
ফেউ/ ‘হত্যাকাণ্ড ও রাজনীতির গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের’ যোগসূত্র
স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম চরকিতে জানুয়ারির শেষ দিকে রিলিজ হয় সুকর্ণ শাহেদ ধীমান পরিচালিত সিরিজ ‘ফেউ’। সত্তরের দশকে ভারত সীমান্তের ভেতরে থাকা সুন্দরবনে রিফিউজিদের ওপর ঘটা হত্যাযজ্ঞের গল্প এটি। যেখানে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামপন্থী সরকারের মদদ ছিল। সম্প্রতি প্রসঙ্গটি আবার স্থানীয় বিরোধী রাজনীতিও সামনে এনেছে। এর একটি উদ্দেশ্য ক্ষমতাসীন তৃণমূলকে চাপে রাখা। বিএমডিবি বিষয়টিকে ক্রিটিক্যালি দেখে, তাই আগাম জানিয়ে রাখল। কেননা এসব বিষয়ের সঙ্গে মরিচঝাপির গল্প নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম নয়। সম্প্রতি সেই সিরিজ নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি রিভিউ প্রকাশ হয়েছে। অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের ১০-এ ৮ রেটিং পাওয়া সেই রিভিউয়ের শিরোনাম “একটি হত্যাকাণ্ড ও রাজনীতির গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের দমচাপা আখ্যান ‘ফেউ’”। বিএমডিবি পাঠকদের জন্য লেখাটি তুলে ধরা হলো—

ইতিহাসের সব সত্য প্রকাশযোগ্য নয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রযন্ত্র যে সময় তার অতিসক্রিয়তার গুণে অতিরাষ্ট্রে পরিণত হয়, যখন আইন, ধর্মাধিকরণ বা কোনো রকমের প্রতিষ্ঠান উদ্বায়িত হয় কোনো জনগোষ্ঠীর মাথার ওপর থেকে, সেই গোষ্ঠী কি তখন ‘ইতিহাস’ নামক বিবরণপঞ্জি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়? সংবাদমাধ্যমের যুগে কিছু দিন হয়তো অস্থিরতা দেখা দেয়, তার পর একদিন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালের সুন্দরবনাঞ্চলের মরিচঝাঁপি দ্বীপের ঘটনা সম্ভবত সে রকমই এক বিষয়, যাকে ইতিহাস নামক বিবরণ থেকে কিছুটা সরিয়েই রাখা হয়। একটি গণহত্যার স্মৃতি ফিকে হতে হতে ধূসর পাণ্ডুলিপিতে পর্যবসিত। কিন্তু ব্যক্তিমানুষের ওপর থেকে যাওয়া সেই স্মৃতির উপর প্রলেপ পড়ে কি? কখন কোন চাকার ঘূর্ণনে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্বের সংজ্ঞা নিয়ে টানাটানি শুরু হয়, তখন আবার খোঁজ পড়ে সেই ধূসর পাণ্ডুলিপির। কিন্তু তার পর?
চরকি ওটিটি মঞ্চে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ফেউ’ ওয়েব সিরিজটির প্রেক্ষাপট মরিচঝাঁপির ঘটনা। নাম বদলে স্থানটির পরিচয় এখানে ‘ডুমুরঝাপি’। কিন্তু সেই আখ্যানের কেন্দ্রে রয়েছে সুনীল সরকার নামের এক ব্যক্তির বেমালুম উবে যাওয়ার ঘটনা। সুকর্ণ শাহেদ ধীমান পরিচালিত এই সিরিজ আপাতদৃষ্টিতে একটি রাজনৈতিক থ্রিলার। কিন্তু, সাম্প্রতিককালে দৃষ্ট থ্রিলার ঘরানার সিরিজ বা ছবির সঙ্গে তার সাদৃশ্য প্রায় নেই। এ এমন এক আখ্যান, যেখানে ১৯৭৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সময়পর্বের বাংলাদেশ, সুন্দরবন, পশ্চিমবঙ্গ, এবং আরো নিবিড়ভাবে দেখলে বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত সময়ের কথা উঠে আসে, যা আদপেও স্বস্তিদায়ক নয়।
এক দিকে খুলনা জেলার মোংলা বন্দর সংলগ্ন মৎস্যজীবী-প্রধান এক গ্রাম, বাঙালি খ্রিস্টান সম্প্রদায় এবং দুটি পৃথক সময় এ সিরিজের কেন্দ্রে। ১৯৭৯ আর ২০০২-এর মধ্যে বারবার যাতায়াত করে চিত্রনাট্য। এবং দুই সময়ের সংঘাত ও সহাবস্থানে তৈরি হয় এমন এক নাটক, যার জন্য দর্শক সচরাচর প্রস্তুত থাকেন না। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি উদ্বাস্তুদের একাংশকে দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেই ঊষর অঞ্চলের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা জলবাংলার মানুষের ছিল না। তাদের একাংশ চলে আসে সুন্দরবনের সংরক্ষিত অরণ্যের মধ্যবর্তী এক দ্বীপে এবং সেখানে কোনোভাবে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যায়। মোংলার নিকটবর্তী এক চার্চের প্রতিনিধি সুনীল সরকার ডুমুরঝাপিতে ত্রাণ নিয়ে যাতায়াত করে। এই যাতায়াতের পথটি খুব সুগম নয়। বাদা অঞ্চলের নিজস্ব রাজনীতি, মউলি সম্প্রদায়ের সঙ্গে ম্যানগ্রোভ-দস্যুদের ক্রমাগত টানাপড়েন এবং তার সঙ্গে সীমান্ত ও তাকে পেরিয়ে আসা মানুষের দল কোনো কিছুকেই স্থির থাকতে দেয় না।

সুনীলের নেশা ছবি তোলা। ডুমুরঝাপির জনজীবনকে সে ক্রমাগত ক্যামেরাবন্দি করে চলে। এভাবেই সুনীলের ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক তরুণীর অগ্নিদগ্ধ হওয়ার দৃশ্য। এই তরুণী এবং তার সঙ্গে আরো দুজন ডুমুরঝাপিতে এসে পৌঁছেছিল। তাদের সারা শরীরে অত্যাচারের চিহ্ন। তরুণীর অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনায় বিচলিত সুনীলকে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, তার ছবি তোলার কাজটা ভালো হচ্ছে না। কারণ চারপাশে ‘ফেউ’ রয়েছে। ‘ফেউ’-এর অর্থ এখানে ‘এজেন্ট’। এই ফেউ আসলে সেই সব লোক, যারা ভিড়ের মধ্যে মিশে থেকে ক্ষমতার তরফে নজরদারি করে। সুনীলের ছবি তোলার ব্যাপারটা তাদের নজরের বাইরে নয়। ডুমুরঝাপিতে আরো দু’জন তরুণী ছিল, যারা বাঁচতে চায় এবং প্রাণ বাঁচাতেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে চায়। সুনীলের ওপরে দায়িত্ব পড়ে তাদের মোংলার চার্চে নিয়ে যাওয়ার।
ডুমুরঝাপিতে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গুলিচালনার দিন থেকে সুনীলকে আর কেউ দেখেনি। জানা যায়, সুনীলও সে দিনের ঘটনায় মারা গিয়েছে। তার মৃতদেহ মোংলায় নিয়ে আসা হয় এবং কবর দেওয়া হয়। আখ্যানের দুটি পর্ব। তার মধ্যে একটি ২০০২ সালের। সে বছর মোংলার চার্চে আসে এক শ্বেতাঙ্গ মিশনারি, ফ্রান্সিসকো কপোলা। সে জানায়, সুনীল তার পত্রবন্ধু ছিল। সুনীলের সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানতেই সে এসেছে। সুনীলের ছেলে ড্যানিয়েল এবং তার বন্ধু সোহেলের ওপর ভার পড়ে কপোলাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার। ড্যানিয়েল আবার ডুমুরঝাপি থেকে যে তরুণীদের সুনীল মোংলায় নিয়ে এসেছিল, তাদের অন্যতম সুনীতার পোষ্যপুত্র। কপোলার উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয়ায় ড্যানিয়েল জানতে চায়, তার উদ্দেশ্য ঠিক কী। কপোলা তাকে জানায় যে, ডুমুরঝাপি-কাণ্ডের পরেও সে সুনীলের একাধিক চিঠি পেয়েছে। সুতরাং সুনীলের ‘মৃত্যু’ বিষয়টি কুয়াশাচ্ছন্ন। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ড্যানিয়েল আবিষ্কার করে, তার বাবার দেহ কবর দেওয়া হয়নি। কবরস্থ হয়েছিল একটি গাছের গুঁড়ি। এর পর শুরু হয় সুনীলের সন্ধান। সে জীবিত, না কি মৃত, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে ড্যানিয়েল, কপোলা, সুনীতাসহ অনেকেই উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে।
কাহিনি এর পর কোন দিকে বাঁক নেয়, তা বলা সমীচীন হবে না। কারণ ঘটনার গতিময়তা ও তার ক্রমাগত বাঁক বদলই এই ছবির প্রাণভোমরা। তবে এই সিরিজ় এমন কিছু বিষয় সাহসের সঙ্গে বলা হয়েছে, যা এতদকাল অব্যক্ত ছিল। সুন্দরবন ও তার অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাবিন্যাস, রাজনীতি এবং পাল্টা রাজনীতির বিন্যাসকে বড় একটা ক্যামেরায় ধরার প্রয়াস হয়নি বললেই চলে। বিশেষ করে মরিচঝাঁপি-কাণ্ড ও তা নিয়ে বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী অঞ্চল ও প্রান্তিক মানুষের উৎকণ্ঠা, আবেগ ইত্যাদি নিয়ে এত দিন নীরবতাই পালিত হয়ে এসেছে। এ সিরিজের অন্যতম চরিত্র সুনীলের বন্ধু মার্শাল। ঘটনার আবর্তে সে জলডাকাতে পরিণত। মউলি সম্প্রদায় ও তাদের পিছনে লেগে থাকা ফেউ, পুলিশ-প্রশাসন ও তার নিজস্ব ফেউ, বাংলাদেশের বন্দর অঞ্চলের ক্ষমতাবান ও তাদের নিজস্ব ফেউ এ ছবিতে উপস্থিত। কিন্তু এই উপস্থিতি এতটাই অরব যে, তারা প্রায়শই অন্তরালে থেকে যায়। অথচ এ কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে সেই সব বহু বর্ণের ফেউয়ের দল।

আপাতভাবে এ সিরিজ থ্রিলারধর্মী হলেও, তার রোমাঞ্চের এক পরত নিচেই অবস্থান করছে দগদগে ঘায়ের মতো ত্রাস। ১৯৭৯-এ দুই দেশের রাজনীতি যেমন এ ছবিতে বারংবার ব্যক্ত, তেমনই ২০০২-এ বন্দর এলাকার আঁধারমহলেরও সানুপুঙ্খ এখানে উপস্থিত। ড্যানিয়েল এবং সোহেলের যাপন, আলো-আঁধারির এক ধূসর জগতে তাদের ঘোরাফেরা, গ্রামাঞ্চলে সদ্য গজানো ভিডিও গেম পার্লারের আবডালে চোরাচালানের ব্যবসা থেকে বঙ্গীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়, প্রত্যন্ত বাংলার চার্চ-কেন্দ্রিক রাজনীতি ইত্যাদির খুঁটিনাটি এ সিরিজকে জটিলতর করে তুলেছে। সর্বোপরি রাষ্ট্রযন্ত্রের অঙ্গুলিহেলনে ব্যক্তিমানুষ কতখানি বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে, তাকে প্রায় দলিলের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে এই সিরিজ। যেখানে প্রথম সিজন শেষ হয়, তা অবশ্যই একটি ‘ক্লিফহ্যাঙ্গার’। দ্বিতীয় সিজনে ঘটনাক্রম কোন দিকে মোড় নিতে পারে, তা নিয়ে উদ্বেগ মিশ্রিত অপেক্ষা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
সিরিজের অন্যতম সম্পদ সুনীল সরকারের ভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়। চঞ্চল প্রায় অপ্রতিরোধ্য তার ভূমিকায়। একই কথা বলা চলে মোস্তাফিজুর নুর ইমরানের সম্পর্কে। মার্শালের চরিত্রে তিনিও অনবদ্য। তাহমিনা অথৈ অভিনয় করেছেন সুনীতার ভূমিকায়। তিনিও উল্লেখের দাবি রাখেন। ড্যানিয়েলের ভূমিকায় তানভির অপূর্ব এবং সোহেলের ভূমিকায় হোসেইন জীবনও অনবদ্য। এ ছবির শুটিং হয়েছে খুলনার সুন্দরবনাঞ্চলে। সেখানে এমন এক ‘পিরিয়ড পিস’ নির্মাণ খুব সহজ কাজ ছিল না। ধীমান ও তার সহকারীরা তাকে নিপুণ হাতে সম্ভব করে তুলেছেন। চিত্রগ্রহণে তনভির আহমেদ শোভনও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন অপেক্ষা সিরিজের দ্বিতীয় সিজনের জন্য।