বাংলাদেশি ছবি হিসেবে ভীষণ ভালো ‘পাপ পুণ্য’
গিয়াস উদ্দিন সেলিমের পাপবোধের ট্রিলজি ‘পাপ পুণ্য’। প্রথম ছবি মনপুরা ঐতিহাসিক সাফল্য পেয়েছিল মূলত চার্টবাস্টার গানের কারনে। ছবিও ভালো ছিলো। তবে বক্সঅফিস সাফল্যে গান ভুমিকা রেখেছে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় ছবি ‘স্বপ্নজাল’ সিনেপ্লেক্সগুলোতে খুব ভালো সাড়া পেয়েছিল। কিছুদিন আগে চরকি’র জন্য নির্মিত তার ওয়েব ফিল্ম ‘গুনীন’ও সিনেমা হলে মুক্তি দেয়া হয়। এ ছবির বিষয়বস্তুও পাপবোধ। তবে এ ছবিটি তেমন সাড়া পায়নি।
তাই ‘পাপ পুণ্য’ নিয়ে কিছুদিন আগেও যে হাইপ ছিলো তা একেবারে পড়ে গিয়েছিল। তার উপর প্রচারণা একেবারেই হয়নি বলা যায়।
সিনেমা হলের সামনের লবিতে দুজন মেয়ে দর্শক কথা বলছিল ছবিটি সম্পর্কে। একজন বললো, ছবিতে চঞ্চল আছে। চঞ্চলের ছবি ভালোই হবে। সাথে আফসানা মিমি আছে্ন। অনেকদিন পর মিমিকে দেখতে পাওয়া আলাদা ভালো লাগার বিষয়। ফজলুর রহমান বাবু আছেন। অসাধারণ অভিনেতা তিনি।
একটু থেমে মেয়েটি পাশের মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো, আচ্ছা। ছবিতে নায়ক-নায়িকা কে? তাই-ই তো জানি না।
পাশের মেয়েটি জানালো যে, সেও জানে না। আমি পাশ থেকে বললাম, সিয়াম আর নতুন নায়িকা সুমি। তখন মেয়েটি বললো,সিয়ামও ভালো।
একটা ছবির প্রচারনা কতটা দুর্বল হলে দেখতে আসা একজন দর্শক সিনেমার নায়ক-নায়িকা সম্পর্কেই জানে না? ইমপ্রেস টেলিফিল্মস্ এ ক্ষেত্রে তাদের আগের সুনামই ধরে রেখেছে।
আরো হতাশার বিষয় হচ্ছে, ছবিটি মুক্তির দিনও সিনেমা বিষয়ক ফেসবুক গ্রুপগুলোতে সিনেমাপ্রেমীরা ব্যস্ত ছিলো অন্য একটি বড় ছবির সমালোচনায়। এতো বড় একটি বাংলা ছবি যে এ সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছে তা নিয়ে কোথাও কোন আলোচনা নেই! প্রথম দিনে রিভিউ’ও এসেছে গুণে গুণে মাত্র ২-৩টা।
অথচ ‘পাপ পুণ্য’ বাংলাদেশি ছবি হিসেবে ভীষণই ভালো একটি ছবি হয়েছে। এ ছবি নিয়ে আলোচনা করা একজন সিনেমাপ্রেমী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বলেই মনে করছি।
আমি চুলচেরা বিশ্লেষণ করার মতো বোদ্ধা সমালোচক না। সিনেমা দেখার সময়ও ভুলত্রুটি ধরার চেয়ে সিনেমাটি উপভোগ করতেই আমার মনোযোগ থাকে বেশি। তাই কোথায় ভুল ছিলো কিংবা কোথায় শুদ্ধ ছিলো সেসমস্ত চুলচেরা বিশ্লেষণের ভার বোদ্ধা সমালোচকদের কাঁধে দিয়ে বরং একজন দর্শক হিসেবে ছবিটি আমার কেমন লেগেছে সেসব নিয়ে আলোচনা করছি।
গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সবগুলো ছবিই আমি সিনেমা হলে দেখেছি। বাংলাদেশের যে কয়জন নির্মাতার নামে আমি সিনেমা হলে যাই সেলিম তাদের মধ্যে অন্যতম। তার সম্পর্কে ইতিমধ্যে আমাদের একটি ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। ছবি খুবই সহজ-সরল গল্পের এবং শেষে একটা ট্রাজেডিক ক্লাইম্যাক্স থাকে। সব ছবিতে পাপবোধ কিংবা পাপের প্রায়শ্চিত্তের বিষয় থাকে। এটাকে তার ছবির দর্শন বলা যায়।
এরপরও কিছু চরিত্র, গ্রামীণ আবহ, সুন্দর লোকেশন, দারুণ কিছু শট, উপভোগ্য দৃশ্য, গান ও সংলাপের কারণে তার ছবি অনন্য হয়ে ওঠে চমৎকার।
‘পাপ পুণ্য’ও এ সবকিছুর মিশেলে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গ্রামীণ প্রকৃতি, আবহ এবং চমৎকার ৪টি চরিত্র ‘পাপ পুণ্য’কে অন্য সাধারণ বাংলা ছবি থেকে আলাদা ও উপভোগ্য করেছে।
শুরুতেই ওপেনিং ক্রেডিটস্ অন্য রকম সুন্দর লাগে। গ্রামের ছোট্ট, সুন্দর রাস্তা। একটা মোটর বাইক চলছে। দুজন অভিনেতার কথোপকথন শুনতে পাই আমরা। চেয়ারম্যানরুপী চঞ্চল চৌধুরী এবং তার শাগরেদ সিয়াম আহমেদ। সুন্দর দৃশ্যের সাথে পছন্দের দুই অভিনেতার পরিচিত কন্ঠস্বর শুরুতেই অন্য রকম আনন্দ দেয়।
প্রথমার্ধে এভাবেই ছবির প্রধান চারটি চরিত্র বিল্ড আপ হতে দেখি। চেয়ারম্যান চঞ্চল চৌধুরীর বাড়িতেই থাকে সিয়াম এবং তার মা আফসানা মিমি। চেয়ারম্যান বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আফসানা মিমি। ছেলে সিয়াম কাজ করে চেয়ারম্যানের শাগরেদ হিসেবে।
চেয়ারম্যানের মেয়ে শাহানাজ সুমি সিয়ামের প্রতি দুর্বল। সিয়ামও সুমিকে ভালোবাসে। সিয়ামের মা আফসানা মিমি তাদের একসাথে দেখে ফেলে। তারপর সে চেয়ারম্যানের স্ত্রীকে ধরে অনুরোধ করে যেন চেয়ারম্যান তার ছেলেকে দ্রুত বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।
এভাবে দুটি ছেলে-মেয়ের প্রেম এবং তাকে ঘিরে বাবা-মায়ের ইনসিকিউরিটি আমরা ‘পাপ পুণ্যের’ প্রথম অর্ধেকে দেখি। অনেকে বলবেন, এ আর নতুন কী? যুগ যুগ ধরেইতো এ গল্প দেখে আসছি। কিন্তু ‘পাপ পুণ্য’ যেভাবে এই চারটি চরিত্রকে বিল্ড আপ করে তা ভীষণ সুন্দর। খুবই সরল এবং সুন্দর উপস্থাপনায় আমরা এই চারটি চরিত্রকে দেখি। সাথে গ্রামীণ পটভূমি আর প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়তি আবেদন তৈরি করে। সিয়াম আর সুমির রোমান্স যেমন উপভোগ্য তেমনি প্রথম অর্ধেকেই সুন্দর কয়েকটি গান রয়েছে। যারা আমার মতো রোমান্স এবং গানপ্রিয় দর্শক তাদের অবশ্যই এ ছবির প্রথমার্ধ ভালো লাগবে। সিনেমা হলে প্রায় ৫০ শতাংশ নারী দর্শক ছিলেন। নারী-পুরুষ উভয়ই এ ছবির প্রথমার্ধ উপভোগ করেছে যা তাদের রিয়েকশনে বুঝতে পারি। এছাড়া মা আফসানা মিমির ইনসিকিউরিটি খুবই মজারভাবে এসেছে প্রথমার্ধে যা সবাই উপভোগ করেছে।
ছবির দ্বিতীয়ার্ধে কিছু টুইস্ট অ্যান্ড টার্ন, ট্রাজেডি এবং অবশ্যই ক্লাইম্যাক্স রয়েছে। চেয়ারম্যান চঞ্চল চৌধুরী্র ‘পাপ পুণ্যের’ হিসেব নিয়েই এই অংশ।
আমার কাছে দ্বিতীয়ার্ধের টুইস্ট অ্যান্ড টার্নগুলো একটু বেশি সরল এবং অনেকটাই প্রেডিক্টেবল মনে হয়েছে। কেননা ট্রেলারেই আমরা ধরতে পেরেছিলাম। এখানে চিত্রনাট্যের দুর্বলতা চোখে পড়েছে। দ্বিতীয়ার্ধ যেমন স্লো তেমনি এর ন্যারেটিভ স্টাইলও দুর্বল। এই জায়গাটায় গিয়াস উদ্দিন সেলিম কিছুটা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে যারা গল্প বা গল্পের টুইস্ট অ্যান্ড টার্নগুলো আগে ধরতে পারবেন না তাদের হয়তো দ্বিতীয়ার্ধই বেশি ভালো লাগবে।
তাছাড়া ছবির দ্বিতীয়ার্ধ চঞ্চল চৌধুরীর কাঁধে ছিল। যারা চঞ্চলের অভিনয় দেখার জন্য এ ছবি দেখবেন তাদের অবশ্যই ভালো লাগবে। নিঃসন্দেহে চঞ্চল চৌধুরী এ প্রজন্মের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনেতাদের একজন। এ ছবিতেও বরাবরের মতোই দুর্দান্ত অভিনয় দেখিয়েছেন। চঞ্চলের ছবি দেখে আগেও কখনো ঠকিনি, এবারও জিতেই বের হয়েছি হল থেকে। আর কিছু না হোক অন্তত তার অভিনয় দেখে পয়সা উসুল হয়ে যায়।
চঞ্চলের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন সিয়াম। আমার এ ছবিতে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তার চরিত্রটি। গ্রামের একটি ছেলের চরিত্রে সিয়ামকে এতো সাবলীল লেগেছে যে, পর্দায় যেন আলামীনকে দেখেছি, সিয়ামকে না। সিয়ামের সেরা চরিত্রের একটি হয়েই থাকবে এটি।
আফসানা মিমিকে বহুদিন পর দেখলাম। তার চরিত্র খুবই ভালো ছিল। আমাদের অভিনেত্রীরা বয়স হলে আর ভালো চরিত্র পান না। সেখানে মিমি এ ছবিতে চমৎকার চরিত্র পেয়েছেন। তার চরিত্র এবং অভিনয় দুটোই উপভোগ্য।
আর নতুন মুখ শাহানাজ সুমির কিশোরীসুলভ কথাবার্তা, খুনসুটি খুব উপভোগ্য ছিল।
চেয়ারম্যানের স্ত্রীর চরিত্রে ফারজানা চুমকি যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন খুবই ভালো অভিনয় করেছেন। তবে পুলিশ চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবুকে সেভাবে সুযোগ দেয়া হয়নি। এ ছাড়া আরো অনেক পরিচিত মুখ ছোট ছোট চরিত্রে উপস্থিত ছিলেন তবে প্রধান চার চরিত্রকে ঘিরেই ছিল গোটা ছবি। এক হিসেবে ভালো হয়েছে। ছবির চারটি প্রধান চরিত্রই পর্দায় দাপিয়ে বেড়ানোর সূযোগ পেয়েছে।
বিশেষ করে চঞ্চল ও সিয়ামের যুগল দৃশ্যগুলো অন্যরকম ভালো লাগার জন্ম দেয়। এ যুগে সাধারণত এরকম মাল্টিকাস্টিং দেখা যায় না কিংবা দুইজন জনপ্রিয় নায়ককে গোটা ছবিজুড়ে এক ফ্রেমে দেখার সৌভাগ্য দিন দিন আসে না। আর আফসানা মিমির মতো অভিনেত্রীকে পর্দায় দাপিয়ে বেড়াতে দেখাটা ভীষণ নস্টালজিকও বটে।
সব মিলিয়ে, ‘পাপ পুণ্য’ বাংলা ছবির মান বিবেচনায় ভীষণ ভীষণ ভালো একটি ছবি হয়েছে। অবশ্যই ছবির চিত্রনাট্যে কিছু দুর্বলতা আছে। বিশেষ করে সেলিমের ন্যারেটিভ স্টাইল অতি সরল এবং অপ্রয়োজনীয়রকম ধীর গতির। এটা বড় একটা দুর্বলতা। যদি তিনি এই জায়গায়টায় আরেকটু সময়োপযোগী হতে পারেন তাহলে ‘মনপুরা’র চেয়েও বড় ব্লকবাস্টার দিতে সক্ষম হবেন। একজন নির্মাতা হিসেবে তিনি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অল্প কিছু ভালো নির্মাতাদের একজন। তার ছবি সত্যিকারের কোন সিনেমাপ্রেমীরই মিস দেয়া উচিত না। আর ‘পাপ পুণ্য’ তো আরো স্পেশাল, কারণ এটি কিছু কিছু দিক থেকে সেলিমের আগের যে কোন ছবির চেয়ে বেশি উপভোগ্য।
সকল বাংলা সিনেমাপ্রেমীকে ছবিটি সিনেমা হলে দেখার জন্য অনুরোধ করবো। বিশেষ করে যারা বাংলাদেশি অফট্র্যাকের ছবি ভালোবাসেন তাদের অবশ্যই ছবিটি ভালো লাগবে। আর পারলে কোন সিনেপ্লেক্সের পর্দায় ছবিটি দেখুন। মজা পাবেন।
আমি ইদানিং আমার রিভিউতে রেটিং দেই না। তবে ‘পাপ পুণ্য’কে রেটিং দিচ্ছি। ছবিটিকে আমি অনায়াসে ৫ এ ৪* দিবো।