বীরকন্যা প্রীতিলতা: সবল কনটেন্ট, দুর্বল টেক্সট, দুর্বলতর নির্মাণ
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’ পড়া ছিল না। গত কয়েকদিনে সময় বের করে পড়ে নিলাম। পড়াটা ছিল উদ্দেশ্যমূলক। কারণ সম্প্রতি ওই উপন্যাসকে ভিত্তি করে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ নামে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন প্রদীপ ঘোষ।
প্রদীপ ঘোষ আমার দাদা হন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর সঙ্গে ওঠাবসা। তাকে জানি ও চিনি। চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক স্বপ্ন তাঁর। আমাদের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক বলয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের যুক্ততা রয়েছে। ছবিটা মন থেকেই বানাতে চান— এইটা তার সদগুণ। তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শাটল ট্রেন’ দেখেছিলাম দুয়েক বছর আগে। দেখার পর হলের বাইরে আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছবি কেমন হয়েছে? কোনো রকম ভনিতা না করে উত্তর দিয়েছিলাম— আপনার আরও প্রস্তুতি নিয়ে ছবিটা বানানো উচিৎ ছিল। তিনি সেদিন কিছু বলেননি। সম্ভবত উচ্ছ্বসিত প্রসংশা না পেয়ে মন খারাপ করেছিলেন। আমিও আর আলাপ এগিয়ে নিইনি। কারণ— কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
এরপর দুয়েক বছরের বিরতি শেষে অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে এবার প্রেক্ষাগৃহে আসলো তাঁর ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’। আমি সত্যিই অপেক্ষায় ছিলাম ছবিটার জন্য। বেশ উত্তেজনা নিয়েই হলে ছবিটা দেখতে যাই। কিন্তু আবারও হতাশ করলেন প্রদীপ দা। এবার তিনি হলের সামনে ছিলেন না। তিনি যদি হলের সামনে দাঁড়িয়ে আবারও আমার কাছে জানতে চাইতেন— ছবিটা কেমন হয়েছে, আমি এবারও কোনো ধরনের ভনিতা ছাড়া জবাব দিতাম- দাদা, এবার ছবি বানানোটা স্থগিত করে ছবি দেখা শুরু করেন।
ভাই ব্রাদাররা ছবি বানাবেন, আর কোনো ধরনের গঠনমূলক আলোচনা ছাড়াই পাশ চাপড়ে বলব- দুর্দান্ত হয়েছে! অসাধারণ! স্পিচলেস! এমন কাজ আগে কখনো হয়নি, এটাই প্রথম! এইসব অর্থহীন অতিভাষণ প্রকাশ করে কারো সাড়েসর্বনাশ করার দুরভিসন্ধি আমার নেই।
সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা’ পড়েছিলাম আজ থেকে বিশ/বাইশ বছর আগে সম্ভবত কোনো পত্রিকার ঈদ সংখ্যায়। পড়ে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিলাম। ওই সময়ই পড়ে ফেলেছিলাম ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’সহ আরও কয়েকটা উপন্যাস। দুর্দান্ত লেগেছিল। কিন্তু প্রায় ২০ বছর পর যখন সেলিনা হোসেনের ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’ পড়তে বসলাম, তখন সেই আগের মুগ্ধতা আর কাজ করছে না। পড়ে মনে হচ্ছিল, ‘ছোটদের প্রীতিলতা’ জাতীয় বই পড়ছি। যদিও ক্ল্যাসিক্যাল কিশোর উপন্যাসও এর চেয়ে গভীর ভাষা ও বোধসম্পন্ন হয়। কিন্তু ‘ভালবাসা প্রীতিলতা’ উপন্যাসটাতে ক্লিশে দৃশ্যকল্পনা, দুর্বল ভাষা-বিবৃতি আর শিশুতোষ সংলাপের মধ্য দিয়ে সূর্যসেন, প্রীতিলতা, রামকৃষ্ণ, কল্পনা দত্তের মতো চরিত্রগুলোর দৃঢ়তা, গভীরতা আর গন্তব্য হরণ করা হয়েছে। ফলে এই টেক্সট অনুসরণ করে যখন পরিচালক প্রদীপ ঘোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তখন স্বভাবতই এরও গভীরতা ও গন্তব্য হারিয়ে গেছে।
ছবিটা বানাবার ক্ষেত্রে পরিচালক প্রথম মারটা খেয়েছেন সেলিনা হোসেনের এই দুর্বল উপন্যাস নির্বাচন করে। দ্বিতীয় মার খেয়েছেন ওই উপন্যাসকে অনুসরণ করতে গিয়ে। এরপর শেষ মার খেয়েছেন, চলচ্চিত্র সম্পর্কে নিজের বোঝাপড়াজনিত অর্থাৎ নির্মাণগত দুর্বলতায়। উপরোল্লেখিত তিনটি দুর্বলতার একটিও যদিও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতো তখন সম্ভবত আমাকে এভাবে লিখতে হতো না।
১৯৩০-এর চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ অর্থাৎ মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে স্বদেশী বিপ্লবীদের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল, ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ, কয়েকদিনের জন্য চট্টগ্রামকে বৃটিশ রাজ থেকে স্বাধীন করে রাখার ঘটনা ইতিহাসে বীরত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। নিঃসন্দেহে ভারতের ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে মাস্টারদা ও তার সঙ্গীদের বীরত্ব এবং আত্মত্যাগকে মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাস্টারদা সূর্যসেন, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেষ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, রামকৃষ্ণ, কল্পনা দত্ত, প্রীতলতা একেকটি জাজ্বল্য প্রেরণার নাম। এঁদের গল্প ও জীবন যে কোনো পুরাণের বীরদেরও ছাপিয়ে যায়। ফলে এঁদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কারণ কোনো কারণে ওইসব চরিত্রের ব্যক্তিত্ব, নিজস্বতা, ঐতিহাসিকতা, ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ চলন, গতি ও গভীরতা এবং সর্বশেষ প্রতিটি চরিত্রের গন্তব্য যথাযথভাবে স্পষ্ট না হলে গোটা উদ্যোগটাই মাটি হয়ে যায়। যে কোনো ঐতিহাসিক ঘরানার সাহিত্য, চলচ্চিত্র নির্মাণে এ ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। লেখক ও নির্মাতাকে সে ঝুঁকির পুলসিরাত পার হতে হয় পারঙ্গমতার সঙ্গে। এই ধরনের কাজে হাত দিয়ে পরিচালকের এমন বক্তব্য দিয়ে পার পাবার কোনো সুযোগ নাই যে- চেষ্টা করেছি, এই ধরনের কাজ প্রথম, বাজেট কম, ভাল অভিনেতা নাই, সময় কম ছিল, তাড়াহুড়া ছিল, সামনেরবার চেষ্টা করব। এইগুলা হবে বালখিল্যতা। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে হাত দেওয়ার আগে তো ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। তারপর কাজ হাত দিতে হবে।
‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ ছবি দেখার পর মনে হয়েছে পরিচালক এই কাজকে কোনোরকম ঝুঁকিই মনে করেননি। মনে করেননি এই ঐতিহাসিক ঘটনানির্ভর ছবির প্রতিটি চরিত্রের পর্দার রূপায়ন ঘটাতে হবে বিশ্বাসযোগ্য ও চমৎকারিত্বের সাথে। ছবিতে অভিনেতাদের অভিনয় দেখে মনে হচ্ছিল পাড়ার ক্লাব পর্যায়ের বার্ষিক নাটকের অভিনেতারা মঞ্চে পাট করছেন। এমনকি হাল আমলের জাঁদরেল অভিনেত্রী প্রীতিলতা নাম ভূমিকায় অভিনয় করা ‘তিশা’ও এর বাইরে নন। রামকৃষ্ণ চরিত্রের মনোজ প্রামাণিক তো ননই। তাইলে তারা কি ভাল অভিনয় এর আগে করেননি? করেছেন। কিন্তু ভালবাসা প্রীতিলতায় জাস্ট ক্লিশে। জাস্ট দায়সারা। এ দায় কার? নিশ্চয় পরিচালকের। পরিচালক যেভাবে চাইবেন সেভাবেই ক্যামেরায় ধরা পড়বে প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি স্থান, ঘটনা ও কালপ্রবাহ। পরিচালকের চোখ দিয়েই গোটা টিমের কলাকূশলীরা ছবিটাকে বানান।
চিত্রনাট্য, সংলাপ, কস্টিউম, সেট ডিজাইন, মেকাপ, লাইট, চিত্রধারণ, ভিএফএক্স— এ ছবির কোনোটাই সাধারণ নিক্তি পার হতে পারেনাই। এ ছবির এইটাই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর কারণ মনে হয়েছে- পরিচালকের টোটাল ছবিনির্মাণ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুতির অভাব।
ঐতিহাসিক ঘটনা বাদই দিলাম, সাধারণ ঘটনার সাধারণ চরিত্র হিসেবেও যদি সিনেমার পর্দায় কোনো পারসোনালিটিকে প্রদর্শন করা হয়— তাকে এমনভাবে প্রদর্শন করতে হয় যেন তার ব্যাপারে দর্শকের মিনিমান আগ্রহ তৈরি হয়। সেখানে এমন একটা ঐতিহাসিক ঘটনার ঐতিহাসিক কিছু চরিত্রকে হাজির করা হচ্ছে জাস্ট মামুলি, দুর্বল ও নেতানো পারসোনালিটি হিসেবে। যেখানে ওইসব চরিত্র আগ্রহের বদলে বিরক্তিই উৎপাদন করেছে। এটা হয়েছে মূলত ওই পারসোনালিটিকে বোঝা এবং ইতিহাসের নিরীখে তাকে পর্যবেক্ষণের ঘাটতির কারণে। তারসঙ্গে সিনেমাটিক ওয়ে অব ক্যারেক্টার অ্যাপিয়েরেন্স সম্পর্কে সচেতন ধারণা না থাকার ব্যাপরটিও যুক্ত।
তিরিশের চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের যতগুলো নারী চরিত্র আছে সেখানে কল্পনা দত্ত সীমাহীন বোল্ড একটা চরিত্র। এমনকি প্রীতিলতার চেয়েও বোল্ড। যেহেতু বীরকন্যা প্রীতিলতা গল্পটার কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রীতিলতা সেহেতু প্রীতিই এখানে মেইন প্রোটাগনিস্ট। কিন্তু কল্পনাকে এখানে বারবার প্রীতির অনুবর্তী বা প্রীতির চেয়ে নেতানো চরিত্র হিসেবে হাজির করাটা ইতিহাস ও ওই চরিত্রের প্রতি অবিচার বলে মনে করি। সেইসঙ্গে সূর্যসেনের মতো এমন একটা অসম্ভব রকম দৃঢ়চেতা ও বিপ্লবী পারসোনালিটিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে আরও একটা অবিচারের সম্মুখীন হলো ইতিহাস।
চে’র সাইকেল নামের আরণ্যকের নাটকটা দেখেছিলাম। মামুনুর রশীদ চে’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ওই নাটকের বিধ্বস্ত, পর্যূদস্ত, আর বার্ধক্যে ভরা চে’কে আমি মানতে পারিনি। বছর দশের আগে চে’র জন্মদিন উপলক্ষে নাটকপরবর্তী একটা মুক্ত আলোচনায় মামুনুর রশীদকে প্রশ্ন করে বসেছিলাম— আপনি চে’কে আবিস্কার করতে গিয়ে চে’র মধ্যে মামুনর রশীদকে ঢোকানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন টানা দেড় ঘণ্টা। এটা কি সমীচীন হলো? তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে অন্য উত্তর দিয়েছিলেন। বোধহয় প্রশ্নটা বিব্রতকর ছিল তাঁর জন্য। তাঁর মতো মানুষকে বিব্রত করার অপরাধে অনেকদিন আমি অনুশোচনায় ভুগেছি। সবখানে আমার এইভাবে গাল পেটানো উচিৎ নয়। এটা এক ধরনের বেয়াদবি। সে যা হোক— সে নাটক কিন্তু অনেক দিক থেকেই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল জাস্ট মামুনুর রশীদের ওই গলদটা ছাড়া।
এখানে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’য় সূর্যসেনের চরিত্রায়ন দেখে আমি কিছুটা ক্ষুব্ধও বটে। যদি বাস্তব সূর্যসেন ওইরকম নেতানো, ক্লিশে এবং সারাক্ষণ ভয়ে তটস্থ চরিত্রও হয় ইতিহাসের ওই দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সূর্যসেনকেই আমি দেখতে চাইবো। ইতিহাসের সূর্যসেন একটা অমর আখ্যান। একটা সীমাহীন বীরত্বে উদ্ভাসিত দৃঢ় আর শান্ত চরিত্র। ইতিহাসের কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা দুর্দান্ত প্রেরণদায়ী সাহসী চরিত্র। এঁদের আবেগ, ভাষা, সংলাপ শিশুতোষ বা ঊনচিন্তাসম্পন্ন রাজনৈতিক সংকল্পকে কোনভাবেই নির্দেশ করে না। এঁরা সব মানকে ছাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা উচ্চতর আসনে। ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ তাঁদেরকে সেখান থেকে টেনে খুব নিম্নস্তরের রাজনৈতিক রুচির মধ্যে বেঁধে ফেলেছে। এটাতে সেলিনা হোসেনের যেমন ঘাটতি দৃশ্যমান হলো তেমনি নির্মাতা প্রদীপ ঘোষের দুর্বলতাও প্রকাশিত হলো। যদি নির্মাতা ইতিহাস ও শিল্পের প্রতি গভীর অভিনিবেশী হতেন তবে প্রীতিলতাকে নিয়ে চিত্রনাট্য রচনায় যথেষ্ঠ যত্নশীল হতেন। এমনকি সেলিনা হোসেনের গল্পের লাইন আপ ধরেও ওইটাকে পুননির্মাণ করতে পারতেন। সেটা তিনি করেননি। কেন করেননি আল্লা মালুম।
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ নিয়ে চলচ্চিত্র রেফারেন্স হিসেবে হিন্দি ভাষায় নির্মিত আশুতোষ গোয়র্নিকরের ‘খেলে হাম যে জান সে’, এবং বেদব্রত পাইনের ‘চিটাগাং’ ছবিটা ছিল। ছবি দুইটা নিয়ে খুব উৎরে গেছে বলে মনে করি না। তবে যেহেতু দুইটা কাজ সামনে আছে সেহেতু নির্মাতা প্রদীপ ঘোষের জন্য স্বাভাবিকভাবেই চ্যালেঞ্জটা আরো কঠিনতর হয়ে উঠেছিল বলা যায়। চলচ্চিত্র দুইটাতে দুই ভিন্ন কোন থেকে চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের ঘটনাকে দেখানো হয়েছে। তাই অন্য কোন থেকে অন্য ভঙ্গিমায়, অন্ন ভাষায় নানা চমৎকারিত্বের মধ্য দিয়ে ভালবাসা প্রীতি ছবিটা বানাবার বিষয়ে ভাববার অবকাশ ছিল তাঁর। এমন কনটেন্ট নিয়ে যেনতেনভাবে ছবি বানানোর দায় তিনি কাঁধে না নিলেও পারতেন। তিনি নিয়েছেন, সাহস করেছেন- এ ধরনের বালখিল্য আলাপ দিয়ে নির্মাতাকে কোনোভাবেই দায়মুক্তি দিতে আমি পারি না। কারণ এ ছবি আমাদের আর্কাইভে থাকছে। এ ছবি একদিন আর্কাইভাল ভ্যালু নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র ইতিহাসে দাঁড়াবে। তখন আমাদের সময়ের দর্শক ও ক্রিটিকদের প্রতিক্রিয়াও জানতে চাইবে আগামী দিনের দর্শক ও প্রজন্ম। সেখানে কেউ দায়মুক্তি পাবেন না। না পরিচালক, না দর্শক, না ক্রিটিক। তাই বর্তমানের নির্মাণগুলো নিয়ে বৌদ্ধিক আলাপ ছাড়া বিকল্প কোনা আলাপ আসলেই অর্থহীন।
আমরা দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে সম্প্রতি বেশ সচেতন। ভাল ছবি দিনদিন বাড়ছে। ভাল নির্মাতা আসছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। যেহেতু চলচ্চিত্র মাধ্যমটা নিঃসন্দেহে জাতীয়ভিত্তিক একটা গণমাধ্যম সেহেতু এই মাধ্যম নিয়ে সচেতন চলচ্চিত্র কর্মী, বোদ্ধা, এমনকি দর্শকদেরও মুক্তভাবে মতামত দেওয়ার অধিকার আছে। এ অধিকার খাটাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে নির্মাতাসহ কলাকুশলীদের নিয়ে তীর্যক বা চাঁছাছোলা মন্তব্য করতেও ছাড়েন না অনেকে। এটা ভাল। এ ধরনের পরিবেশ থাকা উচিৎ। কারণ– সিনেমার একজন নির্মাতা বা প্রযোজক, বা কলাকুশলীরা দিনশেষে জাতীয় এ গণমাধ্যমে এই দেশের জনরুচি, তার মান, ভাষা, শিল্পচিন্তা, সৌন্দর্যবোধ, সাংস্কৃতিক উচ্চতাকেই তুলে ধরেন। কোনো কারণে নির্মাতা যদি তাঁর নির্মাণে এসব জিনিসের ক্লিশে বা ঊনশৈল্পিক উপস্থাপন ঘটান তাতে দর্শকের আঁতে লাগে। কনটেন্ট যতই মহৎ হোক না কেন, তার পরিবেশন যদি ক্লিশে হয় তা শিল্পের নিক্তিতে গার্বেজ হতে বাধ্য। এসব গার্বেজ নিয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভূমিতে হাঁটবার কোনো সুযোগ থাকে না।
প্রসঙ্গক্রমে বলি— দুয়েকজন ব্যতিক্রম বাদে আমাদের দেশের হাল আমলের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সবথেকে বড় ঘাটতির জায়গাটা বুদ্ধিবৃত্তিরই। এঁদের নির্মাণের দিকে তাকালেই আমাদের টোটাল চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তির সংকট দৃশ্যমান হয়। সেইসঙ্গে এটাও দৃশ্যমান হয়, আর্ট নিয়ে তাদের বোঝাপড়ার জায়গাটা কতটা আছে বা নেই। প্রদীপ ঘোষ চারুকলায় পড়েছেন। আর্ট নিয়ে বোঝাপড়া অন্তত তার ভালই— এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু কই? আমার বিশ্বাস ধরা খেলো কেন? আমি তো প্রতিটি ফ্রেমে একেকটা চিত্রভাষ আশা করেছিলাম। আশা করেছিলাম- প্রতিটি দৃশ্য হয়ে উঠবে সাবজেক্ট আর অবজেক্টের দুর্দান্ত কম্পোজিশন। আশা করেছিলাম- শাটল ট্রেনে হতাশ হয়েছি, বীরকন্যা প্রীতিলতায় আশাবাদী হয়ে উঠবো। না প্রদীপ দা সেটা আমাকে হয়ে উঠতে দেননি। এই ছবিটা দেখার পর অনুধাবন করতে পারলাম— চেতনা সব সময় বস্তুকে যথাযথ বিচার করতে পারে না। মাঝে মাঝে চেতনা বস্তুকে ভুলভাবেও দেখে। ভুলভাল গতিও দেয়।
আরেকটা অনুভব হলো— আপনি কোনো বিষয়ে ভাল বলেন, তার মানে ওই জিনিসটা আপনি ভাল করতে পারবেন এমনটাও নয়। আমার দেখা চলচ্চিত্রের এমন শিক্ষকও আছেন যাঁরা ক্লাসে দুর্দান্ত বলেন। কিন্তু তাঁদের নির্মাণ খুবই দুর্বল। আমাদের দেশে এমন বামপন্থী রাজনীতিক দেখবেন তত্ত্বে দুর্দান্ত, কিন্তু সংগঠন গড়ে তোলার বেলায় একদম গোবরগণেষ। প্রদীপ দা বলেন ভাল। আমি তাঁর গোছানো বক্তৃতার ভক্ত। কিন্তু তাঁর নির্মাণের ভক্ত হতে গিয়ে বারবার হতাশ হই। তো সেই অর্থে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ ছবিটা আমার কাছে হতাশার স্মারক হয়েই থাকলো— এই কথাটা আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলে গেলাম।