Select Page

‘‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’’

‘‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’’

kobid_2004327466540a996ace1e77.23359520_xlarge

 

উৎসর্গ সালমান শাহ

(অমর প্রিয় নায়কের ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি)

প্রিয় সালমান,

But I have promises to keep,

And miles to go before I sleep,

And miles to go before I sleep.

                              -Robert Frost

কবি রবার্ট ফ্রস্ট ঘুমানোর আগে হাঁটতে চেয়েছেন।এটা যদি জীবনেরই একটা প্রকাশ ধরি তবে এমনো বলা যায় যে মৃত্যুর মত চিরদিনের ঘুমের আগে  মানুষ জীবনের পথে হাঁটতে চায় যতটা তার সাধ্য।সালমান,তুমিও চিরদিনের মত ঘুমিয়ে যাবার আগে হেঁটেছ রাজার মত।তোমার হাঁটার কীর্তি সবার থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। সে পথ আর কারো নয় যে পথে তুমি হেঁটেছ।

আমার পরিচয় আমি তোমার ভক্ত। অন্তঃপ্রাণ ভক্ত। ভক্তের হৃদয়ের শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা, ভক্তি সব নিও..যদি বলি হৃদয় থেকে যে অনুভূতিগুলো সহজেই সিক্ত করে সেসব অনুভূতি দিয়ে গাঁথা মালা নিয়েই তোমাকে লিখতে বসেছি।যখন লিখছি তখন আমার চোখে অশ্রু।এ ভুবনে একমাত্র হৃদয়ের সাথে জোর চলে না আর সবকিছুতে চলে। তাই মন যদি কাঁদে তাকে না আটকিয়ে কেঁদে যাবার স্বধীনতা দেয়াই সবচেয়ে ভালো।আমরা আমাদের যাপিত জীবনে যাকে সবচেয়ে ভালোবাসি সেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয়।তুমিও দিয়েছ।তুমি আমাদের ছেড়ে গেছ। তোমার চলে যাওয়া অকালের-অসময়ের-চিরকালের।আমাদের চলচ্চিত্রকে যখন বিশ শতকের শেষের সম্ভাবনাময় প্রান্ত থেকে একুশ শতকের আলোর দিকে নিয়ে যাচ্ছিলে তুমি তখনই তোমার চলে যাওয়া। এভাবে কী কেউ যায়! লোকে বলে তুমি আত্মহত্যা করেছ। আমি মানি না,মানতে আমার মন আমাকে সায় দেয় না। আত্মহত্যা তো কাপুরুষ করে, তুমি তো কাপুরুষ ছিলে না। তুমি ছিলে সহজাত সুন্দর, সুপুরুষ, সেীম্য-শান্ত প্রকৃতির মত আলোকিত ছিলে। তোমার অভিনয় জীবন্ত তাই অনেকের থেকে তোমাকে আলাদা করতে বা আলাদা করে চিনে নিতে মোটেও দেরি হত না। এমন অভিনয় আমি দেখিনি। আমাদের চলচ্চিত্রে বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী আছে কিন্তু তোমার মত কেউ নেই। তুমি একা একটা অধ্যায়। তোমাকে হারবার পরই বুঝেছি কতবড় হীরের টুকরো হারিয়েছি।

তোমার মায়ের মুখে শুনেছি তোমার কোনো অভাব ছিল না। সুখী ছিলে। ভালোবেসে বিয়ে করেছ। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল তোমার। একের পর এক সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছ আর আমরা গোগ্রাসে সব দেখেছি। তোমার অভিনয়ে প্রশংসা করেছি, তোমার মত করে চুল রেখেছি, তোমার মত করে নিজেকে সাজিয়েছি, কত কত ভিউ কার্ড জড়ো করেছি মাইলকে মাইল পথ হেঁটে। ভালোবাসা তো আর সস্তা জিনিস নয় যে যাকে তাকে দিয়ে দেব। ঠিক তাকেই দেব যে ভালোবাসার যোগ্য। তুমি ভালোবাসার জীবন্ত প্রতীক। বাস্তবে ও সেলুলয়েডে। তোমার সাফল্য দেখতে পারেনি যারা তারাই তোমাকে বাঁচতে দেয়নি এটাই সত্য।

তুমি চলে যাবার পর নব্বই দশকের শেষের দিকে তোমার শূন্যতা যখন চারিদিকে, ভক্তদের বুক যখন হু হু করছে তখনই নড়েচড়ে বসল অশ্লীল যুগ। অশ্লীল সিনেমা বানানোর ধুম পড়ল।আমরা জানি প্রত্যেকটি ভালো সময়ের পরে একটা খারাপ সময়ের জন্য সবাইকে অপেক্ষা করতে হয়। সেটাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। নগ্নতা ছড়াল পর্দায়, অসুস্থ কলাকুশলী, পরিচালক, প্রযোজক এসে পঙ্গু করে দিল চলচ্চিত্রশিল্পকে। ঐ সময়টোকে কী বলব!..আমার তো মনে হয় ঐ অসাধু অশিক্ষিত গোষ্ঠীটি অনেকদিন ধরেই বোধ হয় অপেক্ষা করছিল একটা সুযোগের যাতে তারা তাদের নোংরামিটা চালাতে পারে। অশিক্ষিত, মূর্খরা এসে যখন জুটল তখন তাদের মতই যারা দর্শক তারা সেটা লুফে নিল। খুব কষ্ট হয় তারা একসময় নিশ্চয়ই তোমার সিনেমা দেখত অথচ তারা সহজেই অসুস্থ স্রোতে গা ভাসাল।

এ সমযের পর কেটে গেছে আরো একটা দশক। এখন এই একুশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে এসেও তোমারই জন্য সবার হাহাকার। সবার একটাই কথা-‘সালমান শাহ থাকলে আমরা আজ বিশ্ব চলচ্চিত্রে সাথে তাল মেলাতাম।’…আমি যখন দেখি ভারতে তখনকার সেরা নায়ক শাহরুখ খানের সঙ্গে তোমার স্মার্ট স্টাইলিশ ছবি শোভা পাচ্ছে তখনই বুঝেছি তুমি কত বড় রত্ন ছিলে।ওরা তো তোমাকে অফার দিয়েছিল ওখানে কাজ করার। এ সম্মান আমাদের জন্য ছিল সুবিশাল। সেই তোমাকে হারিয়ে সুযোগ বুঝে এই অশ্লীলতার যুগটা শুরু হল। তখন স্কুল ছাত্র আমি। স্কুলে যেতে রাস্তার নোংরা পোস্টার দেখে লোকে থু থু দিত। থু থু তারাই দিত যারা ছিল তোমার দর্শক। আমি নিজ কানে শুনেছি তারা বলেছিল-‘সালমান মরে গিয়ে এদের ভাগ্য খুলে দিয়ে গেছে।’..তোমার মৃত্যুতে জানি না আর কতজনের ভাগ্য খুলে গেছে তবে এটা পরিষ্কার বুঝেছি যে তোমার মৃত্যু কারো কারো জন্য আশীর্বাদ ছিল। তোমার সময়ে যারা ছিল তোমার সহযোদ্ধা তারা অনেকেই সেই অশ্লীল যুগের সাথে তাল মিলিয়েছে। তারা যদি তোমার মত মেীলিক প্রতিভার সাথে কাজ করতে পারে তবে কেন তারা নোংরামিকে বেছে নিয়েছিল ভাবতে বড় লজ্জা লাগে। তুমি চলে গিয়ে এদের শিল্পের প্রতি যে আচরণ দেখেছি তাতে অনেকের রুচিটাও চেনা হয়েছে ভালোভাবে এটাও এক ধরনের লাভই বটে। মানুষ তো চেনা গেছে।

তোমার মৃত্যু তো শুধুই একটি মৃত্যু নয়।ভালো সিনেমার মৃত্যু হয়েছিল তোমার মৃত্যুর পর, ভালো রুচির মৃত্যু হয়েছিল তোমার মৃত্যুতে, ভালো গল্পের মৃত্যু হয়েছিল। পরে একটা ভালো সময় দুএকজনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল কিন্তু একালে এসেও লোকে বলে-‘সালমান শাহর মত কেউ এল না।’…যারা এখন আছে তাদের কারো হাসির এক্সপ্রেশন হয় তো কান্নার এক্সপ্রেশন হয় না, রোমান্স পারে তো স্যাড পারে না, রোমান্স পারে তো সিরিয়াস অভিনয় পারে না, ফাইট পারে তো ডান্স পারে না। আর তোমার অভিনয়, স্টাইল, একটা যুগকে অতিক্রম করে অন্তত ২০ বছর এগিয়ে থাকার প্রতাপ ছিল অভাবনীয়। তুমি তিন বছরে করেছ ২৭টি সিনেমা আর এখন বছরে অনেকের ২০-২৫টা হয়ে যায়… ভাবতেও ভয় লাগে। তোমার বৈচিত্র‌্যও সুবশিাল যেভাবে তোমার ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ থেকে শেষ সিনেমা ‘বুকের ভিতর আগুন’ অবধি একটার সাথে আরেকটি মেলে না। রোমান্টিক, অ্যাকশন, স্যাড, সিরিয়াস, পারিবারিক, রাজনৈতিক সব ধরনের সিনেমার ক্যাটাগরি সেখানে মিলে যায়। প্রেম যদি বলি তো ‘তোমাকে চাই’ বা ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’ যেমন অসাধারণভাবে পাই তেমনি প্রেম, বিরহ, রোমাঞ্চ, স্যাড, সিরিয়াস সব ক্যাটাগরি পেয়ে যাই ‘আনন্দ অশ্রু’তে। ঠিক একইভাবে পাই ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’এ। এভাবে পারিবারিক বা সামাজিক হলে ‘এই ঘর এই সংসার, স্নেহ, কন্যাদান’ বা ‘মায়ের অধিকার’ মুগ্ধ করে। রাজনৈতিক হলে ‘বিক্ষোভ’ মুগ্ধ করে। প্রেমের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে যারা প্রেয়সীর জন্য জীবনকে হাতে তুলে নেয় তারা পেয়ে যায় ‘প্রেমযুদ্ধ’।সমাজকে গ্রাম ও শহরের ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তিন ক্যাটাগরির অসাধারণ স্বাদ পেয়ে যাই ‘বিচার হবে’তে। আবার ফোক কালচারকে যদি মন থেকে দেখতে চাই দেখা যায় ‘সুজন সখি’। পারিবারিক বা বংশীয় বাঙালি ঐতিহ্যকে দেখতে ‘দেন মোহর’ তো আছেই তেমনি মানুষের অহংকার ও ভালোবাসার যেীথ মিলনে আছে ‘অন্তরে অন্তরে’।তুমি স্বপ্ন দেখতে যেমন ভালোবাসতে তেমনি স্বপ্ন দেখাতেও ভালোবাসতে। তাইতো তোমার স্বপ্ন হয়ে আসে ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ যেখানে প্রেম বিশুদ্ধ…আসে ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ হয়ে যেখানে তুমি দেখাও একটা আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন যেখানে থাকবে প্রেম-ভালোবাসা, পরিবার, সমাজ, মানুষের মাঝে সাম্য ইত্যাদি…তুমি হয়ে যাও ‘স্বপ্নের নায়ক’ তাইতো তোমাকে স্বর্গলোকে যেতে হয়েছে আর আমরা বুক চাপড়ে কাঁদি..তোমার সিনেমার কথা বলতে গেলে কোনটা ছেড়ে কোনটাকে ব্যাখ্যা করব এটা একটা বড় ঝুঁকিই বটে। কারণ আমার অল্প জ্ঞানবুদ্ধিতে যা কুলায় তা কী তোমার মত সমুদ্রের জন্য যথেষ্ট!!…

অভিনেতা তো অনেক থাকে কিন্তু উত্তম অভিনেতা কয়জন থাকে!!..ভালো অভিনেতাও থাকে সেখানেও উত্তম অভিনেতা কয়জনই বা থাকে!!…ভালো আর উত্তমের তফাতটা আমরা জানি তাই তোমার জন্য উত্তম বিষয়টি একদম চিরকাল গাঁথা হয়ে গেছে। হ্যাঁ আমাদের অনেক রত্ন-সম্পদ আছে কিন্তু তোমার মধ্যে কী যেন একটা বেশি আছে যে প্রতিভায় তুমি হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ…তোমার মুখটা টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠলেই লোকে একবাক্যে বা একটি শব্দে বলবে ‘অসাধারণ’…এ শব্দটি দামি এবং সবার ভাগ্যে একবাক্যে বা একশব্দে জোটে না। তাইতো তুমি অভিনেতাদের অভিনেতা।

আজ ১৯টা শরৎ-শীত-বসন্ত শেষেও একই হাহাকার -‘ইস যদি সালমান থাকত!’…একটা চাপা বেদনা…তোমার মৃত্যুর এতবছর পরেও বের হল না ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬-এর সেই রাতের বাস্তব ঘটনা..আজো এফডিসি অবহেলা করে তোমাকে নিয়ে, সবাই স্মৃতিচারণা করে দায় শেষ করে আর বাস্তবে কোনো কাজই করে না তোমাকে নিয়ে..তুমি তো জানই বাঙালি অকৃতজ্ঞ জাতি তাই তোমাকে দিয়ে যারা একসময় পর্দা কাঁপিয়েছে তারা আজ নীরবতা পালন করে। ‘সালমান শাহ’ শব্দটাকে দিয়ে তারা সেসময় ঠিক গর্ব করেছে নাকি প্রয়োজনে ব্যবহার করে শেষে আর মনে রাখেনি কে জানে!..‘সালমান শাহ’ শব্দটি কি তবে কারো কারো কাছে রাজনীতির শব্দ ছিল!!!

আজ তুমি নেই তাই এখনকার বাস্তবতা তোমাকে দেখতে হয়নি। অবশ্য না দেখে ভালোই করেছ তুমি। কারণ তুমি অভিনয় জেনেই অভিনয় করেছ। আর এখন টাকা থাকলেই অভিনয় করা যায় সেখানে অভিনয়টা না থাকলেও চলে। তুমি যাবার পর এই বাস্তবতা দেখতে হয়েছে বছর দশেক আগেও এখনো দেখতে হচ্ছে। তুমি আমাদের ক্ষমা করো না বরং অভিশাপ দিও আমাদের, আমরা তোমার গড়ে দেয়া ইন্ডাস্ট্রিকে ঠিকটাক কাজে লাগাতে পারিনি। তোমার সুযোগ্য সম্মান তোমাকে দিতে পারেনি তোমার গড়ে দেয়া ইন্ডাস্ট্রি যতটা সম্মান আমরা ভকত্-দর্শকরা তোমাকে দিয়েছি…তারপরেও আমরা কতটা যতটা পেরেছি কে জানে….

প্রকাশ্যে আগুন জ্বললে লোকে নেভাতে আসে কিন্তু যে আগুন ‘বুকের ভিতর আগুন’ হয়ে ধিকি ধিকি জ্বলে সে আগুন নেভানোর সাধ্য কার!!…তুমিহীন আমাদের সিনেমার আজকের বাস্তবতায় তোমাকে না পাওয়ার অনন্ত তৃষ্ণায় আগুন জ্বলছেই, সে আগুনে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে..এখন ছাইভস্ম নিয়ে আছি যে ভস্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করছে বর্তমান ইন্ডাস্ট্রি…সে আগুন জ্বলবে চিরদিন কারণ তুমি আর ফিরবে না…

জানিনা এ চিঠি তোমার কাছে পৌঁছবে কিনা….তবে তোমার ঐ গানটাই প্রেরণা জুগিয়েছে ‘ভালো আছি ভালো থেকো…আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’…তাইতো লিখতে বসা…যদি তুমি পাও এ চিঠি…আর লিখতে লিখতে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছি…আর বলছি ‘দিও তোমার মালাখানি বাউলের এই মনটারে..আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে.. আছ তুমি হৃদয় জুড়ে’….হৃদয় জুড়ে থাকবে চিরদিন…শ্রদ্ধা, ভালোবাসা নিও আর ভালো থেকো অন্য কোনো ভুবনে…

ইতি

অগণিত সালমান ভক্তদের একজন

রহমান মতি


Leave a reply