প্রেম দরদীর কথা বলছি
প্রেম করেননি বা প্রেমে পড়েননি এমন লোক মেলা ভার। ঐ গানটা তো আছেই ‘সবার জীবনে প্রেম আসে।’ অনেকেই লুকিয়ে রাখতে চায়, বলে তারা নাকি জীবনে কখনো প্রেমেই পড়েনি। এটা বিশ্বাস করা যায় না। গলির ধারে, স্কুলের রাস্তায় বা রিকশার হুড ফেলে ঘোরাঘুরি করেনি এমন মানুষ পাওয়া দায়। সম্পর্ক না হয় ডালপালা না-ই বা মেলল তবে প্রেম যে জীবনে এসেছে সবার এটুকু বলা যায়..
হ্যাঁ, এই প্রেমের গল্পে বুকে কাঁপন ধরানো বা আবেগ, অনুভূতি, খেয়ালখুশি বা হাসি-কান্নার আবেশ ছড়াতে সেলুলয়েডে যারা দর্শককে প্রেমের কাছাকাছি থাকার সুযোগ করে দেন পরিচালক জাকির হোসেন রাজু তাঁদেরই একজন। তাঁর কাছে প্রেমের গল্পে বেশকিছু ছবি পেয়েছি। তিনি প্রেমকে দরদ দিয়ে তুলে ধরতে পারতেন তাঁর ছবিতে। তাঁর ব্যক্তিজীবনে প্রেম নিয়ে কোনো বেদনার গল্প আছে কিনা জানি না। এটা বললাম তার কারণ সব নির্মাতাই তাঁদের কোনো না কোনো শিল্পে নিজেদের গল্প বলার চেষ্টা করে। হয়তো রাজুসাহেবও তাই চেয়েছেন তাঁর কোনো না কোনো ছবিতে। প্রেমের ছবির প্রতি তাঁর আলাদা দরদ আছে তাই তাঁকে ‘প্রেমদরদী’ বলা ভালো। সেই প্রেক্ষিতেই আজ দুটি কথা বলব তাঁর ছবি নিয়ে..
জীবন সংসার : জীবন নিজেই একটা সংসার। আমরা সবাই যার যার জায়গা থেকে সে সংসারের দায় মাথায় নিয়ে বেঁচে আছি। ববিতা-ফারুক প্রেমের গল্প থেকে শুরু হয়ে সালমান শাহ-শাবনূর হয়ে ঠেকেছে সিনেমাতে। ববিতা-ফারুকের গল্পটি মূল গল্পে ঢোকার দরজা মাত্র, ফোকাস ছিল সালমান শাহ-শাবনূর প্রেমের গল্প বলা। একটা গান দিয়ে একটা ছবি কীভাবে কালজয়ী হয় তার উদাহরণ-
‘পৃথিবীতে সুখ বলে যদি কিছু থেকে থাকে
তার নাম ভালোবাসা, তার নাম প্রেম।’
এ প্রেমের মধ্যেই জ্বলেপুড়ে মরার সাধ জাগে। এ গানটি গোটা ঢালিউডেই প্রেমের গানে অসম্ভব জনপ্রিয় ও কালজয়ী। শাবনূর যে সিকোয়েন্সটিতে বিষ খেয়ে মিছেমিছি মারা যাবার অভিনয় করলে সালমানও সেটা করতে যায়। ভালোবাসার শক্তিটা পরীক্ষা করে দুজনই। জাকির হোসেন রাজুর প্রেমের দরদ ফোটাতে সালমান-শাবনূর তুলনাহীন।
ভালোবাসা কারে কয় : লক্ষ করবেন ছবির নামটি কিন্তু অন্যভাবে বলা। নির্মাতা বলতে পারতেন ‘ভালোবাসা কারে বলে’ কিন্তু তা না বলে বললেন ‘ভালোবাসা কারে কয়।’ ‘কয়’ শব্দটা ‘বলে’-র থেকে আরো বেশি কাব্যিক এবং শুনতে ভালো লাগে। ছবিতে শাবনূরকে মিথ্যে মৃত্যুর অভিনয় করাতে বাধ্য করে বাবা খলিল। তখন রিয়াজের কান্নার অভিনয় অসাধারণ ছিল। সংলাপগুলো টাচি ছিল- ‘আমি যেদিকে তাকাই সব ছারখার হয়ে যায়।’ ঐ গানটাতে আবেগের জায়গা ছিল দারুণ যখন দুজন দুজনকে বলে ‘আর যেন ভুল না হয়’ তখন দুজনই ডানে বামে মাথা ঘুরিয়ে জানায় যে আর ভুল হবে না।
সব আবেগকে হার মানায় শেষ সিকোয়েন্সটি। কে জানত এত মর্মান্তিক কিছু অপেক্ষা করছে! গুলি খেয়ে দুজনই হাসপাতালে। রিয়াজ শাবনূরকে সান্ত্বনা দিতে দিতে মৃত্যুঘুমে যায় আর মুখটা যায় বেঁকে। রিয়াজের অভিনয় দেখলে গা শিউরে ওঠে। শাবনূর তখন রক্তের সিরিণ্জ খুলে বাবাকে দোষী করে রিয়াজের মৃত্যুর জন্য। তারপর কথা বলতে বলতে সেও মৃত্যুঘুম দেয়। দুজনের খোলা চোখ বলে যায় প্রেমের অনেক গল্পে এভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা নামে যা বাস্তব জীবনেও ঘটে। সিনেমাহলে দেখা এ ছবি। দেখে বের হবার পর পরিচালককে অনেক দর্শক একহাত নিল একটা কারণেই – ‘নায়ক-নায়িকা কেন বাঁচল না?’ হ্যাপি এন্ডিং যে এ দেশের দর্শক বেশি আশা করে বোঝা গিয়েছিল।
নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি : শাবনূরের রাতের অন্ধকারে জিদ করে রিয়াজের জন্য বসে থাকাটা দর্শককে দারুণ টাচ করেছিল। রিয়াজ যখন ছুটে যাচ্ছিল শাবনূরের জন্য হলে তখন মুহুর্মুহু করতালি। পূর্ণিমা তখন নবাগতা ইন্ডাস্ট্রিতে। দর্শকের আগ্রহ সিনেমাহলে তার প্রতিই বেশি দেখেছি। তাছাড়া স্যাক্রিফাইসিং রোলে থাকার কারণেও দর্শকের সিম্প্যাথি বেশি পেয়েছিল পূর্ণিমাই। শেষ সিকোয়েন্সে পূর্ণিমা সিনেমাহলে অনেককে কাঁদিয়েছে।
জাকির হোসেন রাজু টাচি ফিনিশিং দিতে পটু। পূর্ণিমা বিদেশ যাবার সময় এয়ারপোর্টে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে শাবনূরকে বলে-‘আমি ইচ্ছে করলে আপনকে কেড়ে নিতে পারতাম, তোমার ক্ষমতা ছিল না ঠেকানোর।’ শাবনূর স্যাক্রিফাইস করতে চাইলে পূর্ণিমা খুশি হয়ে নিজেই রিয়াজের হাতে শাবনূরকে তুলে দেয়, বলে ‘আমার ভালোবাসার মানুষটাকে তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। ওকে দেখে রেখো।’ এর আগে প্রথমদিকে রিয়াজও পূর্ণিমাকে গোলাপ দিয়ে বলেছিল-‘মাধবী, তোমার জন্য নিয়ে এসেছি একশো একটা লাল গোলাপ।’ রোমান্টিক সিকোয়েন্স তৈরিতেও রাজুসাহেব অনবদ্য। ত্রিভুজ প্রেমের ছবিতে এ ছবিটি দর্শকের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয়।
মিলন হবে কত দিনে : এ ছবিতে প্রেমের জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশের একটা সিকোয়েন্সই শতবার দেখা যায়। নিঃসঙ্গতার মাঝে নীল হওয়া শাবনূর তানপুরা বাজিয়ে গায়-‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো’ গানটা। রিয়াজ প্রাচীর টপকে শাবনূরের সামনে এসে দাঁড়ায়। দু’হাত বাড়িয়ে বলে ‘আমরা কি সব ভুলে একসাথে বাঁচতে পারি না? ভালোবাসতে পারি না?’ শাবনূরের চোখে জল টলমল তখন এবং দু’হাত বাড়ানো রিয়াজের বুকে ছুটে যায়। তখন যে গানটি হয় রোমান্টিকের মধ্যেও জীবনমুখী –
‘জীবন জীবন জীবন
শুধু অনন্ত সুখে ভরা এ জীবন
বসন্ত মুখরিত এ ভুবন’
জীবন ‘বসন্ত মুখরিত’ হলে কতই না ভালো হত!
এ জীবন তোমার আমার : পূর্ণিমার প্রথম ছবি। পিচ্চি ছিল দেখতে। রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটির একটা সমূহ সম্ভাবনা তখনই বোঝা গিয়েছিল। পূর্ণিমাকে একটা চিরকুট দিয়েছিল রিয়াজ তাতে কিছু লেখা ছিল না। পূর্ণিমা প্রথম প্রেমের অনুভূতিতে চিরকুট খুলে কিছু না পেয়ে হতাশ হয়। এক গলা পানিতে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা রিয়াজকে বলে-‘চিরকুটে কিছু লেখা না থাকলে কেমন লাগে বলো তো!’ সংলাপটি সিনেমাহলে চলার সময় দর্শকের প্রতিক্রিয়া ছিল-‘আহ!’
পোড়ামন : এ ছবির কথা আর কী বলব! মনটা পুড়িয়েই দিয়েছিল। মাহী-সায়মনের প্রেমের করুণ পরিণতির গল্প। ছোট ছোট সেইসব অনুভূতি –
১.মাহীকে স্কুলে নিয়ে যাবার সময় সায়মনের সাইকেলের চাকা পাংচার হল। তারপর আড়ালে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার রোমান্স দেখে মাহী নিজের শরীরে রোমান্সের অনুভূতি নিল।সে কল্পনায় সায়মনের পরশ নিল।
২. সায়মনের কষ্ট দেখার জন্য আড়াল থেকে তার শুকনো খাবার খাওয়া দেখে মাহী কাঁদল।টাচি গানটা বাজল-
‘পোড়ামন, পোড়ামন
তোর প্রেমে পোড়ামন
দিবানিশি এ মনে এমনই দহন
মুখে যায় না কহন, বুকে যায় না সহন।’
মাহী অন্যায়ভাবে মারা যাবার পরে সায়মনও আত্মহত্যা করে। আর তাদের প্রেমকে সম্মান জানাতে খুনিদের খুন করে মিলন। প্রেমের জন্য এমন দরদী নির্মাণ কমই আছে। অনেকে হয়তো কপি কপি বলে মুখে ফেনা তুলবে কিন্তু আমাদের সমাজেও এরকম ট্র্যাজেডির গল্প আছে। পরিচালক তাই অনেকের গল্প বলতে চেয়েছেন।
ভালোবাসলেই ঘর বাঁঁধা যায় না : ফ্যামিলি ড্রামা হলেও প্রেমের গল্প আছে। অপু বিশ্বাস শাকিব খান-দের বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে থাকে। থাকার কথা ছিল অন্যভাবে। শাকিবের বাবা কাজী হায়াৎ অপুকে পড়াশোনা করানোর প্রতিজ্ঞা করেছিল ছোটবেলায় কিন্তু কথা তিনি রাখেন না। অপুর ওপর হওয়া পারিবারিক নির্যাতনের জন্য শাকিব প্রতিবাদী হয়ে উঠলে অপু সেটাকে ভিন্নভাবে দেখে এবং শাকিবের প্রতি চ্যালেন্জ ছুঁড়ে দেয় সারাজীবনের জন্য তার দায়িত্ব সে নিতে পারবে কিনা। শাকিব গ্রহণ করে তার চ্যালেন্জ। পারিবারিক দায়িত্বের সাথে প্রেম এখানে লুকানো একটা শক্তি ছিল গল্পে। এ ছবির প্রেমটা তাই জাকির হোসেন রাজু কিছুটা ভিন্নভাবে বলেছেন দায়িত্বের মধ্য দিয়ে।
আমার প্রাণের প্রিয়া :
‘কি জাদু করেছ বলো না
ঘরে আর থাকা যে হলো না’
গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। মীমের পাথর মনকে গলানোর জন্য শাকিব খান বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। মীম শেষ পর্যন্ত ছাতা নিয়ে বের হয় বাড়ি থেকে। শাকিবের মাথার উপর ছাতা ধরে গানটি শুরু করে। খুব সাদামাটা দৃশ্য কিন্তু আবেগটা ছিল গভীর।
প্রেমের জন্য যে নির্মাতার এত দরদ তাঁর মনটা নিশ্চয়ই প্রেমময়। তিনি পর্দায় যে ভালোবাসার গল্প বলতেন সেখানে সালমান শাহ, শাবনূর, রিয়াজ, পূর্ণিমা, সায়মন, মাহীর মধ্যে বাস্তবের দর্শকেরাও কোনো না কোনোভাবে নিজেদর খুঁজে পেত। একজন প্রেমদরদী নির্মাতা তাই দর্শকের মনের খবরটা রেখেই সফল হন। জাকির হোসেন রাজু প্রেমের ছবিতে অবশ্যই ঢালিউডে সফল হয়ে থাকবেন।
প্রেমের জয় হোক…♥