প্রেম হতে পারে বিপ্লবের শক্তি!
বেঙ্গলি বিউটি
ধরন : রোমান্টিক পিরিয়ড ড্রামা
পরিচালক : রাহশান নূর
প্রযোজনা : জিরইয়াব ফিল্মস
কাস্ট : রাহশান নূর (ডিজে আফজাল/ বাঙ্গালী বাবু), মুমতাহিনা টয়া (ময়না/ বিউটি), সারাহ আলম (ডিজে মিতা), আশফাক রিজওয়ান (রাফেল ভাই), পীযূষ বন্দোপাধ্যায় (লে.জে কে.এম ইফতেখার), নায়লা আজাদ (ময়না’র মা), মাসুম বাশার (আফজালের বাবা), জি.এম শহিদুল আলম (মুজাক্কের), নাজিবা বাশার (তুশি) প্রমুখ।
মুক্তি : ২০ জুলাই ২০১৮
ভাষা : বাংলা, ইংরেজী
নামকরণ : ছবির প্রথম অংশে মূল পাত্র-পাত্রীর একটি কাল্পনিক এবং মজার প্রেম কাহিনী দেখানো হয়; যেখানে পাত্র থাকেন বাঙালি বাবু, এবং পাত্রী হলেন বিউটি (সুন্দরী)। নামটি মূলত সেখান থেকেই নেওয়া।নামকরণ হিসেবে “বেঙ্গলি বিউটি” আমার কাছে যথার্থ মনে হয়েছে।
কা.চি.স (কাহিনী+ চিত্রনাট্য+ সংলাপ) : এ ছবির গল্পটি মূলত ১৯৭৪/৭৫ সালের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের আলোকে তৈরী করা হয়েছে। ছবির মূল থিমটি আমার কাছে সত্য ঘটনার ওপর অনুপ্রাণিত মনে হয়েছে; যদিও ছবির শুরুতেই বলা হয়েছে, বাস্তব জগতের সাথে এছবির কাহিনীর কোনো মিল নেই। স্ক্রিনপ্লে তেও বেশ কিছু সিন বিভিন্ন আমেরিকান এবং হিন্দী মুভি থেকে অনুপ্রাণিত মনে হয়েছে।
গল্পে দেখা যায়, “আফজাল খান” নামে এক আমেরিকায় পড়ুয়া স্টুডেন্ট ঢাকায় এসে বাংলাদেশ বেতারে ডিজে (বর্তমানে যেটাকে আরজে বলা হয়) এর কাজ শুরু করেন। সেখানে তার এবং ডিজে মিতার উপস্থাপনা করা “ওয়ার্ল্ড মিউজিক” নামক শোটি ব্যতিক্রমী উপস্থাপনার কারণে তরুণদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। মেডিকেল পড়ুয়া স্টুডেন্ট ময়না হলেন ডিজে আফজালের গলার দারুণ ভক্ত। “বেঙ্গলি বিউটি” নামক গল্পের মাধ্যমে সে আফজালকে কল্পনা করতে থাকে। এরপর দেখা যায়, ময়নার বাবা হঠাৎ করেই ময়নার বিয়ে ঠিক করে। ঠিক এরপর থেকেই কাহিনী ডানা মেলতে শুরু করে এবং পরিশেষে কিছুটা অন্যরকম পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৯৭৪ সালে প্রথমবারের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কোনো বাংলাদেশী ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি হলেও তিনি সেদিন মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণের কিছু অংশ দেখানোর মাধ্যমেই এছবির শুরু। এরপর চিত্রনাট্যে সেই সময়ে দেশে কায়েম করা বিতর্কিত ‘বাকশাল তন্ত্র’ এর ভালো-খারাপ প্রভাব বেশ খানিকটা দেখানো হয়েছে। খুব সম্ভবত এই অংশটুকুর জন্যই ছবিটিকে সেন্সর ছাড়পত্র পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে; আমি সঠিক জানি না।
এছাড়াও ছবিতে ৭৫’এর বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী দেশের অবস্থা দেখানো হয়েছে। এই অংশটুকু আমি মনে করি এই ছবির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ছবি টি দেখার সময় মনেপ্রাণে এমন কিছু একটাই আশা করেছিলাম। তবে সবমিলিয়ে এটি মোটেও পলিটিক্যাল মুভি না। এখানে মূলত আফজাল-ময়না র মধ্যকার প্রেমে বেশি ফোকাস করা হয়েছে। পাশাপাশি তৎকালীন দেশে যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল সেটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এছাড়াও ছবির সংলাপ গুলো ভালো লেখা হয়েছে। প্রায় ৪০% সংলাপ ছিল ইংরেজী তে, তাই যাদের ইংরেজী বুঝতে একটু অসুবিধা হয় তাদের ছবিটি দেখতে একটু অসুবিধা হতে পারে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৭০।
অভিনয় : এ ছবিতে যদি আমি পীযূষ বন্দোপাধ্যায় বাদে অন্যদের হিসেব করি, সেদিক থেকে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ডিজে মিতার চরিত্রে থাকা সারাহ আলম এবং ময়নার চরিত্রে অভিনয় করা টয়াকে। পীযূষ বন্দোপাধ্যায় একজন অভিজ্ঞ, সিনিয়র এবং একইসাথে পাওয়ারফুল অ্যাক্টর। তার সম্পর্কে আলোচনা করার সাধ্য কিংবা জ্ঞান কোনোটাই আমার নেই।
কথা বলা যাক সারাহ আলমকে নিয়ে। তিনি খুব স্পষ্টভাষায় বাংলা আবার ঠিক একইভাবে ইংরেজী তে কথোপকথন চালাতে পারেন। তার এই ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজী বলা আমার বেশ ভালো লেগেছে। একইসাথে তার অভিনয়ে যে এক্সপ্রেশন কিংবা চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার জন্য যেরকম ফ্যাশনেবল হওয়া দরকার ছিল তার সবটাই পেয়েছি।
টয়া বেশ কয়েক বছর ধরেই ছোটরপর্দায় নিয়মিত কাজ করছেন। এটিই তার প্রথম ছবি। আর প্রথম সুযোগেই তিনি তার সর্বোচ্চ টা দিতে পেরেছেন। বেঙ্গলি বিউটি নামের যে সার্থকতা তা তাকে দেখলে বোঝা যাচ্ছিল। তাকে দেশীয় পোশাক কিংবা পশ্চিমা, যে সাজেই আসুক তাকে সেভাবেই মানাচ্ছিল। ডায়ালগ ডেলিভারি তে একটু দূর্বলতা ঠেকেছে আমার কাছে, তবে তার ইনোসেন্ট এক্সপ্রেশন সব দূর্বলতা ঢেকে দিয়েছে।
অভিনেতা রাহশান নূর অপেক্ষা আমার কাছে পরিচালক রাহশান নূর কে বেশি ভালো মনে হয়েছে। তার অভিনয় বেশ দূর্বল, তবে তিনি যথেষ্ট স্টাইলিশ এবং হ্যান্ডসাম! নাভির ওপর প্যান্ট উঠিয়ে শার্ট ইন করা, বেল্ট না পড়া… সবমিলিয়ে তার ড্রেসআপে সত্তর দশকের ট্রেন্ডিন ফ্যাশন ফুটে উঠেছে।
বাকি যারা ছিলেন তাদের মধ্যে রাফেল চরিত্রে থাকা আশফাক রিজওয়ান আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন। ছবির শুরুর দিকে তার অভিনয় ভালো না লাগলেও ধীরে ধীরে পুরো ডার্ক কমেডির দায়ভারটা তিনি নিজ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে গেছেন। বেশ বিনোদন দিয়েছে তার অভিনয়। অন্যান্যরাও যথেষ্ট ভালো ছিলেন।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৮০।
কারিগরি : কারিগরি দিক থেকে এছবি ঢালিউড তো অবশ্যই, টালিগঞ্জের ছবির থেকেও বেশ খানিকটা এগিয়ে! এছবিতে ব্যবহার করা ডিফরেন্ট কালার শেডসের পার্থক্য বোঝার জন্য যথেষ্ট। ছবিতে সত্তর দশকের অনূভুতি আনার জন্য সেই সময়কার সব ধরনের প্রয়োজনৗয় বস্তু দেখানো হয়েছে; যেমনঃ গাড়ি, রেডিও, ঘরের আসবাবপত্র, টিভি ইত্যাদি।
পিরিয়ড ড্রামার ক্ষেত্রে বেশ বড় বাজেটের প্রয়োজন হয়। “বেঙ্গলি বিউটি” তে আমরা দেখলাম কীভাবে কম বাজেটে সুন্দর পিরিয়ড ড্রামা বানানো যায়। সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং, কালার গ্রেডিং… সব একদম ঠিকঠাক। গানের কোরিওগ্রাফি হতে শুরু করে মেকআপ পর্যন্ত সবকিছুই ok। কিছু ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি চোখে পড়েছে, তবে সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ না।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৯০।
বিনোদন : ছবিতে মোট গান রয়েছে ৪ টি। সবগুলো গানই সিচুয়েশনাল… তাই কোনো গানই শুনতে কিংবা দেখতে খারাপ লাগেনি।ছবিতে যথেষ্ট পরিমাণে ডার্ক কমেডি রয়েছে। হলে থাকা দর্শকরা বেশ এনজয় করেছে। এছাড়াও গল্পের গাঁথুনি ভালো থাকায় ১০৩ মিনিট ব্যপ্তির ছবিটি মোটেও খারাপ লাগেনি।
তবে আমার কাছে এ ছবির দ্বিতৗয়ার্ধ কিছুটা স্লো লেগেছে। শেষের দিকে কেন জানি মনে হচ্ছিল ছবিটি মেইন প্লট থেকে দুরে সরে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে সঠিক জায়গায় এসে পরিসমাপ্তি ঘটে।
এ অংশ পাবে ১০০ তে ৬৫।
ব্যক্তিগত : এছবি দেখার পর আমার একটাই উপলব্ধি হয়েছে… আমরা আসলে গুণীর কদর করতে জানি না। যদি জানতাম, তাহলে আমরা পীযূষ বন্দোপাধ্যায়কে নিয়মিত ভালো চরিত্র দিতে পারতাম; রাহশান নূরের মতো আরো অনেকে ব্যতিক্রমী স্ক্রিপ্ট দিতে পারতেন। ওপার বাংলায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শেষ বয়সে এসে হিট ছবি দেয়, আর আমরা প্রবির মিত্র, পীযুষ বন্দোপাধ্যায় দের ভালো গল্প তো দুর নিয়মিত ভালো চরিত্র দিতে পারি না। বিষয়টি অনেক দুঃখজনক!
সবমিলিয়ে ছবির দ্বিতৗয়ার্ধের স্লো গতি এবং রাহশান নূরের অভিনয়ে খানিকটা দূর্বলতা ছাড়া এছবির আর কোনো মাইনাস পয়েন্ট নেই।
রেটিং: ৮.৫/১০
ছবিটি কেন দেখবেন : গত ১৮ মাস ধরে যে কয়টি বাংলা রোমান্টিক ছবি মুক্তি পেয়েছে, প্রায় ৭৫% এর সমাপ্তি ছিল নায়ক-নায়িকার মৃত্যু। আর বাকিগুলোতে হ্যাপি এন্ডিং! এছবিতে ভিন্ন কিছু আছে। উপভোগ করবেন আশাকরি। ছবিটি অনেকটাই হলিউড স্টাইলে এর চিত্রায়ন করা হয়েছে। ছবি টি সবার ভালো লাগবে।