Select Page

বিমূর্ত সেই রাত্রির জয়শ্রী কবির

বিমূর্ত সেই রাত্রির জয়শ্রী কবির

‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার
মৌনতার সুতোয় বোনা একটি রঙিন চাদর
সেই চাদরের ভাজে ভাজে নিঃশ্বাসেরই ছোঁয়া
আছে ভালোবাসা আদর’

‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবির কালজয়ী গানে বিমূর্ত শিল্পের মতো এক অভিনেত্রী প্রচলিত সমাজের শ্রেণি বিভাজনকে মাড়িয়ে নিজের ভালোবাসাকে জয় করে নেন। ‘নিয়ম ভাঙার নিয়ম এ যে/থাক না বাধার পাহাড়’ গানের মধ্যকার এ লিরিকের বাস্তবায়ন করেই তিনি কালজয়ী হয়ে ওঠেন ছবিটিতে। তাঁর বিত্তশালী বাবা যখন জামাতাকে অস্বীকার করেন তিনি সোজা জানিয়ে দেন-‘তোমার কিসের এত অহংকার বাবা? ওরাই তো আসল মানুষ। সাইলেন্ট মেজোরিটি, ওরা যেদিন জাগবে তোমাদের পালাবার পথ থাকবে না।’ মার্কসবাদী দর্শনকে যেন তিনি চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা করেন মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে। হ্যাঁ, তিনি বিমূর্ত সেই রাত্রির চাঁদনী হয়ে আসা আলো জ্বালানো অভিনেত্রী জয়শ্রী কবির

‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবিতে বুলবুল আহমেদের সঙ্গে

মূলনাম জয়শ্রী রায়। অভিনেত্রী এবং প্রযোজক। জন্ম ২২ জুন ১৯৫১ সালে কলকাতায়। সেখানে সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়াশোনা শুরু। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।

১৯৬৮ সালে ‘মিস ক্যালকাটা’ খেতাব পান তিনি। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে আসেন। সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। প্রথম ছবিতে নিজের জাত চিনিয়ে দেন অসাধারণ অভিনয় করে। ১৯৭৬ সালে উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘অসাধারণ’ ছবিতেও ছিলেন। চরিত্রের ব্যাপ্তি কম থাকলেও অভিনয়টা ছিল চমৎকার।

পরিচালক আলমগীর কবিরের ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়েটা বেশিদিন টেকেনি। আলমগীর কবিরের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের সময় ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় নিউজ হয়েছিল। সম্পর্কের ব্যাখ্যা শেষ পর্যন্ত অালমগীর কবির এভাবে দিয়েছিলেন-‘অাল্লাহ ছাড়া জয়শ্রীকে বাঁচানোর আর কেউ নাই।’ বিচ্ছেদের পর একমাত্র ছেলে লেনিন সৌরভকে নিয়ে তিনি লন্ডনে চলে যান। সেখানে সিটি কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ‘রেইনবো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এর বিচারক ও সদস্য ছিলেন। লন্ডনেই থাকেন।

 

অভিনেত্রী রোজী আফসারীর সঙ্গে জয়শ্রী

পরিচালক আলমগীর কবিরকে বিয়ের পর জয়শ্রী রায় হয়ে যান জয়শ্রী কবির। চলচ্চিত্রে এটাই ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশী চলচ্চিত্রে প্রায় এক যুগের মতো কাজ করেন তিনি।

তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র – প্রতিদ্বন্দ্বী, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালি সৈকতে, পুরস্কার, শহর থেকে দূরে, মোহনা, দেনা-পাওনা, নালিশ, আজকের নায়ক, অচেনা অতিথি ইত্যাদি।

নায়ক বুলবুল আহমেদ-এর সাথে জয়শ্রী কবিরের জনপ্রিয় জুটি দাঁড়িয়েছিল। জুটিটা কিছুটা ব্যতিক্রমী ছিল। কমার্শিয়াল ছবির টিপিক্যাল জুটি ছিল না। শিল্পিত জুটি ছিল। অভিনয়কে প্রাধান্য দিয়ে এ জুটিকে আলমগীর কবির দাঁড় করান। ‘সীমানা পেরিয়ে, সূর্যকন্যা, রূপালী সৈকতে, পুরস্কার’ ছবিগুলো শিল্পসম্মত জুটিতে পরিণত করেছে তাঁদেরকে। ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবির ‘বিমূর্ত এই রাত্রি অামার’ বিখ্যাত এ গানে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন জয়শ্রী। এ গানে তিনি নারী জাগরণের পর্দা অাইকন হয়ে ওঠেন দর্শকের কাছে। ‘রূপালী সৈকতে’ ছবিতে কিছুটা রহস্যময় চরিত্র তাঁর। বুলবুল আহমেদ তাঁকে ঠিকমতো বুঝতে পারেন না এবং শেষে গিয়ে চমক থাকে। ‘পুরস্কার’ ছবিতে দুজনই ছিলেন শিক্ষকের ভূমিকায়। সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে ছেলেদের পড়ানোর দায়িত্বে থাকেন তাঁরা। এ ছবিতে জয়শ্রীকে কিছুটা মুটিয়ে যাওয়া মনে হলেও অভিনয় চমৎকার। ‘সূর্যকন্যা’-তে বুলবুল আহমেদের বিপরীতে ছিলেন না।

কয়েক বছর আগের ছবিতে জয়শ্রী

জয়শ্রী কবির ন্যাচারাল অভিনয় করতেন। ডাগর চোখের অধিকারিণী হওয়াতে চোখ আকর্ষণীয় ছিল। যেন চোখই কথা বলত। রোমান্টিক কি স্যাড সব অভিনয়ে চোখ কথা বলত তাঁর। এলোচুল ছিল বিরাট তাই চুলের সৌন্দর্যও তাঁর ছিল। তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তিনি কম ছবিতে কাজ করেছেন কিন্তু শিল্পিত অভিনয়, গল্পের ছবি করেছেন যেখানে সমসাময়িক অন্যান্য নায়িকাদের থেকে আলাদা ছিলেন। ‘সূর্যকন্যা’ ছবিতে জোছনারাতে সমুদ্র সৈকতে ইংরেজি কবিতার সাথে তাঁর নৃত্য পরিবেশন ছিল আইকনিক। ছবির সেরা একটি মুহূর্ত বলা যায়। ভালো করে খেয়াল করলে পরিচালক আলমগীর কবির সিকোয়েন্সটিতে কিছুটা হলেও অ্যানিমেশন ব্যবহার করেছেন যার জন্য জয়শ্রীকে ব্যতিক্রমী লেগেছে। জোছনা রাতের সাথে সমুদ্রের জলের চকচকে আবহ ছিল অদ্ভুত রকমের সুন্দর। ছবিতে জয়শ্রীর নায়ক ছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা সৈয়দ আহসান আলী সিডনী (অভিনেতা জিতু আহসানের বাবা)। তাঁর সাথে ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ গানে গাড়ির ভেতর জয়শ্রীর দেয়া রোমান্টিক এক্সপ্রেশনগুলো জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতার ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’ উপমার কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ছবিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে ১৯৭৫ সালে বাচসাস পুরস্কার পান তিনি।

 

২০১৮ সালে লন্ডনের একটি উৎসবে ‘ভুবন মাঝি’ সিনেমার টিমের সঙ্গে জয়শ্রী

যেতে যেতে জয়শ্রী কবির-কে চলচ্চিত্রে একটা বিশেষণেই ডাকা যায় ‘অল্পের মধ্যে বেশি কিছু।’


Leave a reply