Select Page

বাঙলাদেশের সিনেমার মৌলিকতম বিষয় হচ্ছে গান

বাঙলাদেশের সিনেমার মৌলিকতম বিষয় হচ্ছে গান

সেইবার রানা ভাই আসলেন। নতুন একটা ফিনিক্স সাইকেল কিনে চলে এলেন। তার নানা বাড়ি গৌরীপুর। সেখান থেকে চলে এলেন ঈশ্বরগঞ্জ। রানা ভাই আসছেন ফলত সিনেমা দেখা হবে। তখনও স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার চিন্তা মাথায় আসেনি। সাহসও হয়নি বোধ করি। পাঁচ ক্লাসে পড়ি। সোনালী টকিজে তখন চলছে ‘প্রথম প্রেম’। ওমর সানি আর মৌসুমী।

মৌসুমী দেখতে অনেকটা সন্ধ্যাদির মতো। রানা ভাইয়ের সাথে দেখতে গেলাম প্রথম প্রেম। সেই সময় সিনেমাটা ভালো লেগেছিলো। একটা দৃশ্য এখনও চোখে লেগে আছে। সন্ধ্যায় নদীতে বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে গান গাচ্ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। নীলচে আলোর প্রতিফলনে ছইওলা নৌকায় একটা বাতি নিয়ে ধীরে চলে যাচ্ছে। গানের কথাটাও সুন্দর লাগে। ‘মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে, বাত্তির নীচে অন্ধকার; এই জীবনে চাইলাম যারে, হইলো না সে আমার’। বয়স ১০-১১ তে প্রেমের অনুভূতি আসার কথা কি! সন্ধ্যাদিকে তো ভালোবাসতাম! সেটাতো প্রেম ছিলো না। নাকি প্রেম! না সে আলাপে যাবো না। আমি আসলে বলতে চাই বাঙলাদেশের সিনেমার গানের কথা।

বিশেষ করে শুরু করতে চাই নব্বই দশকের বাঙলাদেশের সিনেমার গানের কথা বলেই। প্রথমেই বলে নিই, পৃথিবীর আর আর বিষয়ের মতো গান বিষয়েও আমি অজ্ঞ। তবে এ কথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না, যদি আমি বলে ফেলি যে, বাঙলাদেশের সিনেমার মৌলিকতম বিষয় হচ্ছে সিনেমার গান। যদিও নব্বইদশকে ভারতীয় গানের সুরে সিনেমার গান হয়েছে, তবে মৌলিক গান রয়েছে ঢের। সহজ সুর, সহজ কথার গান বুকের ভেতর পরশ বুলিয়ে যেতো। যেমন ধরুন, যদি বলি মহামিলন সিনেমার গান, আমি যে তোমার প্রেমে পড়েছি…মরেছি আমি একি করেছি। কিংবা ধরেন, চাঁদের আলো সিনেমার গান: আমি তোমার চাঁদ, তুমি চাঁদেরই আলো।

বাঙলা সিনেমার গান আসলে একেবারেই জনমানুষের গান। বলা ভালো সিনেমাই এইধরণের গানকে জনমানুষের কাছে নিয়ে গেছে, বলা চলে গানের এটা আলাদা ধারা বা ধরণ। আপনি যদি ষাট-সত্তর দশকের সিনেমার গান শোনেন, দেখবেন গানগুলোতে কথা ও সুরের কী মাধুর্য। ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, কপোলের ওই তিল দেখবে যখন, তুমি যে আমার কবিতা… ইত্যাদি। আমাদের সেনা শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে বোধ করি মাধুর্য কমে আসতে শুরু করে। সেইসব আমি বলতে চাই না। আমি বলতে চাইছি নব্বইয়ের সিনেমার গানের সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে।

চাঁদনী সিনেমার গান, ও আমার জান তোমার বাঁশি বুঝি জাদু জানে কিংবা কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার ‘ও আমার বন্ধুগো’ গানটি বহুদিন বুকের ভেতর লালন করেছি। ওমর সানি কয়েকদিন আগে মে বি বলছিলেন তার গরীবের রানী সিনেমা হিট হওয়ার কথা। গরীবের রানী সিনেমা হিট হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিলো, তুমি ডাকলেও আসি, না ডাকলেও আসি গানটি। অনেক সিনেমা হিট হয়েছে গানের কারণে। মাকসুদের সেই গানটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই আপনাদের, তোমাকে দেখলে একবার, মরিতে পারি শতবার। বৃষ্টি ভেজা সেই গান। আর শাওয়ারের নীচে শাবনাজের ভিজে যাওয়া কৈশোর মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিলো। ‘বাতাস তোমার অঙ্গ ছুঁয়ে গন্ধ নিয়ে আসে’ গানের এই লাইনটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য। বহুবার আমি আমার প্রেমিকার বাড়ির আশেপাশে ঘুরে এসে ভেবেছি তাহার গন্ধমাখা বাতাস গায়ে জড়িয়ে এসেছি। মনে আছে একটা শহরের এক মেয়ে আমাকে চিঠি লিখতো, আমি তাকে দেখিনি তখনো। সেই শহরে গিয়ে মনে হতো এই শহরে বাতাসে সেই মেয়ের শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে। গানের সুর স্মৃতি ধরে রাখে।

আপনি যখন প্রথমবার কোন গানের সুর শুনবেন সেইসময়কার আবহ আপনার স্মৃতির সাথে গিঁথে যাবে। প্রাকৃতিক আবহ নয় শুধু, বলছি মানসিক আবহের কথাও। তারপর যখনই সে সুর আপনি জীবনের যে সময়ই শোনেন না কেন, সেই আবহের কিঞ্চিত আপনাকে মনে করিয়ে দেবে। যেমন ধরুন আমি যদি ভালোবাসি তোমাকে সিনেমার ‌’অনেক সাধনার পরে আমি ..’ গানটির কথাই ধরি। আমি সিনেমাটি দেখেছি ১৯৯৯ সালে। তখন দশ ক্লাসে উঠেছি। মুক্তাগাছায় তখন জারুল ফুল ফুটছিলো। আর আমি প্রথমবারের মতো প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম। এই গান আমি যতোবার শুনি, আমার মনে হয় সেই সময়টার কথা। প্রথম প্রেমের অনুভূতির মতো এতো সর্বনাশের অনুভূতি আর হয় কি!

যাইহোক, বাঙলাদেশের সিনেমার গান বোধ করি দেশের সব মানুষেরই এক অনন্য অনুভূতির নাম। শেখ সাদী খান, আলম খান, আলাউদ্দিন আলী, আবু তাহের, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল প্রমুখের সুর- গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মনিরুজ্জামান মনির প্রমুখের গীত রচনায় আমরা আমাদের অনুভূতিগুলোকে বেঁধেছি। অসংখ্য গানের কথা বলা যাবে। এক একটা গান এক একটা অনুভূতি ধরে রেখেছে। তবে একটা গানের কথা না বললেই নয়, পড়ে না চোখের পলক। এই গান এতো শুনতে হয়েছে যে, শেষে শুনলেই বিরক্ত লাগতো। রাস্তায়, বাজারে, দোকানে সব জায়গায় একই গান।

গান নিয়ে আরও কথা আছে। আরদিন বলবো।


মন্তব্য করুন