Select Page

বাণিজ্য-শিল্প দুই ধারায় সফল নায়ক রিয়াজ

বাণিজ্য-শিল্প দুই ধারায় সফল নায়ক রিয়াজ

১৯৯৫ সাল, ঈদুল ফিতর। বরাবরের মতো এই ঈদে চিত্রনায়ক জসিম নিজের প্রযোজনা সংস্থা জ্যাম্বসের ব্যানারে সিনেমা নিয়ে হাজির হলেন। আগের দুই বছরের দুটি সিনেমাই পেয়েছে সুপারহিটের তকমা। প্রতিবারের মতো এবারও তিনি নাম ভূমিকায়, সিনেমার নাম ‘বাংলার নায়ক’, সঙ্গে আছেন নিজের বাণিজ্যলক্ষ্মী শাবানা,ভিলেন হিসেবে আহমেদ শরীফ।

সুপারহিট ‘মাস্তান রাজা’র শিশুশিল্পী সোনিয়াকে নিলেন দ্বিতীয় নায়িকা হিসেবে, তারই বিপরীতে ও শাবানার ভাই হিসেবে অভিষিক্ত হন এক নতুন নায়ক। সদ্য বিমান বাহিনীর এ পাইলট অব্যাহতি পেয়েছেন। খালাতো বোন ববিতার সুবাদে এফডিসিতে এসে জসিমের সঙ্গে পরিচয়, সেই দিনের সেই নতুন নায়ক হলেন  রিয়াজ

রিয়াজের অভিষেক ঝলমলে নয়, অ্যাকশন ধারার ছবিতে দ্বিতীয় নায়ক হিসেবে পদার্পণ, স্বাভাবিকভাবেই নজর কাড়ার কথা নয়। ছবিটিও প্রত্যাশানুযায়ী ব্যবসা করেনি, তখন  হারিয়ে গেলে কেউই তাকে মনে রাখতো না। কিন্তু নিজেকে হারিয়ে যেতে দেননি। তৎকালীন সুপারহিট নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে ‘প্রিয়জন’, ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে ‘বাঁচার লড়াই’ কিংবা ‘তুমি শুধু তুমি’, ‘পৃথিবী আমারে চায় না’ ফ্লপ। তারকাবহুল হিট ছবি  ‘অজান্তে’তে নিজেকে মেলে ধরবার অত সুযোগ ছিল না। ‘মন মানে না’র গান হিট হলেও সিনেমায় যেন সাফল্য হয়ে ধরা দেয় না, তবে কি সত্যিই দমে যাবেন!

‘হৃদয়ের আয়না’ একক নায়ক হিসেবে প্রথম ব্যবসাসফল ছবি, তবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আরও বড় হিট প্রয়োজন। এলো মাহেন্দ্রক্ষণ,মুক্তি পেলো সুপারহিট ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’, সিনেমার চাইতে সিনেমার গান গুলো আরও অধিক জনপ্রিয়, আজও মুখে মুখে ফিরে।

শুরু হল নবযাত্রা, শাবনূরের সঙ্গে জুটি বেঁধে একের পর এক হিট ছবি দিয়েছেন, পূর্ণিমার সঙ্গেও দাঁড়িয়েছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় জুটি। রিয়াজ যখন চলচ্চিত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন, তখন চলছে অশ্লীলতার কালো অধ্যায়, সুস্থধারার দর্শকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেই দুঃসময়ে নায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে এনেছেন তিনি।

নব্বই দশকের শেষে কিংবা শূন্য দশকের শুরুতে যারা সিনেমা দেখতে বা বুঝতে শিখছে তাদের কাছে ‘রিয়াজ’ অবশ্যই বিশেষ একটি নাম। হবেই না বা কেন, একদিকে বিয়ের ফুল, প্রেমের তাজমহল, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ, মনের মাঝে তুমি, মোল্লা বাড়ির বউ, হৃদয়ের কথার মতো উপভোগ্য ও সুপারহিট ছবি অন্যদিকে দুই দুয়ারি, মেঘের পরে মেঘ, শাস্তি, হাজার বছর ধরে, খেলাঘর, দারুচিনি দ্বীপের মতো প্রশংসিত ছবি। বাণিজ্যিক ধারার একের পর এক ছবি যেমন তাকে জনপ্রিয় করেছে, তেমনি বিকল্পধারার ছবিতে তার অসামান্য অভিনয় নিয়ে গেছে অনন্য গ্রহণযোগ্যতায়। বিশেষ করে বলা হয়, ‘হাজার বছর ধরে’তে করেছেন শ্রেষ্ঠ অভিনয়— দুই দুয়ারি, দারুচিনি দ্বীপ, শ্যামল ছায়া, শাস্তি ছিল তার অভিনয়ের উজ্জ্বল প্রতিভার প্রমাণ।

মতিন রহমান, এফ আই মানিক, মুহম্মদ হান্নান, জাকির হোসেন রাজু থেকে চাষী নজরুল ইসলাম, মোরশেদুল ইসলাম, তৌকীর আহমেদ সবার সঙ্গেই কাজ করেছেন। স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদের একজন প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। দুইধারা মিলিয়ে এমন সামলানো নায়কই তো দর্শকদের বেশি পছন্দ। রিয়াজেরও দুর্বলের দিক ছিল মারামারির দৃশ্যে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ছিলেন না, যদিও ‘মাটির ফুল’, ‘ভালোবাসা কারে কয়’তে দারুণ ছিলেন।

গানের দিক থেকেও বেশ ভাগ্যবান রিয়াজ। যেহেতু রোমান্টিক ছবিতেই বেশি অভিনয় করেছেন, সেই কারণে গান বিশেষ গুরুত্ব পেতো। সেই ‘পড়ে না চোখের পলক’-এর মতো তুমুল সাড়া জাগানো গানই হোক কিংবা নতুন অধ্যায় শুরু হওয়া ‘ভালোবাসবো বাসবো রে’র মতো গান। অনেক সাধনার পরে, এই বুকে বইছে যমুনা, প্রেমী ও প্রেমী যেমন আছে তেমনি তুমি সুতোয় বেঁধেছো শাপলার ফুল, মাথায় পড়েছি সাদা ক্যাপের মতো শৈল্পিক গান।

সিনেমার অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকেও ছিলেন উজ্জ্বল। উড়ে যায় বকপক্ষী, জোছনার ফুল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। এর বাইরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জীবনী নিয়ে ‘অগ্নিবলাকা’সহ চৈত্র দিনের গান, ওগো বধূ সুন্দরী থেকে সর্বশেষ ‘কলুর বলদ’-এও হয়েছেন আলোচিত। বিজ্ঞাপনেও তিনি সফল তারকা। ড্যানিশের বিজ্ঞাপন তো সময় যত পেরিয়েছে, তত জনপ্রিয় হয়েছে৷ আরও আছে ইউরো কোলা, ঝিলিক পেইন্টস, নাসির গ্লাসসহ অনেক বিজ্ঞাপন।

ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা অবস্থাতেই তিনবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, দর্শকপ্রিয় থেকে সমালোচক সব মিলিয়ে সাতবার মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন।

রিয়াজ নায়ক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়, অভিনেতা হিসেবেও সমাদৃত। তবে আরও জনপ্রিয় হতে পারতেন, নিজেকে আরও বিকশিত হতে পারতেন। এই জন্য চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির যেমন ব্যর্থতা আছে, তেমনি আছে নিজের ভুল-ত্রুটিও। সিনেমা থেকে অনিয়মিত হয়ে গেছেন অনেক আগেই, তার ভক্তরা চেয়ে থাকেন কবে তিনি ফিরে আসবেন চলচ্চিত্রের পর্দায়। বিশাল বাজেটের ছবি ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ বায়োপিকে অভিনয় করবেন তাজউদ্দিন আহমেদের চরিত্রে, দেখা যাক কতটুকু প্রাপ্তি মিলে। সমসাময়িকদের মতো চাইলেই দুর্বল ছবিতে অভিনয় করে ব্যস্ত থাকতে পারেন, কিন্তু তিনি তা করেননি।  রিয়াজকে নিয়ে এটাই বেশ স্বস্তির।

১৯৭২ সালের ২৬ অক্টোবর করেন এ নায়ক। বাংলাদেশের সিনেমার সবচেয়ে প্রিয় নায়ক তিনি, তাই খুব করে চাই সবকিছু সচেতন হয়ে ফিরে আসুন চলচ্চিত্রের আঙিনায়, আপনার সিনেমা দেখে হল থেকে তৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসবো। আপনার জন্য সব সময়ই রইলো শুভ কামনা। 


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

চলচ্চিত্র ও নাটক বিষয়ক লেখক

মন্তব্য করুন