ছবির ওপেনিং থেকে এন্ড ক্রেডিট, সব জায়গায়ই এই গুরুভক্তির ছাপও তিনি রেখে গেছেন। কিন্তু রনির দুটো ছবির পাশে মুক্তার ছবিকে দাঁড় করালে আমার মাথায় একটাই আসলো, রনিকে মুক্তার কাছে শিখতে হবে কিভাবে নিজের ছবিকে ভালোবাসতে হয়। ফিল্মমেকিং আর যাই হোক কোন সস্তা পিকনিক নয়।