
বক্তব্যধর্মী ছবির শ্রেষ্ঠ নায়ক মান্না
সমাজের প্রচলিত নানা সমস্যা, দিনের পর দিন ঘটে থাকা এমন কিছু সমস্যা যার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে, রাজনীতির কারণে তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বা ফাঁদে পা দিয়ে জীবন শেষ করে দিচ্ছে এমন অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে নির্মিত বক্তব্যধর্মী ছবিতে মান্না ছিল শ্রেষ্ঠ।

মান্নার বক্তব্যধর্মী ছবিগুলোর শীর্ষ পরিচালক কাজী হায়াৎ। তাঁর বাইরে দু’একজন আছে। মূলত মান্না-কাজী হায়াৎ কোলাবোরেশনের মাধ্যমেই অসাধারণ সব বক্তব্যধর্মী ছবি নির্মিত হত। মান্নার ক্যারিয়ারের প্রথমদিকে এ ধরনের ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে কোনো এক পরিচালকের দৃষ্টিতে পড়ে যায়। তখন তিনি কাজী হায়াৎকে বলেন-‘মান্না তো বেশ ম্যাচিউর অভিনয় করে, মান্নাকে দিয়ে এ ধরনের কিছু ছবি বানাও।’ সেই পরামর্শ থেকেই একের পর এক মান্না-কাজী হায়াৎ ছবি হতে থাকে।
একদম প্রথমদিকের ছবি ছিল ‘যন্ত্রণা’। মান্নার সাথে নবাগত কিছু মুখ এমনকি দিলদারও ছিল নায়কের বন্ধুদের একজন। বেকার সমস্যার কারণে তারা ধীরে ধীরে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর কালোবাজারী, সুবিধাবাদী শক্তি রাষ্ট্রে বেড়ে যায় তাদেরই প্রতিনিধি রাজিবের খপ্পরে পড়ে অনেক অপরাধ করতে থাকে তারা। একসময় আইনের হাতে আসতে হয় এবং সবারই ফাঁসি হয়ে যায়। ফাঁসির সময় তারা হাসিমুখেই সেটি বরণ করে নেয়। তাদের মৃত্যুর পরে দর্শকের কাছে প্রশ্ন করা হয়-‘তবুও কি যন্ত্রণার শেষ হলো?’ এ ছবির বক্তব্য ছিল তরুণ প্রজন্মের বিপথে যাওয়ার কারণ এবং তার করুণ পরিণতি সম্পর্কে দর্শককে মেসেজ দেয়া।
‘দাঙ্গা’ ছিল অসাধারণ বক্তব্যধর্মী একটি ছবি।
কাজী হায়াৎ পরিচালিত এ ছবিটি ছিল স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে নির্মিত। সুবিধাবাদী নেতাদের রাজত্ব, সন্ত্রাসের করাল গ্রাস, স্বাধীন দেশে নিম্নবিত্তের পরাধীন জীবন, ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে একজন সৎ পুলিশের সংগ্রাম ছিল ছবির গল্প। এ ছবিতেও মান্না অনবদ্য অভিনয় করেছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার উপস্থাপনায় মান্নার মুখে ‘আর একটি কবিতা লিখতে পারো না কবি’ সংলাপটি ছিল সেরা এবং নির্মম বাস্তবতা। ধর্ষিতা সুচরিতাকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেয়ার শটটি ছিল ছবির সেরা শট। ভাড়াটে খুনি রাজিব মান্নার হাত কেটে নেয় এবং এক হাত দিয়েই নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে মঞ্চে বক্তব্যরত অসৎ নেতাদের শেষ করে দেয় মান্না। এটিও মাস্টওয়াচ এবং মাস্টারপিস ছবি। এর বক্তব্য ছিল খুবই সূক্ষ্ম যা দেশ ও সমাজের কলুষিত অবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে।
‘ত্রাস’ ছিল তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করার একটি অসাধারণ বক্তব্যধর্মী ছবি। ছবিটি ছিল শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, কলুষিত ছাত্র-রাজনীতি, অসৎ নেতাদের সুবিধাবাদী আচরণ নিয়ে নির্মিত। এ অবস্থার বিপরীতে মান্না সাধারণ ছাত্র থেকে হয়ে ওঠে বিপ্লবী ছাত্রনেতা। একটা পরিবর্তন আসে। অসাধারণ ছবি।
‘দেশদ্রোহী’ মান্নার অসাধারণ বক্তব্যধর্মী ছবি।অসৎ নেতারা কীভাবে তাদের কাজে ক্যাডারদের ব্যবহার করে এবং সুবিধা শেষ হলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তার একটা নমুনা দেখানো হয়েছে এ ছবিতে। মান্না মাস্তানের চরিত্রে অভিনয় করেছে। সুবিধাবাদী নেতা রাজিবকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে দেশদ্রোহী বানানো হয় তাকে। ফাঁসির আসামী করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাবার আগে জনগণের উদ্দেশে তার বক্তব্য ছিল পর্দা কাঁপানো। ছবির একটি গানে মানুষ ও কুকুরের তফাত দেখিয়ে বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছবিতে মান্নার অভিনয় আর গেটাপের কোনো তুলনা নেই।
‘লুটতরাজ’ কাজী হায়াৎ পরিচালিত মাস্টওয়াচ আরেকটি ছবি। সন্ত্রাস, কালোবাজারি, আইনের বাস্তবতা, মেয়েদের বাস্তবতা এ বিষয়গুলোকে এত নিখুঁতভাবে দেখানো হয়েছে যে কমার্শিয়ালি অনেকে এ ছবিকেও মাস্টারপিস বলে থাকে। এ ছবিতেও নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সাথে মান্নার প্রতিরোধমূলক অসাধারণ অভিনয় দেখা যায়। আইনের ফাঁকফোঁকর নিয়েও মান্নাকে মাথা উঁচু করে কথা বলতে দেখা যায়। অনবদ্য একটি ছবি। আজকের সমাজের বাস্তবতায় সেই লুটতরাজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে।
‘তেজী’ কাজী হায়াৎ পরিচালিত বক্তব্যধর্মী আরেকটি ছবি। এ ছবিতেও কাজ না পাওয়া বেকার একটি ছেলেকে সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেখা যায়। তার মনের মধ্যে যে সাহস সেটা ছিল ছবির নামের পরিপূরক। তেজী সাহসী সাধারণ ছেলেটিকে নেতারা কাজে লাগাতে চায়। বিভিন্ন বাস্তবতা ফেস করে ডিপজলের মোকাবেলা করে তাকে আবার নতুন জীবন শুরু করতে হয়। সমাজ পরিবর্তনের যে তেজ মান্নার চরিত্রে দেখানো হয়েছে সেটাই ছবির মূল বক্তব্য। ছবির ‘টাকা নাই রে পয়সা নাই রে’ গানটি তরুণ প্রজন্মের বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট।
‘ধর’ কাজী হায়াৎ পরিচালিত আরেকটি মাস্টওয়াচ ছবি এবং অনেকের মতেই এটাও নির্মাণের জন্য মাস্টারপিস পর্যায়ের। সমাজে টোকাই পরিচয় থেকে উঠে আসা ভাসমান একটি ছেলে ঠোকর খেতে খেতে কীভাবে সন্ত্রাসের পথে পা বাড়ায় ছবিটি তুলে ধরেছে। ডিপজলের গ্রুপে ঢোকার পর মান্নার অপরাধী জীবন শুরু হয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের আর্তনাদ তুলে ধরে। ঐ সময় মান্নার অভিনয় জাস্ট মাইন্ডব্লোয়িং। পুরো ছবিটিতে একটা জমজমাট আবহ আছে এবং মান্নাই তার কেন্দ্রবিন্দু।
‘কষ্ট’ কাজী হায়াৎ পরিচালিত মান্নার দুর্দান্ত অভিনয়ের আরেকটি ছবি। ছোটবেলায় করুণ বাস্তবতায় পড়ে মা-বাবা হারানো একটি ছেলে বড় হবার পর প্রতি মুহূর্তে একটা ভয়ের মধ্যে বাস করে। কিছুটা সাইকো ক্যারেক্টার ছিল মান্নার। মৌসুমীকে বিয়ের পর সবসময় আগলে রাখতে চায় পাগলামি করে। মৌসুমীর প্রেম ছিল ছোটভাই শাকিল খানের সাথে কিন্তু সেটা মান্না পরে জানতে পারে। মৃত্যুর আগে সে আক্ষেপটা বলে যায়। ছবির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল মৌসুমী, শাকিলকে যখন নিজের ভেতরের কষ্টের কথা বলে মান্না। বাবার প্যারালাইসিস রোগের জন্য নিজে সন্তান নিত না কারণ সন্তান যদি তেমন হয়। ঐ অভিনয়টা করে দেখানোর সময় মান্না জাস্ট ম্যাজিক্যাল ছিল। এ ছবিটি মূলত তাঁর অভিনয়ের শক্তিতে মাস্টওয়াচ। ছবিটির বক্তব্য ছিল অত্যন্ত নিখুঁত। সমাজে পোড় খাওয়া মানুষ অপরাধজগতে থেকেো ভেতরে ভেতরে কতটা অসহায় বোধ করে এরই একটা উদাহরণ দেয়া হয়েছে।
‘আমি জেল থেকে বলছি’ মালেক আফসারী পরিচালিত বক্তব্যধর্মী দুর্দান্ত একটি ছবি। এ ছবিতে একটা সাধারণ ছেলে থেকে বাস্তবতার চাপে সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে মান্না হয়ে যায় আসামী। নিজের চোখের সামনে পুরো পরিবারকে শেষ হতে দেখা এবং অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার দুর্ধর্ষ যাত্রা ছিল মাইন্ডব্লোয়িং। বিচারকার্যের আগে তার জীবনে নতুন আরো ঘটনা ঘটতে থাকে। ভয়েস কন্ট্রোল করে পুরো ছবিতে মান্না অন্যরকম অভিনয় করেছে। ব্যক্তিত্ব ছিল চরিত্রটিতে। ধর্ষণ, খুন এসবের শাস্তি কতটা ভয়ানক হওয়া উচিত মান্নার চরিত্রটিতে দেখানো হয়েছে।
‘মিনিস্টার’ কাজী হায়াৎ পরিচালিত এ ছবিটি ছিল বলিউডের ‘নায়ক’ সিনেমার আনঅফিসিয়াল রিমেক। বাংলা ভার্সনে মান্না ছিল পারফেক্ট চয়েজ। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের বিভিন্ন সেক্টরে পরিবর্তন আনার জন্য মান্নাকে অল্প কিছুদিনের জন্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। তারপর তাকে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। একজন সৎ নেতা কিভাবে দেশের মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে এবং সে কাজ করতে গিয়ে তাকে কিভাবে পারিপার্শ্বিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এটি ছিল ছবির বক্তব্য।

‘রাজধানী’ মোহাম্মদ হোসেন জেমী পরিচালিত বক্তব্যধর্মী ছবি। একদম ঠাণ্ডা মাথার থ্রিলার যাকে বলে এ ছবিটি তাই। আন্ডারওয়ার্ল্ডের গল্প হবার পরেও ছবির নির্মাণটি ছিল সাদামাটা তাই দেখতে আলাদা লাগে। মান্না আন্ডারওয়ার্ল্ডের হয়ে কাজ করে এবং নিজের ব্যক্তিজীবন থেকে আবিষ্কার করে ভয়াবহ বাস্তবতা। অপরাধীর জীবনের ছায়া সন্তানের উপর কত নির্মম হতে পারে ছবির ফিনিশিং বলে দেয়। রাজধানী শহর ঢাকার অপরাধজগতের একটা ছাপ ছবিতে আছে। মান্নার অভিনয়ক্ষমতার একটা ছাপ ছবিটিতে আছে। ছবির বক্তব্য ছিল অপরাধী জীবন কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনে না যার পরিণতি ছবির শেষ দৃশ্যে খুব মর্মস্পর্শীভাবে দেখানো হয়েছে।
‘শান্ত কেন মাস্তান’ মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত বক্তব্যধর্মী ছবি। মান্নার বোন নাসরিনকে কলেজ থেকে আসার সময় বখাটেরা নির্যাতন করে। মান্না শোনার পর সেখানে যায়। বখাটে ড্যানীরাজকে শাস্তি দেয়ার এক পর্যায়ে তার হাত উপড়ে ফেলে মান্না। দৃশ্যটি বীভৎস হলেও এটি বুঝিয়ে দেয় ধর্ষকের শাস্তি সমাজে এমন কঠিনভাবেই হওয়া উচিত। মান্না সাধারণ ছেলে শান্ত থেকে এরপর পরিস্থিতিমতে মাস্তান হয়ে ওঠে।
‘গুন্ডা নাম্বার ওয়ান’ ছবিতেও একই ধরনের গল্প ছিল। দুটি ছবিতেই সমাজের বাস্তবতায় অপরাধজগতে মান্নার প্রবেশের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সমাজে কিভাবে মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে।
বলতে গেলে ‘আম্মাজান’-ও অতি সূক্ষ্মভাবে বক্তব্যধর্মী ছবি হয়ে আছে। কাজী হায়াতের এ ছবিতে মান্নার মা তার সাথে কথা বলে না। ছোটবেলায় অফিসের বড়কর্তার মাধ্যমে নির্যাতিত হওয়া মা তার ছেলে মান্নাকেই দায়ী করে ভুলভাবে। তার খেসারত মান্নাকে দিতে হয় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মায়ের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছেলে মান্না। একসময় ধর্ষণের একটা অভিযোগ আসে মান্নার কাছে মান্না দায়ী ছেলেটিকে খুন করে। ধর্ষিতা মেয়েটি আত্মহত্যা করে, মান্না সে পরিবারকে বোঝায় বেঁচে থাকলে সমাজ তাকে কলঙ্ক দিত সে চলে গেছে ভালো করেছে। মান্না নিজেও ছোটবেলায় তার মায়ের সাথে ঘটা সেই ঘটনার জন্য দায়ী লোকটিকে খুঁজে বের করে মেরে ফেলে। সমাজের বাস্তব রূপকে সূক্ষ্মভাবে ব্যঙ্গ করার যে মেসেজ ছবিতে দেয়া হয়েছে এটি অনবদ্য। এছাড়া মাতৃভক্তির অসাধারণ উপস্থাপনাও মান্নার বাদশা চরিত্রের মাধ্যমে আমাদেরকে আবেগী করে তোলে।
বক্তব্যধর্মী এসব ছবিতে মান্নার বিকল্প ছিল শুধুই মান্না। কমার্শিয়াল ছবির শক্তি তখনকার সময়ে কতটা বেশি ছিল মান্নার এ ছবিগুলো তার প্রমাণ। তাঁর অভিনয়শক্তির মাধ্যমে এসব ছবি কালজয়ী হয়ে আছে। ছবিগুলোর গল্প ও বক্তব্যের তীক্ষ্মতাই মান্নাকে ঢালিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাকি সব নায়ক থেকে সহজেই আলাদা করেছে।