ভাত দেঃ মৌলিক চাহিদার এসিডে ঝলসানো সেলুলয়েড
আমাদের ঢাকাই চলচ্চিত্রের গৌরবময় দিনগুলোর সময়ে পরিচালকরা বিভিন্ন প্লট নিয়ে পরীক্ষা চালাতেন। ক্যামেরার পেছনে সেই প্লটগুলোর পার্থক্য ধরা পড়ত মারদাংগা ভালবাসার সিনেমা থেকে আলাদা করে। ঝুঁকি নিতে ভালবাসতেন তখনকার প্রযোজক ও পরিচালক উভয়েই। ফলশ্রুতিতে বাণিজ্যিক ধারার সিনেমার পাশাপাশি বেশ কিছু কোয়ালিটি সিনেমাও পেত বাংলার দর্শকরা। চিন্তা করতে জানতেন তখনকার চলচ্চিত্রের মাস্কেটিয়াররা। তা না হলে দেখুনতো, বাংলার মাটির বুকে সর্পিল গতিতে ঘুরে বেড়ানো দারিদ্র্যের আরেক ছদ্মবেশ “ক্ষুধা” ও তার নেপথ্যের পার্শপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আমজাদ হোসেনের মাস্টারপিস “ভাত দে” এতটা ভাবাবে কেন?
প্রথমবার যখন এই সিনেমার ওজন বুঝে দেখেছিলাম কেউ যেন আমার কলজেটার ভেতরটা ধরে নাড়া দিয়েছিল। এক প্লেট খাবার বৈ আর কিছুতো নয়! এর অনুপস্থিতির কারণে দৃশ্যপটে এত বর্ণহীনতা? এক থালা ভাতের জন্য এত ধুঁকে ধুঁকে মরে মানুষ?
হ্যাঁ, হয়ত বাসায় ফিরে আমাদেরকে চিন্তা করতে হয়না এবেলার খাবার নেই তাই পানি খেয়ে কাটিয়ে দিতে হবে, অপেক্ষায় থাকতে হয়না সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলে ঘরে বাজার সওদা আসবে, চুলায় আগুন জ্বলবে। আসলেই খাবার না থাকলে এবং কখন ক্ষুধার জ্বালা নিবৃত্তের সুযোগ হবে তার নির্দিষ্ট সময় জানা না থাকলে পরিস্থিতি কেমন হবে জানতে চান? জানতে চান কতটুকু ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে স্বামীর ঘর ত্যাগ করে কূলবধূ পরপুরুষের হাত ধরে রাতের অন্ধকারে সন্তান স্বামী ফেলে নিরুদ্দেশ হয়? জানতে চান কখন রক্তমাংসের মানুষ বিধাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে? ভাত দে সিনেমায় পেয়ে যাবেন সব প্রশ্নের দাঁতভাঙা জবাব। সিনেমাটা দেখার পর যখন আবার খেতে বসবেন হয়ত আমার মত আপনাকেও খাবারের প্লেট মুখ ভেংচে বিদ্রুপ করবে। হয়ত আমার মত আপনি চেষ্টা করবেন এটাকে শুধুই একটা সিনেমা ভেবে উড়িয়ে দেবার, হয়ত লোকমা মুখে তুলবেন। কিন্তু গলা দিয়ে সে খাবার আপনার নামবে কিনা সন্দেহ আছে আমার। আমি পুরো এক সপ্তাহ ভাল করে খেতে পারিনি এই সিনেমাটা দেখে। এত আবেগমেশানো ইঁটের মত বাস্তব এই চলচ্চিত্র।
ছোট্ট মেয়ে জরি। বাবা বাউল হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। ঘরে খাবার নেই। মা ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে পালিয়ে যায় এক মহাজনের সাথে। দিন যায় জরি বড় হয়। দারিদ্র তার অভিশাপের ছেঁড়া জানালায় রুখতে পারেনা হায়েনার লোলুপ দৃষ্টি। কিন্তু এসব দেখার সময় কোথায় জরির? তার লক্ষ্য দিনের শেষে একথালা ভাত!
এই সিনেমায় কুশীলব ছিলেন শাবানা, আলমগীর, রাজিব, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। পরিচালক আমজাদ হোসেনের কাছের শাবানার একটা আবদার ছিল এমন একটা সিনেমার যেটায় অভিনয় তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার এনে দেবে। সেই অনুরোধ রক্ষার্থেই আমজাদ হোসেন একমাস খেটে তৈরি করেন এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট। বাংলা সিনেমার অতি নাটুকেপনা ও নাটুকে সংলাপ অতটা নেই এখানে। তাও যেটুকু আছে অনুরোধ করবো মনের ছাঁকনিতে ছেঁকে ফেলে দিন। এবং আমি নিশ্চিত যে এরপর এই সিনেমাকে তারকোভস্কি বা টেরেন্স মালিক লেভেলের সিনেমা বলতে আপনি হয়ত অমত করবেননা। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করে এই নন্দিত সিনেমা।
“ভাত দে” আপনাকে সিরিয়াস কিছু প্রশ্ন ও পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করাবে তাতে সন্দেহ নেই। ‘তিলে তিলে মইরা যামু তবু তোরে ডাকবোনা। ‘ শিরোনামের গানটা হয়ত শরীরের প্রতিটি রোমকূপে বইয়ে দেবে কাঁটা দিয়ে ওঠা ঝিরঝির অনুভূতি। কিন্তু গোধূলি বেলায় ক্ষুধার্তের প্রতি মমতা ও দারিদ্র্যের অভিশাপের গা বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা একটু হলেও বাড়াবে কমাবে “ভাত দে”।
খুব ছোটকালে দেখেছিলাম। এখনো মনে গেঁথে আছে কয়েকটা সংলাপ, চিত্র।