‘বড় ছেলে’ হওয়ার জ্বালা
টেলিফিল্ম : বড় ছেলে
রচনা ও পরিচালনা : মিজানুর রহমান আরিয়ান
অভিনয় : অপূর্ব, মেহজাবিন, খালেকুজ্জামান প্রমুখ।
প্রচার : ঈদুল আজহা ২০১৭
নিজের ভালোবাসাকে কেউ বিসর্জন দিয়েছেন কি?
আমি দিয়েছি। আমাকে বাধ্য করা হয়েছে। শেষ দেখা করার সময় আমরা দুজন দুজনকে সরি বলেছিলাম আমাদের ভালোবাসার সম্মানে। সব বাস্তবতা এক হয় না তাই আমারটাও এক হয়নি। ‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্মের বাস্তবতা নিজের গল্পেই আলাদা হয়েছে।
এই প্রথম কোনো নাটক দেখতে গিয়ে এতটা সময় লেগেছে। বারবার টেনে দেখতে হয়েছে ইমোশনাল টাচগুলোকে খেয়াল করতে। পাছে কোনোটা মিস হয়ে যায় এই ভয়ে। প্রায় এক ঘণ্টা তেত্রিশ মিনিটের টেলিফিল্মকে দেখতে হয়েছে দুই ঘণ্টার মতো করে। দেখতে দেখতে চোখ ভিজে গেছে যা ছিল গল্পের ও অভিনয়ের শক্তি।
আমি মধ্যবিত্তকে ভালোবাসি যদিও মধ্যবিত্ত আমাকে শেষ করে দিয়েছে – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
সমাজের তিনটা প্রধান শ্রেণির মধ্যে একমাত্র মধ্যবিত্তের বাস্তবতাই কড়াভাবে নিকৃষ্ট এবং সম্মানের। ভাবছেন নিকৃষ্ট আর সম্মান পাশাপাশি থাকে কি করে! হ্যাঁ, থাকে। প্রথমটা হচ্ছে বাস্তবটা এত নির্মম থাকে যে সেটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভাবতে নিকৃষ্ট বলতেই হয় আর সম্মান থাকে সেখানেই যেখানে মধ্যবিত্তের বাস্তবটা থেকে জীবনদর্শন মেলে। নাটকের দুর্দিনে যখন ‘নাটক হচ্ছে না, নাটক হচ্ছে না’ রব ওঠে তখন সেইসব দর্শককে চোখে আঙুল দিয়ে এ নাটকটির কথা বলতে হচ্ছে। যদি ভুল না করি এটা যেনতেন নাটক নয়, মাস্টারপিসই বটে।
‘রাশেদদের চোখের পানি মুছে ফেলতে হয়। তাদেরকে হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে হয়’ ব্যাকগ্রাউন্ড ভয়েসে এ কথাটা যখন ভেসে আসে সমাজের অসংখ্য রাশেদ তখন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে। নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে যখন রাশেদ তার ঘরে আসে পরিবারে মা, বাবা, ভাই, বোন সবাইকে ব্যস্ত দেখে তাদের মতো করে সেখানেই তাকে থিতু হতে হয়। তাকে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে অভ্যস্ত হতে হয়। রাশেদরা নিকৃষ্ট তাদের বাস্তবতায় আবার রাশেদরাই সম্মানজনক ব্যক্তি তাদের জীবন থেকে নেয়া গল্পে আর দশজনের জন্য।
একটা নাটককে সাজাতে কতটা যত্নবান হতে হয় নির্মাতাকে? আয়োজন খুব বর্ণিল হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ন্যাচারালিটি দিয়ে ইমোশনকে ছুঁয়ে যেতে পারলে সেটার থেকে ভালো কিছু হয় না। লোকে বলে আবেগ আর যুক্তি বাস্তবতা থেকে তফাত করে দেয় আর আমি বলি আবেগ ও যুক্তি দুটোই বাস্তব। একটার কারণে আরেকটা আসে, আসতে বাধ্য। এ দুটি মৌলিক উপাদানকে নাট্যকার সাজিয়েছেন নিজের দর্শনে। রাশেদ বা অপূর্ব যখন দেখল তার মধ্যবিত্ত পরিবারটি তারই দিকে চেয়ে থাকে, তার বাবার অবসরের সময় ঘনিয়ে এসেছে চাকরি থেকে, তার বোন নিজের সংসার থেকে চলে আসার পর নিজের মতো করে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, ছোট বাচ্চাটার চকলেট লাগে, ছোট ভাইটার পড়াশোনা চলে তার মাধ্যমে তখন তাকে কঠোর হতেই হয়েছে। এখানে আবেগের থেকে যুক্তি ছিল প্রধান। মেহজাবিনের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কটাকে ঠিক রেখে দুজনের স্বার্থে দুজন আলাদা হয়ে যাওয়াটাই উচিত মনে করে। বাবার পছন্দ করা পাত্রকে বিয়ে করতে বলে। দুজন দুজনকে ভালোমতো জেনেবুঝে আলাদা হওয়ায় শান্তি আছে সেখানে অনেকদিন পর দেখা হলে অন্তত শ্রদ্ধাটা থাকবে। অালাদা হবার কথাটা অপূর্ব নিজমুখে ভালোবাসার মানুষকে বলেও ফেলে নির্দ্বিধায়। মানসিক শক্তি তার প্রচণ্ড। মেহজাবিন সেটা শুনে প্রথমত অবাক এবং পরে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। যাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসা যায় তাকে বিসর্জন দিতে বুকের ভেতরটা মোচড় দেবে না এ হতেই পারে না।
একটা দিন।
একটা জীবনদর্শন।
শুধু একটা দিন উপহার চেয়েছে মেহজাবিন। একটা দিনে অপূর্ব তার প্রেমিকার জন্য যা যা করত সব করতে বলে মেহজাবিন। মেয়েটা জানে সে আর তার ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পাবে না অন্যসব দিনের মতো। আগের মতো বাদাম আনা, কার রেস্টুরেন্টে করে খাইয়ে দেয়া রান্না করা খাবার এসব থাকে অন্যসব দিনের মতো। কথা দেয়া থাকে কাঁদা যাবে না কিন্তু ছেলেতে, মেয়েতে একটা তফাত থেকেই যায় বাস্তবে। ছেলেরা যত পাথরই হোক মেয়েরা না কেঁদে থাকতে পারে না। প্রথমত মেহজাবিন কাঁদে, পরে অপূর্বও কাঁদে দুজনের কান্নাটা দুইরকম। মেয়েটির উচ্চস্বরে ছেলেটির নীরবে। মানুষে মানুষে ইমোশন প্রকাশের ভিন্নতা দেখা যায় এতে করে। উপহারপর্বটা ছিল আরেক চমক। চমকটা বেদনার অথচ তাকিয়ে থাকার আনন্দ দেয়। এসময় মেহজাবিনের কান্না বা অপূর্বর এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করার সাথে আপনি দর্শক হয়ে নিজের কান্নাটা সামলাতে পারলেও ভালো, না পারলেও ভালো। কারণ সামলাতে পারলে আপনি বেশ বাস্তববাদী আবার সামলাতে না পারলেও আপনি বাস্তববাদী। দুটোই মানুষের আচরণ। মেহজাবিন ঘড়ি দেয় অপূর্বকে পছন্দ হলে যাতে পরে, মোবাইল দেয়, ডায়েরি দেয় যাতে তাকে মনে পড়লে মনের কথাগুলো সাজিয়ে লিখে রাখে, অনেকদিন বাদে ডায়েরিটা সে ফেরতও নেবে তখন সে পড়বে অপূর্ব কি কি ভাবত তাকে নিয়ে। অসাধারণ চিন্তাভাবনা। ‘শোনো, নিজের যত্ন নেবে। সবার সাথে ভালোভাবে থাকবে।’ ‘তাই তোমার খেয়াল’ গানটা তখন আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, চাইলেও আর খেয়াল আগের মতো রাখতে পারবে না সে। প্রেমিকার দেয়া শর্তের ভেতর কোনো কঠিন কিছু নেই। সব ভালোবেসে বলা। তারপর ডুকরে, ফুঁপিয়ে কেঁদে মেহজাবিনের চলে যাওয়া। যার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে তার অনেক টাকা, গাড়ির দরজা খোলার জন্য আলাদা লোক থাকে তাদের, রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই অথচ সে সব বিলাসিতা রেখে অপূর্বকেই ভালোবেসে পেতে চেয়েছিল জীবনে। অপূর্বর সামনে কাঁদলে শর্ত ভঙ্গ হয় এ ভয়ে তাকে গাড়ি থেকে নামতে বলে একাকী কাঁদে। আবার তার সামনেও কাঁদে মন মানে না তাই। সব চাওয়া যে পাওয়া হয় না সে তো সবাই জানে। ভালোবাসার মানুষের সাথে ব্রেকআপ তো কতোই হয় কিন্তু এটা কি ছিল? এটা তো মধুর ব্রেকআপ।
অফিসের কর্তা যখন স্কুল শিক্ষকের ছেলে অপূর্বকে চাকরির জন্য ডেকে ফর্মালিটি সারতে অভিনয় করে আর মিথ্যা বলে যে তার পোস্টে অন্য কাউকে নেয়া হয়েছে সেটা আড়াল থেকে শুনে ফেলে অপূর্ব। এই বাস্তবতা তো রোজ হচ্ছে। ভালো রেজাল্ট করে কয়জন ভালো চাকরি পাচ্ছে! টিউশনি করে, কোচিং এর ক্লাস খোঁজ করে সংসার চালাতে হয়। ছোটভাইয়ের পিকনিকের জন্য টাকা মায়ের হাতে দিয়ে অপূর্ব যখন বলে-‘ওবে বোলো বাবা দিয়েছে।’ বাবা তো সংসারের বাজে খরচ ভেবে ছোটছেলেকে শাসন করে পিকনিকে যাওয়া বারণ করে। তখন বড় ভাই ছোটভাইয়ের ইমোশনকে ভাবে। বাবার কাজটা বড়ভাই করে। মা তখন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে চোখে ভাসা ভাসা অশ্রু নিয়ে। এই হচ্ছে বড় ছেলের জীবন।
অভিনয়ের কথা আর কি বলব! মেহজাবিনের কান্না দেখে বাস্তবের কান্নাকেও হার মানিয়ে যাচ্ছিল। বারবার টেনে দেখার মতো কান্না। ভীষণ নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিল ভেতরটা। এই প্রথম সুইচ অন অফ করে মুহূর্তে অ্যাটিচিউড পরিবর্তন করে অভিনয় দেখলাম তার। বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে সে রাজি যখন আগের আবেগী মেহজাবিন সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে অপূর্বের কাছে একটা দিন উপহার চাইল। অপূর্ব তো কান্না চেপে রেখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাঁদল। ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে ঘরে ফিরে সবার দিকে তাকিয়ে যে এক্সপ্রেশনটা দিল ওটা ছিল জীবনমুখী। মা, বাবা, বোন সবাই বাস্তবের অভিনয়টা করেছে।
এই মাস্টারপিস দেখার পরেও নাট্যকার ও নির্মাতা মিজানুর রহমান আরিয়ানের সাথে একটা দ্বিমত আছে। দ্বিমত বলতে একটা স্পেসিফিক প্রশ্ন আছে।
– ‘বাড়ির বড় ছেলেকেই কি শুধু স্যাক্রিফাইস করতে হয় নাকি ক্ষেত্রবিশেষে ছোট ছেলেকেও করতে হয়?’
উত্তরটা অনেকেরই জানা আছে। জানি বড় ছেলের দিকে পাল্লা ভারি হবে তবে আমি যখন এ নাটকের দর্শক আমার পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে আমি বাড়ির ছোট ছেলে হয়েও স্যাক্রিফাইস করেছি অনেককিছুই। ‘বড় ছেলে’ টেলিফিল্ম আমাকে নিজেকে আরো জানতে, বুঝতে, শক্ত হতে সাহায্য করেছে। এ ছোট ছেলের জন্য ‘বড় ছেলে’ বড় কিছু।