ভয়ংকর সুন্দর : একটি নাতিশীতোষ্ণ পাঠ
‘ভয়ংকর সুন্দর’ নামের ১৩০ মিনিটের এই সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ, অসাধারণ সব ফ্রেম, অসাধারণ আলোছায়া। কিছু কিছু ফ্রেমে রেমব্রান্টের আঁকা ছবির মতো আলোছায়ার সন্ধান মেলে। মাঝে মাঝে আমার মনে পড়ে যায় সিনেমাটোগ্রাফির জাদুকর ক্রিস্টোফার ডয়েলের কথা।
দেশে ড্রোন আসার কল্যাণে অসাধারণ সব এরিয়াল শট আমরা সিনেমায় দেখতে পাই। আলাদাভাবে পাঠ করলে সুন্দর। তবে তুলনা করলে মনোটোনাসই ঠেকে। কেননা একই টাইপের শট ইদানীংকার প্রায় সব বাঙলা সিনেমাতেই আমরা দেখতে পাই।
যাইহোক এই সিনেমার ডিওপি খায়ের খন্দকারেরকে শুরুতেই ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না। আর এডিটর রতন পালের সম্পাদনা প্রশংসা পাওয়ার মতো। রানটাইম স্ক্রিপ্ট অনু্যায়ী একদম ঠিকঠাক ছিলো, কালার কারেকশনেও ছিলো খুবই ভালো।
আর ডিওপি আর এডিটর যদি ডিরেক্টর দ্বারা বহুল পরিচালিত হয়ে থাকেন তাহলে ডিরেক্টর অনিমেষ আইচকেও ধন্যবাদ। যদিও আমি একটু পরে তার সমালোচনা করতে যাচ্ছি।
‘ভয়ংকর সুন্দর’ অনিমেষ আইচ পরিচালিত দ্বিতীয় সিনেমা। যদিও তার প্রথম সিনেমা ‘জিরো ডিগ্রি’ আমার তেমন ভালো লাগে নাই, সেই সম্পর্কে লিখিও নাই। তথাপি এই আকালে অনিমেষ আমার পছন্দের নির্দেশকদের একজন। তার কিছু টেলিভিশনের জন্য বানানো কাজ আমার ভালো লেগেছে। আর চারুকলার ছাত্র হিশেবে তার প্রতি একটা কোমলকোণ তো মনের মধ্যে আছেই। ফলত তার কাছে স্বাভাবিকভাবেই আমার প্রত্যাশা যেহেতু অন্যরকম তাই তার কাজের বিপক্ষে দুইটা কথা বলার চেষ্টা নিচ্ছি, এই যা।
ইতঃপূর্বে রুবাইয়াত হোসেনের ‘আন্ডার কন্স্ট্রাকশন’ নিয়ে পাঠ-প্রতিক্রিয়া লেখার ফলে ২০০৫ সালে বানানো আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, হারিয়ে গিয়েছিলো আমার অতিকষ্টে লেখা অনেক লেখাজোঁকা। তাই এই প্রতিক্রিয়াটি একটু ভয়ে ভয়েই লিখছি বৈকি। প্রথমবার ভয়ংকর সুন্দর দেখতে গিয়ে দেখি ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ডানকার্ক’ চলছে একই টাইমে। ভাবলাম ‘ডানকার্ক’ না দেখে যদি ভয়ংকর সুন্দর দেখি তবে নোলানকে অপমান করা হবে। তাই ডানকার্ক দেখে ফিরে এলাম। এইবারও হয়তো দেখতাম না যদি লুক বেসনের ‘ভ্যালেরিয়ান অ্যান্ড দ্য সিটি অব আ থাউজেন্ড প্লানেট্স’ সিনেমাটা একই থাকতো।
আমি মূলত একটা সিনেমা যখন মনোযোগ দিয়ে দেখি তখন সিনেমাটাকে শুরু থেকে শেষ অবধি পাঠই করি। সেইভাবে ‘ভয়ংকর সুন্দর’কেও আমি শুধু দেখি নাই, তারচে’ বেশি পাঠ করেছি। তাই আমার এহেন পাঠ-প্রতিক্রিয়া। তাছাড়া আমাকে সিনেমার একজন ভালো দর্শক বলা যায়। কারণ সব ধরনের সিনেমাই আমি নিয়মিত দেখি।
জানা যায়, মতি নন্দীর লেখা গল্প ‘জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ’ অবলম্বনে সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে। গল্পটা আমার পড়া নেই, পড়া থাকলে কথা বলতে আরেকটু সুবিধা হতো। শুনেছি, স্টোরিলাইন একই হলেও চিত্রনাট্যে অনেক যোজনবিয়োজন করেছেন পরিচালক। কাহিনিকে করে তুলেছেন সমসাময়িক, প্রেক্ষাপট ধরেছেন ঢাকা শহরকে। আর আমার মনে হয় এতে করে খেই হারিয়ে ফেলেছে সিনেমার কাহিনি। ফলত চিত্রনাট্য, সংলাপ হয়েছে খুবই দুর্বল। অনিমেষের উচিত ছিলো চিত্রনাট্য রচনায় আরেকটু সময় দেয়া, প্রফেশনাল বা জানাশোনা বা অনেক সিনেমা দেখে, সিনেমা বোঝে এমন কাউকে পড়ানো। গল্পটা মূলত শর্ট ফিল্মের, কিন্তু সেই সেই গল্পকে ফেনায়িত করে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়েছেন পরিচালক। যদিও শর্ট ফিল্মের প্লট থেকে ফুল-লেন্থ সিনেমা বানানো যাবে না সেটা আমি বলছি না। এই রকম অনেক সিনেমা পৃথিবীতে বিদ্যমান। সাম্প্রতিক উদারহরণ হিশেবে আমি ওপার বাঙলার পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখার্জির ‘দ্য ভায়োলিন প্লেয়ার’কে সামনে আনতে পারি। অবশ্য এই টাইপের চিত্রনাট্য লিখতে গেলে গার্সিয়া মার্কেস টাইপের যোগ্যতা দরকার হয় কখনো-সখনো।
অনিমেষ প্রকৃত অর্থে মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন নাকি বিকল্পধারার সিনেমা বানাতে চেয়েছিলেন ঠিক বোঝা যায় না। শুরুতে মনে হয় বাণিজ্যিক সিনেমা। যার কারণে গানসহ রগরগে অনেক উপাদানই তিনি দেখিয়েছেন। পরের অনেক অংশে মনে হয় আর্টফিল্ম দেখছি।
এখন একটু সিনেমার কাহিনিটা বলে নিই। পরিবারের অতি আদরে বড় হওয়া আহ্লাদি মেয়ে নয়নতারা। মূলত মা আর দাদুর আদরেই বেড়ে ওঠা। বাবা জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে ঢাকা শহরে পালিয়ে আসে সে। রিকশাঅলার সহযোগিতায় একটি হোটেলে ওঠে সে। সেই হোটেলে কাজ করে মুকু। তাদের মধ্যে প্রথমে ভালোলাগা, তারপর প্রেম। তারপর ঘটনাক্রমে পালিয়ে এক বস্তিতে গিয়ে বাসা ভাড়া নেয় তারা এবং বিবাহ করে। কয়েকদিন বস্তিতে পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে। তৃষ্ণার্ত নয়নতারা আশপাশের সব বাড়িতে যায় এক গ্লাস পানির জন্য। কিন্তু কেউ তাকে পানি দেয় না। বরং পাশের বস্তির কল থেকে পানি আনতে গিয়ে বস্তির মেয়েদের হাতে প্রচণ্ড মার খায় নয়নতারা। প্রতিশোধের ইচ্ছা জেগে ওঠে তার মনে। ফলত সে মায়ের দেয়া সোনার বালা বিক্রি করে, সেই টাকায় ট্রাকভর্তি করে কিনে এনে পানি রাখার ড্রাম, কলসি, মটকা, খালি বোতল ইত্যাদি রকমারি জলাধার। আর তা দিয়ে থরে-বিথরে সাজিয়ে ঘরভর্তি করে রাখে। আর যখনই পানি আসে একটা একটা করে পাত্র পানিতে পূর্ণ করতে থাকে। এইভাবে কাহিনি শেষের দিকে যায়।
এইবার ‘ভয়ংকর সুন্দর’ সিনেমায় আমার চোখে কী কী অসংগতি ধরা পড়েছে তার দুয়েকটা নমুনা হাজির করি। শুরুতেই ধাক্কা খাই পুরান ঢাকার একটা সস্তা হোটেলে দামি হোটেলের গেটআপে রুমসার্ভিস দেখে। যারা এই হোটেলে থেকেছেন বা এই মানের হোটেলে থেকেছেন তারা অবশ্যই বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। চিত্রনাট্যকার ধনীকন্যা বোর্ডার নায়িকার সঙ্গে প্রেম ঘটানোর জন্য মনে হয় এই রকম গেটআপে একজন রুমসার্ভিসকে হাজির করেছেন। এইখানে প্রথম গোজামিলটা চোখে খেজুরের কাঁটার মতো এসে লাগে। মনে হতে থাকে ভয়ংকর সুন্দর দেখা মানে ভয়ংকর সময় নষ্ট করা।
নায়িকা কোথা থেকে ঢাকায় আসে সেটা জানা যায় না। আমরা ধরে নিই, বরিশাল, পটুয়াখালি কিংবা খুলনা এলাকা থেকে আসে, যেহেতু সে লঞ্চযোগে সদরঘাট দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। সেটাও কথা না কথা হচ্ছে যতই পরিবারে আদর পাক, ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুক, ইন্টারনেট চালাক বা কেবল-লাইনের মাধ্যমে টেলিভিশনে পুরা পৃথিবীকে দেখুক তারপরও দেশে, তারওপর ঢাকার বাইরে বসবাস করে কোনো বাংলাদেশি মুসলিম পরিবারের মেয়ে গেটআপ-মেকআপে, চালচলনে এতোটা হয় না। যে বস্তির ঘরে তাকে থাকতে হবে সেটা বুঝতে পারে এবং মেনে নিতে পারে কিন্তু পোশাক পরিচ্ছদ একটু মানিয়ে নিতে পারে না। যেই সময় ঢাকার ফুটপাথেও খুবই কমদামে শাদা শার্ট কিনতে পাওয়া যায়, সেইখানে অনেক সময়জুড়ে নায়কের গায়ে পকেটে কলমের কালির দাগঅলা শার্ট দেখা যায়। তাছাড়া কালির দাগ তোলারও অনেক পদ্ধতি ইদানীং বিদ্যমান। যদিও শুরুতে নায়ককে ভীতু আর হাবাগোবা মনে হয়, কিন্তু সে বুদ্ধিমত্তারও পরিচয় দেয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্টে। এলাকার বিরাট এক মাস্তানের দৃষ্টি থেকে আড়াল করার জন্য নায়িকার রুমে তালা দিয়ে রাখা, সেই চাবি ম্যানেজার বা অন্যকারো কাছে বলা, পরের বার সেই গুন্ডার হাত থেকে নায়িকাকে উদ্ধার করা এইসব বিষয় সাহস ও বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় বহন করে।
পিতলের ফুলের দানি দিয়ে ঘাড়ে-মাথায় আঘাত করে গুন্ডাকে খুন করে বা চরম আহত করে নায়ক নায়িকাকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়, অথচ তারা চাইলেই কোনো অটোরিকশা বা গাড়িটারি নিতে পারতো। আর এই রকম একটা ঘটনা ঘটানোর পর যেখানে তাদের ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যাওয়ার কথা সেইখানে তারা পুরান ঢাকা থেকে পালিয়ে আসে মিরপুরে, ভাষানটেক কিংবা শেওড়াপাড়া এলাকায়। তাদেরকে পুলিশও খোঁজে না, মাস্তানের লোকজনও খোঁজে না। মিরপুরে এসে আবার দেখা হয়ে যায় পুরান ঢাকার সেই একই রিকশাঅলার সঙ্গে। সেই বস্তিতে ঘর ঠিক করে দেয়। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হয়। কেনো অন্য রিকশাঅলা বা অন্য কোনো মাধ্যম হলে কী সমস্যা ছিলো?
বিবাহের বেশকদিন পরও নায়িকাকে ‘আপনি’ করে বলা, কখনো ‘ম্যাডাম’ ডাকাটা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে, একই সঙ্গে হাস্যকরও মনে হয়েছে। কারণ দুয়েকবার কামটাম করলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাওয়ার কথা। ব্যাপারটা এমন না যে তারা নিষ্কাম বসবাস করছিলো। আপাত চোখে নায়কের পক্ষে নিষ্কাম থাকাটা স্বাভাবিক মনে হলেও নতুন বিবাহিত ইন্টারনেট চালানো আহ্লাদি কৌতুহলী নবীন যুবতীর পক্ষে নিষ্কাম থাকা সম্ভব না ইত্যাদি। তারপর ধরেন, যে মেয়ে রান্না-বান্না পারে না, রিচফুড ছাড়া খেতে পারে না সে মেয়ে সুইয়ে সুতো ঢুকিয়ে ছেঁড়া জামা কেমন করে শেলাই করে তাও আমার মাথার মধ্যে ঢুকে না।
সিনেমাটার অর্ধেকের বেশি খুবই বিরক্তিকর আর ঝুলে যাওয়া মনে হলেও বাকি অর্ধেকে গিয়ে আমার মূল গল্পে প্রবেশ করি। সেখানে অনেক অসংগতি থাকলেও আকর্ষণ তৈরি হয়, আমাকে টান দেয়। তবে ফিনিশিংটা ভালো লাগে নাই। অন্যরকম ভালো হতে পারতো। যেমন বস্তির লোকজন যখন পানির জন্য নয়নতারার ঘরের দরজা ভাঙে তার ঠিক আগমুহূর্তে পানির পাত্র সব উল্টে দিতে পারতো নয়নতারা। জলের প্রবল ধাক্কায় ও স্রোতে বস্তির লোকজন ভাসছে এইভাবে শেষ করা যেতো, তখন বিষয়টাকে মনে হতো ভয়ংকর সুন্দর।
সিনেমায় প্রধান দুই চরিত্রের মধ্যে নয়নতারা চরিত্রে অভিনয় করেছেন আশনা হাবিব ভাবনা এবং মুকু চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। আর দাদু চরিত্রে সৈয়দ হাসান ইমাম এবং রিকশাঅলা চরিত্রে খায়রুল আলম সবুজ।বাকি চরিত্রগুলিকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না আমার। সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন সাহা। যদিও সিনেমার সঙ্গে গানগুলিকে আমার মনে হয়েছে ভারসাম্যহীন।তবে আবহসংগীত ভালোই। কস্টিউম ডিজাইনারকে ধন্যবাদ দিতে পারছি না। কারণ তার মাথা মনে হয়েছে অতি উর্বর।
পরমব্রত জাত অভিনেতা। তার স্বভাবসুলভ অভিনয়ই মূলত সিনেমাটাকে কোনো রকম টেনেটুনে নিয়ে গেছে। ভাবনা নাটক কিংবা মঞ্চে ভালো অভিনয় করেন, শুনেছি, তার অভিনয় এর আগে আমি দেখি নাই। তবে এই সিনেমাটা তাকে আমার আনফিট মনে হয়েছে। অতি অভিনয়, ভারসাম্যহীন ডায়ালগ থ্রোয়িং মানে একবার প্রমিত উচ্চারণে কথা বলে আবার কথ্যরীতিতে কথা বলে। তারওপর আছে নাটুকেপনা। কিছু কিছু জায়গায় যারপর নাই বিরক্তিকর তার অভিনয়। ভাবনার জায়গায় মাহিয়া মাহিকে কাস্ট করলে ব্যাপারটা আমার মনে হয় দাঁড়িয়ে যেতো।
প্রথমে ছবিটির নাম নাকি রাখা হয় ‘জেদ’। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ভয়ংকর সুন্দর’। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার মতো ‘ভয়ংকর সুন্দর’ নামটাও পরিচালক টুকে নিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে।
যাই হোক, ‘ভয়ংকর সুন্দর’ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। বাকিটা আপনারা সিনেমা দেখলেই বুঝে যাবেন। পরিশেষে অনিমেষ আইচকে পরম করুণাময় শুভবুদ্ধি, ধৈর্য, ভারসাম্য এবং আরো সুজনশীলতা দান করুণ, তিনি যেনো আরো ভালো সিনেমা আমাদের সামনে হাজির করতে পারেন। আমেন।
(খসড়া)