প্রামাণ্যচিত্র বিশেষ কিছু আর প্রমাণ করে না!
প্রামাণ্যচিত্র পরিচয়টি সাপেক্ষিক; দাঁড়িয়ে আছে কাহিনিচিত্র বর্গটির বিপরীতে, বা অন্তত স্বাতন্ত্র্যসূচক দূরত্বে। প্রামাণ্যচিত্র বনাম কাহিনিচিত্র, তাই, মোটামুটি চলচ্চিত্র ভোক্তাদের মনোজগতে বিরাজমান বিচারবোধ। এই বিচারবোধ নিয়েই অনেক কাল ধরে চলচ্চিত্র-ভোক্তাকুল ছায়াছবির দিকে দৃকপাত করে আসছেন। কিন্তু গোড়াতেই আমি ভোক্তার এই আচরণ বিভ্রান্তিকর বলে রায় দিয়ে শুরু করতে চাই।
চলচ্চিত্রের ভোক্তাদের নিন্দামন্দ করে শুরু করছি এভাবে না-দেখে, আমার প্রস্তাবনাটি খোলাসা করি। আমার বক্তব্য হচ্ছে, চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলতে গিয়ে চলচ্চিত্রের দর্শকেরা কিংবা বোদ্ধামহল কাহিনিচিত্র বনাম প্রামাণ্যচিত্রের বর্গবিভাজনকে যতটা জাগরুক করে রাখেন, সেবন করার সময় তা পর্যাপ্ত গুলিয়ে থাকেন। বরং তাঁদের সেই গুলিয়ে-ফেলা দশাটিকেই আমি চলচ্চিত্রের সঙ্গে দর্শকের সম্পর্কের মৌলিক জায়গা হিসাবে দেখে থাকি। অন্তত সাম্প্রতিক কালের দৃশ্য-উৎপাদনের মহাসমারোহের মধ্যে।
দেবাশীষ দাস পরিচালিত ‘নিঠুর বনে বিধুর নিরুপম’ ছবির দৃশ্য
দর্শককে নির্মাতা যতই পই-পই করে বলুন না কেন যে ‘মনের মানুষ’ একটা কাহিনিচিত্র, আর তা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সমনামের উপন্যাস অবলম্বনে বানানো হয়েছে, দর্শক কিন্তু ঠিকই গৌতম ঘোষের ছায়াছবিটিতে ‘বস্তনিষ্ঠতা’র তালাশ করে গেছেন। আবার ‘হাসিনা: আ ডটার্স টেল’ নির্মাণেরও বহুদিন আগে থেকেই প্রামাণ্যচিত্র। বাংলাদেশের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে তা তৈরি বলে। ছবিটি প্রস্তুতের আগেই একটা গম্ভীর অপেক্ষা সংশ্লিষ্ট মানুষজনের মধ্যে ছিল বলেও। কিন্তু এরকম একটা প্রামাণ্যচিত্রের বেলাতেও, প্রকাশ্যে কম বললেও, একদল দর্শক রয়েছেন যাঁরা ‘বানোয়াট’ বিষয়বস্তু খুঁজতে থাকবেন; প্রচার করতে থাকবেন। যদি অন্য কেউ সেটা নাও করেন রাজনীতির ময়দানে আওয়ামী-বিপক্ষীয়দের এরকম একটা দাবি কান পাতলেই শোনা যাবে। ফলে, খতিয়ে দেখলে, কাহিনিচিত্রে ‘প্রমাণে’র অনুসন্ধান আর প্রামাণ্যচিত্রে ‘ফিকশনালিটি’ বা কল্পপ্রবণতার অনুযোগ বিশেষ নতুন সমস্যা নয়। যদি বর্তমান উদাহরণগুলোতে পাঠকের অশান্তি লাগে, তাঁরা চাইলেই হলিউডের ও ইউরোপীয় ছায়াছবির দিকে তাকাতে পারেন। ওসব অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে ‘বায়োপিক’ এবং ‘বেইজড অন ট্রু ইভেন্টস’ ছায়াছবির অত্যন্ত শক্তিশালী দুটো ধারা, ঠিক বর্গ বা জঁরা হিসাবে পরেরটি পরিচিত না হলেও। তা সত্ত্বেও হলোকাস্টের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বানানো প্রামাণ্যচিত্র প্রতিপক্ষের দিক থেকে অতিরঞ্জনের অভিযোগ পেয়ে বসে; আবার হলিউডি ক্রাইম বা অ্যাকশন থ্রিলার থেকেও বিশ্ববাসী দর্শক মানুষজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রকাঠামো, আইনিব্যবস্থা, গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ আর হঠকারিতা বিষয়ে ‘বাস্তব’ জ্ঞানলাভ করার চেষ্টা করতে থাকেন।
ফলে, প্রামাণ্যচিত্র আর কাহিনিচিত্রের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আমি কী ভাবি তা সম্ভবত এতক্ষণে স্ফটিকস্বচ্ছ হয়ে গেছে পাঠকের কাছে। আমি বাস্তবতা, পরিবেশন, বাস্তবতার দাবি, সত্যতা, সত্য ও বাস্তবের সম্পর্ক, চলচ্চিত্রীয় বাস্তবতা, দর্শকত্ব, ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ বা দর্শকের ইন্টারপ্রিটেশন এসব পেঁচায়ে-মেচায়ে যা ভাবি তাতে চলচ্চিত্র উৎসবে জমা দেবার জন্য দুইটা ক্যাটেগরির খোঁজ রাখা ছাড়া কাহিনিচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে গুরুতর কোনো মাথাব্যথা নাই আমার।
এক।। প্রামাণ্যচিত্রের পৃষ্ঠপোষক আর বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপনচিত্রকে তথ্যচিত্র বা প্রামাণ্যচিত্র হিসাবে দেখবার চল নাই। অথচ ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যায় এরই প্রামাণ্যচিত্র হিসাবে সবচেয়ে জোরদার দাবি। এখানে গাড়িবিক্রেতা আপনাকে ঢেঁকি দেখিয়ে দেবেন না, অন্যান্য কিছুর মধ্যে গাড়ি তিনি দেখাবেনই। তেমনি নুডলসের বিক্রেতাও আপনাকে জর্দা-পোলাওয়ের চিত্র দেখিয়ে পার পাচ্ছেন না। নুডলস, এমনকি রান্না-করা অবস্থাতেই, তিনি দেখাচ্ছেন। হয়তো বিজ্ঞাপনচিত্রে অতিরঞ্জন থাকে, আর সেটা উভপক্ষে এখন স্বীকৃত। কিন্তু ১৫ থেকে ৬০ সেকেন্ডের ওই চলচ্চিত্রগুলোতে কতই বা তাঁরা অতিরঞ্জন করার সুযোগ পান! কতটাই বা মিথ্যাচার করা সম্ভব! কিন্তু বিশ্বাসের যে জগত সেখানে একটা জটিল সম্পর্কে থাকেন এখানকার অংশীদারেরা। অংশীদার বলতে অন্তত তিন পক্ষকে বোঝানো যায়। পণ্যনির্মাতা পক্ষ, বিজ্ঞাপননির্মাতা পক্ষ এবং নিশ্চিত ও সম্ভ্যাব্য ক্রেতা পক্ষ। শেষ পক্ষ আবার টেলিভিশনের দর্শক পক্ষও বটে। জটিল সম্পর্কটা এরকম যে পণ্যনির্মাতা তাঁর পণ্যের গুণাগুণে আকৃষ্ট করে ক্রেতা বাড়াতে চান বলে সম্ভাব্য বাড়াবাড়ি কথা বলতে বা বার্তা দিতে ইচ্ছুক। আবার তাঁরা এতটা পরিমাণে ইচ্ছুক নন যে সম্ভাব্য ক্রেতা পণ্যটাকে তামাশা করবেন। বিজ্ঞাপননির্মাতা পণ্যনির্মাতার অনুগ্রহে এই অতিরঞ্জনের কাজটা করতে গিয়ে ফ্যান্টাসি আর ‘বৈজ্ঞানিক’ তথ্যাদির উপর নির্ভর করেন। মোটাদাগে, খাদ্যদ্রব্য বা টয়লেট্রিজ বা রাসায়নিক দ্রব্যাদি বা ওষুধপথ্যের ক্ষেত্রে তথাকথিত বিজ্ঞানের প্রপাগাণ্ডা গাইবেন তিনি; আর ভোগ্যপণ্য বা কনজুমার আইটেমের ক্ষেত্রে অধিকল্পনা বা ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিতে পারেন। এসি, ফ্রিজের মতো দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে দুই রাজ্যই অবলম্বন করবেন। পরিশেষে টেলিভিশন দর্শককুল তথা সম্ভাব্য ক্রেতাকুল চক্রাকারভাবে অবিশ্বাস করতে থাকবেন এবং উস্কানিবোধ করতে থাকবেন। উস্কানি ছাড়াও তাঁদের রয়েছে আবশ্যকতার দিকও। পণ্যের বিজ্ঞাপন হোক বা না হোক কোনো না কোনো পানি বা নুডলস মধ্যবিত্তের কিনতেই হবে। প্রামাণ্যচিত্র বুঝবার জন্য এই তিন পক্ষের জটিল সম্পর্কে মনোযোগ দেবার আমি ভীষণ পক্ষপাতী। কিন্তু বাস্তবে, বিজ্ঞাপনচিত্র সেই প্রামাণ্যের মর্যাদা পায় না। বিস্ময়ের না যে, উত্তরকালে পণ্যনির্মাতারা প্রামাণ্যচিত্রের ভঙ্গিতে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ও ভিন্ন ন্যারেটিভে ছবি বানাতে উৎসাহী হয়েছেন। সাইবার পোর্টালে এরকম ছায়াছবি সুলভ।
এই সূত্রে প্রামাণ্যচিত্রের পৃষ্ঠপোষক বিষয়ে কিছু আলাপ করা দরকার। প্রামাণ্যচিত্রের পৃষ্ঠপোষক গত বেশ কয়েক দশক ধরেই উন্নয়ন সংস্থাসমূহ। বিশেষত বাংলাদেশের কথা বিবেচনায় রাখলে এটা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে এই ঘরানা বা ধারার কাজকর্ম গড়ে উঠবার আগে বৈশ্বিক এজেন্সির দিক থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ ছিল। বিবিসি তার মধ্যে অন্যতম। চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চলচ্চিত্র বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে ইচ্ছুক মহলে বিবিসি প্রামাণ্যচিত্রের প্রযোজনা সংস্থা হিসাবে মর্যাদা পেয়ে আসত। ইউরোপে এই ধারা আরও পরিব্যপ্ত। কিন্তু ভাষাগত কারণেই হয়তো খুব পোক্ত দর্শক ছাড়া সেসবের খোঁজ তেমন সুলভ ছিল না। বিবিসি ছাড়া ভারতের দূরদর্শনকেও শিথিল মাত্রায় তথ্যচিত্রের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে আমি দেখে থাকি। বা বলা উচিত, থাকতাম। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক নিরঙ্কুশ ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়ে পড়ার বাস্তবতাতে এগুলো এখন অপ্রাসঙ্গিক। দূরদর্শনের সঙ্গে সম্প্রচার যৌথতায় ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা হিসাবেও কিছু স্বাক্ষর রেখেছিল। এই আলাপ সম্পর্কিত এই অর্থে যে বাংলাদেশ টেলিভিশন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এরকম একটা সমরূপ ভূমিকায় পৌঁছাতে হয়তো পারত। কিংবা কখনো পারত কি না তা বিকশিত হবার আগেই টেলিভিশন একটা পাটাতন হিসাবে ‘পাবলিক’ সম্পত্তি আর নাই। ঘটনাচক্রে, নিশ্চয়ই কাকতালীয় নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে টেলিভিশন মাধ্যমের পতন আর উন্নয়ন সংস্থাসমূহের উন্নয়ন দর্শন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে উত্থান কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। উন্নয়ন সংস্থা, বিশেষত বহুজাতিক এনজিও, প্রামাণ্যচিত্রের সম্ভবত সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক বাংলাদেশে। আপাতগ্রাহ্যে সেসব চিত্র সমাজের ‘দশা’ নিয়ে নির্মিত হয়ে আসছে। কিংবা জনপদের মানুষজনের ‘জীবনযাপন’ নিয়ে। কিন্তু চুলচেরা বিচারে ওগুলো আসলে উন্নয়ন-মিশনের সাফল্যগাথা তৈরির উদ্যোগ হিসাবে দেখার যথেষ্ট কারণ আছে। উপরন্তু, প্রকল্পগুলোর আয়ুবৃদ্ধির জন্য অর্থলগ্নিকার এবং/বা অর্থদাতাকে (লগ্নিকার ও দাতা এই দুই অত্যন্ত দুর্বোধ্য বর্গ উন্নয়নের জগতে) ভজানোর জন্যও ছবিগুলো বানানো হয়ে থাকতে পারে। সেদিক থেকে এই ছায়াছবিগুলো আরও বিপজ্জনক বিজ্ঞাপনচিত্র। বলতে চাইছি যে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, যদি ডোনারের আনুকূল্য ছবিগুলোর খানিকটা লক্ষ্যও হয়ে থাকে, তাহলে ছদ্মবেশী প্রামাণ্যচিত্র হবার সম্ভাবনাই তো বেশি!
‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’, পরিচালক মুহাম্মদ কাইয়ুম
দুই।। ডকুফিকশন নাকি সত্তাশ্রয়ী ছায়াছবি
ডকুফিকশন শব্দটির কোনো বাংলা কেউ করেছেন বলে খেয়াল করিনি। করলেও শুনতে বিশেষ আকর্ষণীয় কিছু হবে কিনা অনিশ্চিত। তাছাড়া আজকাল বাংলা পরিভাষা নিয়ে ততটা ভাবিত নয় পেশাজীবীরা যতটা স্বাধীনতার পরপর ছিলেন। ডকুফিকশন বর্গটি অধুনা আমদানিকৃত, ফলে অনূদিত হবার সম্ভাবনা পরিস্থিতি-বিচারে কম। এই ধারা বা জঁরার চর্চা এখানে কেমন সেই প্রশ্নটা আমাকে ভাবিয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে মৃতপ্রায় একটা দশার মধ্যে জঁরা খোঁজাখুঁজি খুবই আহাম্মুকির কাজ বলে মনে হয়। এখানে এটা বলে নেয়া আমার কর্তব্য বিবেচনা করছি যে গত অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক আলাপ-আলোচনার গড়পরতা প্রবণতা নিয়ে আমি নাখোশ। আমার বিবেচনায় প্রথম ও অগ্রগুরুত্ব দিয়ে আলাপ দরকার ছিল ক্রমহ্রাসমান প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে। চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা বা এফডিসির শ্রমঘনিষ্ট পেশাজীবীদের সঙ্কট হতে হতো এর ঠিক সমমর্যাদার প্রসঙ্গ। পরিবেশক-প্রযোজকদের ক্রমশ পড়তে থাকা বাজারের জন্য করণীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির জিজ্ঞাসাকে এর পরপরই জায়গা দেয়া দরকার ছিল। সেন্সরবোর্ড নামক অনড়প্রায় প্রতিষ্ঠানটির তৎপরতা ও কর্মকাণ্ডকে বিবেচনাধীন করা দরকার ছিল। ছবি যাঁরা বানান তাঁরা কীভাবে আরো দর্শককে নাগাল পেতে পারেন সেই সংক্রান্ত আলাপও অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত, রাষ্ট্রের অনুদানে বানানো ছবির বেলাতেও, ছবি প্রদর্শনের পরিধি এত সঙ্কুচিত যে একদিকে অপচয়ের অনুভূতি হতে বাধ্য; অন্যদিকে গভীর চিন্তার নির্মাতাদের জন্যও দুশ্চিন্তিত না-হয়ে পারা যায় না। নন্দন কিংবা ধারা বিষয়ক আলাপ, যদি করতেই হয়, তার পরেই উঠতে পারত। বাস্তবে ঢাকার বোদ্ধাকুল নান্দনিকতা-টান্দনিকতা নিয়ে এত ব্যতিব্যস্ত যে এসব আলাপ বিশেষ করা হয়ে ওঠেনি। এই প্রেক্ষাপটের উপর দাঁড়িয়ে কোনো একটি বর্গ বা জঁরা বিষয়ক আলাপও বাহুল্য মনে হতে পারে।
যাহোক, সত্তাশ্রয়ী বা সাবজেক্টিভ ছায়াছবিকে আমি ঠিক পরিভাষা হিসাবে ডকুফিকশন বর্গের বিপরীতে সমান্তরালে দাঁড় করাতে চাইছি না। বরং, গদ্যের মতই, সত্তাশ্রয়ী দৃশ্যমালা নির্মাতার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পাটাতনকে হাজির করে, সংবেদ-অনুভবকে হাজির করে। গঁৎবাঁধা সত্য-মিথ্যার তুলনায় তা আমার জন্য অধিক চিত্তাকর্ষক, অধিক স্বাদু। সমাজ-বাস্তবতা আর নির্মাতার ইন্টারপ্রিটেশন মিলে সেই সাংস্কৃতিক উৎপাদটি আরেক মাত্রা নিয়ে আসে। কিন্তু এই প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে যে, বাস্তবতা ও তার অনুধাবন-বিশ্লেষণ কি ফিকশনেরও বৈশিষ্ট্য নয়? আলবৎ! আর সেই কারণেই গোড়াতে বলেছিলাম এই ভেদবিচার নিয়ে আমার সামান্যই আগ্রহ। তারপরও প্রামাণ্যচিত্র আর ডকুফিকশনের বেলায় প্রেক্ষাপটের যোগসূত্রতা আছে। ‘সত্য-মিথ্যা’র প্রসঙ্গটা সেখানেই অর্থবহ। শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’ ছায়াছবি নির্মাণের প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রচুর চর্চা হয়েছে। আবারও একবার হলে ক্ষতি নেই। গুজরাটের সমবায় দুগ্ধ উৎপাদনকারী সংস্থা বেনেগালকে তাঁদের সংস্থার কার্যক্রমের উপর একটা প্রামাণ্যচিত্র বানাতে অনুরোধ করেন। যে সময়কালের কথা হচ্ছে, এবং যে ধরনের রাষ্ট্র ছিল ভারতে, সমবায়ের অত্যন্ত স্বতন্ত্র অর্থ ছিল। এর অন্তত একটা অর্থ এই ছিল যে, ঘণীভূত পুঁজির বিপক্ষে ছোট ছোট উৎপাদকদের জোট যা রাষ্ট্র, অন্তত কাগজে-কলমে, রক্ষা করবে। নয়া-উদারতাবাদী অর্থনীতির দুনিয়ায় পরিস্থিতিটা কল্পনা করাই অসম্ভব পর্যায়ের। যাহোক, অনুমান করাই যাচ্ছে যে ছবিটির জন্য বরাদ্দ টাকাপয়সা অতি অল্প ছিল; শ্যাম বেনেগাল নিজেও ঠিক এই কাজটি থেকে নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণ করতে চাননি। প্রাথমিক জরিপ ইত্যাদি করার পরই তাঁর মনে হলো তিনি একটা কাহিনিচিত্র বানাতে চান। তিনি তাঁর ভাবনা গুজরাটের এই সংস্থাকে জানানোর পর, হয়তো বেনেগালের যশ-প্রতিপত্তির কারণেই, তাঁরা সম্মত হন। ‘মন্থন’, আরও কয়েকটা ছায়াছবির পাশাপাশি, ভারতের নয়া-বাস্তবতাবাদী ছায়াছবির রীতিমত ধারা-সূচনাকারী জায়গায় থেকে গেছে। যিনি কাহিনিচিত্রের রসগ্রাহী তিনি দেখেন কাহিনিচিত্র; যিনি ‘সমাজ-বাস্তবতার’ অনুধাবন করতে চান, তিনি প্রয়োজনমত ‘প্রামাণ্য’ হিসেবে দেখে নেন। খুব বেশি কিছু আসে যায় না। তবে শেষোক্ত ধারার জন্য দর্শকের নিজ সত্তার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক লোকেশন খুবই জরুরি। সত্তাশ্রয়ী ছবি দর্শকেরও সত্তার প্রসঙ্গ বটে। কিছুক্ষণ আগে আলাপ করেছিলাম নিজপক্ষের ‘বিজ্ঞাপন’ হিসাবে প্রামাণ্যচিত্রের প্রশ্নটাকে নিয়ে। হয়তো বহুজাতিকের পণ্যের জন্য আমি পছন্দ করি না, উন্নয়ন সংস্থার উন্নয়ন-দর্শনের জয়গান আমার সহ্য হয় না; কিন্তু নিম্ন আয়ের গরুপালকের পক্ষে আমার আগ্রহ আছে, কেন্দ্রীয় গোঁয়ার পুঁজির সক্ষমতার বিপক্ষে স্থানীয় উৎপাদকের প্রতি আমার সমর্থন আছে। পরিশেষে, পক্ষ খুবই মুখ্য।
তিন।। তাহলে কি প্রামাণ্যচিত্র-বিরোধী আমি?
প্রামাণ্যচিত্রের রাজনীতি নিয়ে আমি উৎসাহী। আর আলাপ করলাম বর্গীকরণের প্রবণতার অর্থ নিয়ে। বর্গীকরণ কেবল চলচ্চিত্রের বেলাতেই নয়, সাধারণভাবেই। মানুষজনের বর্গীকরণ নিশ্চয়ই ভয়ানক বিপদ আনতে পারে, সাংস্কৃতিক বা বৌদ্ধিক কাজকর্মের ক্ষেত্রেও তাই। কিংবা বর্গীকরণ প্রশাসকের জন্য যা ও যতটা গুরুত্ববহ, গ্রহীতার জন্য তা নয়। এই বিষয়গুলোই আমি হাজির করতে চেয়েছি। বিদ্যমান বর্গানুযায়ী প্রামাণ্যচিত্রের প্রতি কোনো বিরোধিতা প্রকাশ আমার দিককার আগ্রহ নয়। বরং খুবই উল্টো। কিছু প্রামাণ্যচিত্র আমার অতীব প্রিয়। অন্যান্য অনেক কাজের মত ছবির দর্শক হিসাবেও আমার আলসেমি আছে, পদ্ধতিগত স্মৃতি নেই। তারপরও আমি বেশ বড় তালিকা বানাতে পারব। কিন্তু এখানে বিশেষ দু’চারটা কাজের কথা বলছি, সাম্প্রতিক কালেরই বলা চলে।
‘হাঁরা কয়লা খুনী চাই না’, ২২ মিনিটের একটা প্রামাণ্যচিত্র যেটা ২০১২তে সম্ভবত আত্মপ্রকাশ করে। নাসরিন সিরাজ এ্যানী পরিচালিত এই ছবিটি একাত্তর টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছিল এবং বর্তমানে ইউটিউবে পাওয়া যায়। এই ছবিটি আমি বহু জায়গায় উল্লেখ করেছি, সেটা ছবিটারই কৃতিত্ব। ফুলবাড়ি কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলনকে উপজীব্য করে এই ছবিটি। বিষয়বস্তুর কারণে তো বটেই, নির্মাতা বিবরণীর যে পদ্ধতিটা অবলম্বন করেছেন সেটার সূক্ষ্মতা, শান্ততা আর রাজনৈতিক অঙ্গীকারময়তা ছবিটিকে আমার কাছে বিশেষ করেছ।
বেশ কয়েক বছর বাদে আচমকা একটা ছবির সঙ্গে সম্পর্ক হলো আমার। ছবির পর্দাতে আমার অংশগ্রহণ আছে, আর সেটা ঘটনাচক্রীয়; আজকের আলোচনায় সেটা প্রাসঙ্গিক নয়। ২০১৮ সালে ‘মুক্তিপ্রাপ্ত’ ছবিটার বাংলা নাম ‘জীবাশ্মজন’, ইংরাজি অনুবাদে ঠিক এই অর্থটিরই অনুবাদ রাখেননি নির্মাতা। বরং, সেখানে যেভাবে তিনি ইংরাজি করেছেন, সুযোগ থাকলে সেটার আবার বাংলা আমি করতাম ‘বিস্মৃত আমার এক বন্ধু’। স্বজন মাঝি, ছবিটির নির্মাতা, শৈশবের এক সহপাঠিকে আচমকা মনে-পড়া দিয়ে ছবিটি শুরু করেছেন। সেই সহপাঠি একজন ইহুদী ছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশে সত্তার রাজনীতি, অন্য সম্প্রদায় এবং/কিংবা জাতির প্রতি কাঠামোগত বিদ্বেষ, পদ্ধতিগত বিলুপ্তি এসবের মধ্যে এই জিজ্ঞাসাটি খোদ হৃদয়গ্রাহী। ৩০ মিনিটের ছবিটিতে সেই অনুভূতিটি তিনি ধরে রাখেন; আর দর্শককে জাতি ও সম্প্রদায়গত পরিচয়-রাজনীতিতে টেনে নিয়ে আসেন। প্রায় এক অপরাধবোধ সঞ্চালিত করে দেয় ছবিটি। তুলনায় ক’দিন আগে দেখা ‘নিঠুর বনে বিধুর নিরুপম’ ছবিটি একেবারেই ভিন্ন তাগিদ নিয়ে হাজির হয়। দেবাশীষ দাস পরিচালিত এই ছবিটাও ২০১৮ সালের। গা ছমছম করা এক ভঙ্গিতে, রহস্যময়তা আর শ্লেষাত্মকতার মিশেলে বাানানো এক বিবরণী ভঙ্গি নির্মাতা তৈরি করেছেন ছবিটাকে পেশ করতে চেয়ে। ১৮ মিনিটের এই ছবিটি একভাবে বলতে গেলে একটা বিলুপ্তপ্রায় মন্দিরকে ঘিরে, শ্মশানকালীর এক মন্দির। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে মন্দিরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন মানুষকে নিয়ে। আরো গভীরভাবে ভেবে দেখলে এমনকি তাঁদেরকে নিয়েও না। ছবির শেষেও অর্থময়তা আর অর্থহীনতার একটা মায়াবী রহস্য নির্মাতা রাখতে পেরেছেন।
শেষোক্ত দুটো ছবিরই প্রযোজক বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট। এর একটা মানে রাষ্ট্রায়ত্ব এই প্রতিষ্ঠানের স্নাতকদের বানানো ছবি মন কাড়ার মত হচ্ছে। সে বিষয়ে আমার আগাম যে কোনো সংশয় ছিল তাও নয়। এখানে প্রসঙ্গটা তুললাম ছবির সুলভতা, আর ছবি দেখবার অভ্যাসের প্রবল চর্চাকে বিবেচনায় রেখে। নাসরিনের ছবিটি ইউটিউবে ছিল, দর্শকসংখ্যা নগণ্য। স্বজনের ছবিটার একটা আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয়েছিল। হয়তো একাধিকও, আমার জানা নেই। ইউটিউবে নেই, থাকলেও লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেখতেন সেটা আশা করা কঠিন। দেবাশীষের ছবিটি কিছুদিন ইউটিউবে ছিল; পরে আবার ব্যবস্থাপনাগত কারণে ছিল না। জানা মতে, এই মুহূর্তে আছে। কিন্তু কোনো একটি ছবি ইউটিউবে পাওয়া যায় নাকি যায় না তা চূড়ান্ত বিচারে নিরর্থক জিজ্ঞাসা। বরং এই ব্যবস্থায় ৩০০ বা ৫০০ বা দেড়হাজার পরিচিত, আধাপরিচিত কিংবা আচমকা দর্শকের সামনে হাজির হতে পারা মানেই ছবির নির্মাতার সংশ্রবের ইচ্ছা নির্বাপিত হলো না। সেই দর্শকদের সকলেও আদৌ ওই ২২ বা ১৮ বা ৩০ মিনিট শেষ করেছেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। করলেও তা নিয়ে আর কখনো চর্চা না করতে পারেন।
সব মিলে, দৃশ্যস্ফীতির এই কালে আরও বিশেষভাবে, চিত্রনির্মাতা নিরাসক্ত হয়ে পড়তে পারেন। আর এই প্রসঙ্গেই আবার আনা দরকার মারুফ হোসেনের ছায়াছবি ‘মৃত্যু এবং…’ (২০১৬ সালে সমাপ্ত, কিন্তু মুক্তি পায়নি) প্রসঙ্গ। বর্গবিচারে এটাকে প্রামাণ্যচিত্রে ফেলা কসরৎ হবে, যেমনটা আগেই বলেছি। মারুফের ২০১০ সালের ছবি ‘…এবং কান্না’র কথা আমার কানে এসেছিল, কিন্তু দেখা হয়নি কখনো। এদফা বছর পাঁচ-ছয় পরে মারুফ যখন আবার ছবি বানালেন তখন আরো দেখতে না-পাবার কথা। কারণ ছবিটা তিনি নির্মাণের পর এই কয় বছরে কোথাও ‘মুক্তি’ দেননি। হয়তো মারুফ ভেবেছেন ছায়াছবি ‘মুক্তি’ পেলেই তিনি বন্দি হয়ে পড়বেন তাঁর নির্মাতা-বাসনার ফলাফলের অঙ্কে। হতেও পারে, আমি জিজ্ঞাসা করিনি তাঁকে। তিনি ছবিটি আমাকে দেখার ব্যবস্থা করেছিলেন, এমনকি বিদেশে বসেও, যদিও তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি এখনও। ছবিটা স্তম্ভিত করে রাখবে আপনাকে। একটি ‘সত্য’ ঘটনা, একটি বাস্তব নির্মাতা, একটি ছবি যা কিছু ‘প্রমাণ’ করতে সক্ষম নয় আর পরিশেষে একজন ছবির ফলাফল বিষয়ে নিরাসক্ত বা অনীহ বা হয়তো হীনবল নির্মাতার আকাঙ্ক্ষা! এরকম পরিস্থিতিতে ছবি কাহিনিচিত্র হলেই বা কী! আর প্রামাণ্যচিত্র হলেই বা কী! কিন্তু মারুফের ছবিতে যে ভ্যানচালকটি গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে ঝুলছিলেন, তিনি ছবির বাইরে বৃহত্তর যাপিত জীবনে ‘সত্যি’ একটা মানুষ ছিলেন। পত্রিকার নিবন্ধে মানুষটি স্থান পেয়েছিলেন, সেজন্যই ছবির বিষয়বস্তু হিসাবে মৃত মানুষটি বিবেচিত হয়েছিলেন। ঠিক যেমন তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’র মৃত মানুষটি।
তবে ধরা যাক, মারুফ কিংবা তৌকীরের মৃত ‘নায়কেরা’ বাস্তবে ছিলেন না; পত্রিকায় খবর হননি। দুজন নির্মাতাই ‘কাহিনি’ বানিয়েছেন, বা গল্পকার থেকে নিয়েছেন। একজন ছবি ‘মুক্তি’ দেননি। আরেকজন ‘মুক্তি’ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা যদি জানতামও যে ওগুলো কাহিনিচিত্র তাতেই কি এই শান্তি আর স্বস্তি বুকে নিয়ে বাসায় ফিরতে পারতাম যে, বাংলাদেশের কোনো ভ্যানচালক দারিদ্র্যপীড়নে গলায় ফাঁস লাগান না? কিংবা বাংলাদেশের বা মিয়ানমারের কোনো শ্রমিক জেদ্দা কিংবা পিনাঙে গিয়ে মরে পড়ে থাকেন না?
রচনাকাল: নভেম্বর ২০২০; প্রকাশনা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের জার্নাল ফ্ল্যাশব্যাক-এ প্রামাণ্যচিত্র বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা, বর্ষ ২৩, সংখ্যা ১, ২০২১