Select Page

ভিলেন ফরীদি-নায়ক খোকনের প্রথমবার, মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘সন্ত্রাস’

ভিলেন ফরীদি-নায়ক খোকনের প্রথমবার, মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘সন্ত্রাস’

একনায়ক এরশাদের পতনের পর বাণিজ্যিক সিনেমায় মুক্তিযুদ্ধকে প্রথমবার তুলে ধরেন শহীদুল ইসলাম খোকন, সেই ছবির নাম ‘সন্ত্রাস’। এটি হ‌ুমায়ূন ফরীদি অভিনীত প্রথম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র, যার সাফল্যের পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

১৯৮৬ সালে ‘লড়াকু’, ১৯৮৮ সালে ‘বীরপুরুষ’, ১৯৮৯ সালে ‘বজ্রমুষ্টি’— এ তিন ছবি দিয়ে ঈদে কাঁপানোর পর ১৯৯১ সালের রোজার ঈদে খোকন নিয়ে আসেন ‘সন্ত্রাস’। হ‌ুমায়ূন ফরীদির প্রথম অভিনয় ছাড়া আরও দুটি ব্যাপার ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম। পরিচালক খোকন নিজেই প্রথমবার এই ছবিতে অভিনয় করেন এবং রুবেল-মিশেলার পানির নিচে ধারণ করা দুর্দান্ত একটি অ্যাকশন দৃশ্য, যা বাংলা চলচ্চিত্রে এর আগে দেখা যায়নি।

১৯৯১ সালে বাণিজ্যিক ধারার জনপ্রিয় ও ব্যস্ত পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন বরাবরের মতো রুবেলকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে যাবেন। শুটিং শুরু করার আগে তার মাথায় হঠাৎ খেয়াল চাপে জনপ্রিয় ‘কানকাটা রমজান’ অর্থাৎ হ‌ুমায়ূন ফরীদিকে প্রধান খলনায়ক হিসেবে নেবেন। কিন্তু ফরীদির চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা এর আগে মাত্র একটি তাও আবার মূলধারা বাণিজ্যিক ছবির বাইরে ‘দহন’। শেখ নিয়ামত আলীর ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ, কিন্তু সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। তাই ফরীদিকে খলনায়ক হিসেবে দর্শক কীভাবে নেবে সেটাও ছিল চিন্তার বিষয়। ওই সময় চলচ্চিত্রে খলনায়ক হিসেবে রাজীব, এটিএম শামসুজ্জামান, আহমেদ শরীফ, খলিলুল্লাহ খান, মিজু আহমেদ, রাজ, মাহবুব খান, ড্যানি সিডাক দারুণ ব্যস্ত ও সবাই সফল। এমতাবস্থায় জনপ্রিয় খলনায়কদের ছাড়া রুবেলের মতো মার্শাল আর্ট হিরোর ছবিতে টেলিভিশন অভিনেতাকে নির্বাচন করাটাও বিরাট ঝুঁকি। রুবেল একের পর এক ছবি দিয়ে বক্স অফিস দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন— যার সঙ্গে নিয়মিত খলনায়ক থাকতেন খলিল, ড্যানি সিডাক বা ইলিয়াস কোবরা, যাদের দর্শক বেশ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছিলেন। এ অবস্থায় রুবেলের ভক্ত ও ছায়াছবির নিয়মিত বিশাল দর্শক ফরীদিকে নেওয়া আসলেই ভাবনার বিষয়। অবশেষে পরিচালক খোকন আলপনা চলচ্চিত্রের কর্ণধার প্রযোজক আজিজুল হক পুটুর সঙ্গে একরকম চ্যালেঞ্জ নিয়েই ফরীদিকে ছবিতে মূল খলনায়ক হিসেবে নির্বাচন করেন। প্রযোজক পুটু পরিচালক খোকনের  ওপর আস্থা রেখেছিলেন, কারণ এ প্রযোজকের বিনিয়োগে এর আগে রুবেলের একাধিক সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েছিলেন খোকন। সেই সূত্রে পরিচালকের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি পুটু।

১৯৯০ সালের শেষ দিকে খোকন যখন ফরীদিকে ছবির মূল খলনায়ক হিসেবে নির্বাচন করলেন, তার কিছুদিন আগেই টেলিভিশনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘সংশপ্তক’ শেষ হয়েছে। ফলে সেই ‘কানকাটা রমজান’-এর রেশ দর্শকদের মাঝে রয়ে গিয়েছিল। সেই জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে খোকন ঝুঁকি নিয়েই নিলেন।

ছবিতে আরেকজন নায়ক হিসেবে জাফর ইকবালকে নির্বাচন করেন, যা ছিল চিরসবুজ নায়কের সঙ্গে খোকন-রুবেলের প্রথম কাজ। শুরু হলো ‘সন্ত্রাস’। এরপর মুক্তি পাওয়ার আগে টেলিভিশনে ছবির বিজ্ঞাপনে দর্শক দেখতে পায় ‘কানকাটা রমজান’-খ্যাত প্রিয় ফরীদিকে। ফলাফলে ছবিটি সম্পর্কে দর্শকের আগ্রহ বেড়ে যায় ।

ট্রেলার ছিল এইরকম— ফরীদি কাঁচা-পাকা ছোট চুল ও চোখে চশমা, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত রাজনৈতিক নেতার মতো উত্তেজিত ভঙ্গিমায় সংলাপ বলছে, দৌড়ে এসে রুবেল তিন-চারজনকে কুংফু স্টাইলে লাথি মারছে, এক পা খোঁড়া জাফর ইকবালের গানের অংশ ‘ভিক্ষা চাই না মেম সাহেব কুত্তাটা সামলাও’ এবং সবশেষে সমুদ্রের মাঝখানে একটি জাহাজ বিস্ফোরণ এর দৃশ্য দেখিয়ে  মাজহারুল ইসলামের কণ্ঠে বলা হয় শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘সন্ত্রাস’। এ ট্রেলার দেখে বরাবরের রুবেল ভক্তরা ছবিটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে।

অবশেষে ঈদে সারা দেশে ‘সন্ত্রাস’ মুক্তি পায়। ছবিটি দেখতে সিলেটের মনিকা সিনেমা হলে প্রথম দিন থেকেই দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। টিকিট না পেয়ে উচ্ছৃঙ্খল দর্শকেরা হলের বাইরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ঈদের সাত দিন পর আমরা পাড়ার বন্ধুরা বিকেল ৩টার শো দেখতে যাই। তখনো শো হাউসফুল। ছবি দেখার পর দর্শকদের মুখে মুখে শুধুই ‘ফরীদি, ফরীদি’ স্লোগান।

১৯৭১ সালের ২০ জুলাই মুক্তাঙ্গনের খোঁজে শরণার্থীরা ঘুরছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। সেই যুদ্ধে ফরীদি থাকে পাক হানাদারদের দোসর, নাম জুলমত আলী খান। নামের ব্যাখ্যা ফরীদি প্রথম দর্শনেই দিয়েছিলেন এভাবে, ‘জুলমত’ আমার নাম, ‘আলী’ হলো বাপের পদবি আর ‘খান’ হলো ‘আব্বা হুজুরের অর্থাৎ পাকিস্তানি খানদের গোত্রের একজন সে তাই নাম জুলমত আলী খান। এভাবেই ছবিতে শুরু থেকে ফরীদিকে দেখতে পায় দর্শক। প্রথম দর্শনেই হল জুড়ে দর্শকদের তুমুল করতালি, যা ফরীদিকে সাদরে গ্রহণ করার একটা প্রক্রিয়া মাত্র। মুক্তাঙ্গনের খোঁজে থাকা শরণার্থীদের পথিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সেজে বোকা বানায় রাজাকার কমান্ডার ফরীদির লোকজন। বাংলাদেশের পতাকা দেখে মুক্তিবাহিনী ভেবে ফাঁদে পা দিয়ে শরণার্থীরা নৌকা থেকে নেমে যায়। এরপর সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ফরীদি। গুলিবিদ্ধদের একজন মৃতের ভান করে জুলমত আলী খানের চেহারাটা চিনে রাখেন। শরণার্থীদের হত্যার পর সবার গচ্ছিত টাকা ও অলংকার লুট করে নিয়ে যায় ফরীদি অর্থাৎ জুলমত। এই ঘটনার কয়েক মাস পর অর্থাৎ বিজয়ের সন্ধিক্ষণে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সালাম, তার দুই বন্ধু রফিক ও বরকত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাকিস্তানগামী জাহাজ ‘সালিমার’কে বিধ্বস্ত করে যার মধ্য ছিল লুণ্ঠন করা ৫ টন সোনা ও আহত পাকিস্তানি সৈন্য। সে অপারেশন এর একটি নকশা তৈরি করেন কমান্ডার সালাম যিনি খোকন, জাফর ইকবাল ও রুবেলের বাবা। রাতের অন্ধকারে বিস্ফোরিত জাহাজটির ভেতরে থাকা সেই মালামাল কোথায় ডুবে আছে তার সঠিক স্থানটি তথ্য সেখানে লেখা ছিল। এ দিকে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফরীদি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে আনন্দ মিছিলে যোগ দিয়ে হয়ে যান একজন ‘সলিড মুক্তিযোদ্ধা’।

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় সেই তিন মুক্তিযোদ্ধাদের কথা প্রকাশিত হয়, যারা ‘সালিমার’ জাহাজটি বিধ্বস্ত করেছিলেন। ফরীদির জানা মতে, ৫ টন স্বর্ণালংকার ছিল যার কথা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ফলে সে ভেবে নেয় হয়তো সেই তিন মুক্তিযোদ্ধা জাহাজের ভেতরে থাকা স্বর্ণালংকারের কথা জানে না। ফরীদির শুধু দরকার সেই জাহাজটির ডুবে যাওয়ার সঠিক স্থানটি কোথায় তা জানা। খোকন, জাফর ইকবাল ও রুবেলের বাবার কাছ থেকে নকশাটি ছিনিয়ে নিতে চায় ফরীদি, ফলাফল খুন। এরপর রুবেলের বাবার নকশাটি চার টুকরো ভাগে ছিঁড়ে তিনি স্ত্রী ও ছোট সন্তানদের হাতে তুলে দেন। পথিমধ্যে রুবেল ও খোকন মা খালেদা আক্তার কল্পনা ও ভাই জাফর ইকবালের কাছ থেকে হারিয়ে যান। ফলে সেই নকশার একটি অংশ রয়ে যায় রুবেলের কাছে আর একটি অংশ রয়ে যায় খোকনের কাছে। এভাবেই শুরু হয় জমজমাট গল্প। যার শেষ ফাইটটি ছিল চরম। মিশেলা-রুবেলের পানির নিচে কুংফু অ্যাকশন দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, কীভাবে এমন দৃশ্য ধারণ করলেন পরিচালক খোকন!

সব মিলিয়ে একটি পরিপূর্ণ-পরিচ্ছন্ন জমজমাট বিনোদনধর্মী ছবি দেখে সেদিন হল থেকে বেরিয়েছিলাম, যার স্মৃতি আজও চোখে ভাসে।  


মন্তব্য করুন