মনের একটা বাঘ ঢুকে পড়লো বিহারি ক্যাম্পে
বিহারি ক্যাম্পের মধ্যে জঙ্গি ঘাপটি মেরে আছে, বাস্তবে এমন উদাহরণ না থাকলেও মনে থাকতে পারে। মনে থাকার পেছনে হেতু নিশ্চয় আছে। যাতে পরিবেশিত বিনোদন ‘গ্রহণযোগ্য’ হওয়ার কারণও উপস্থিত। সেটা হলো অবিশ্বাস, যে আমার ‘অপর’ সে সব পারে। যেহেতু সে ছোট, নিগৃহীত ও গরিব। এবং যেহেতু সে পরাজিত। কিন্তু সে জাতি বা ভাষা কোনোটাই বিসর্জন দেয় নাই। কত সাহস!
গুগল করে বিহারি ক্যাম্পে জঙ্গি পাইলাম না। গুগল করলাম এ কারণে যে জঙ্গিবাদ তো গুরুতর ইস্যু। যেখানে ধর্মীয় সাধারণ কিতাবাদিও আজকাল উগ্রপন্থার বই বলে বিবেচিত হয়। তবে বিহারি ক্যাম্পে উচ্ছেদ চেষ্টার বিপরীতে সংঘর্ষের খবর আছে। পুড়িয়ে মরার খবর আছে। মাদক কারবারের খবর আছে।
তাহলে যে খবর খবরে নাই, সে খবর বা সে খবর তৈরির মন কেন লেখার শুরুতে?
বাংলাদেশের ভিজ্যুয়ালে বিহারিদের নিয়ে কম কাজ হয়েছে। এরা শুধু সংখ্যালঘুই নয়, একটা রাজনৈতিক বাস্তবতা। তাই বিষয়টা পাঠ করা একটু কঠিন। আবার সাহসী ঘটনাও। এর আগে আমরা দেখেছি তারেক মাসুদের শর্টফিল্ম ‘নরসুন্দর’। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বিহারি-বাঙালিকে পাশাপাশি দাঁড় করান তিনি। যেখানে বিশ্বাসের মাঝেও মানবিকতার জয় হয়। বর্তমানের নিরিখে একটা মীমাংসা দেখা যায়, এটা সংকটপূর্ণ একটা সময়ে তারেকের দায় হয়তো বা। হরেদরে সিনেমা, নাটক যখন জঙ্গিদের মেরে ফেলা হয়, তারেকের অভিনেতারা দুধ দিয়ে মুখ ধুয়ে ঘরে ফেরে (রানওয়ে)। এ ছাড়া টেলিভিশনে দেখা সুমন আনোয়ারের সিরিয়াল ও ভিকি জাহিদের একটা নাটকের বিহারি ক্যারেক্টারের কথা বলতে পারি। যেহেতু প্রান্তিক অবস্থানে থাকা বিহারিদের অবস্থা উঠে এসেছে। সম্প্রতি যেটা চোখে এসেছে, যেটা নিয়ে আজকের কথা। ভারতীয় ওয়েব প্ল্যাটফর্ম হইচই-এর সিরিজ ‘রিফিউজি’, পরিচালনায় ইমতিয়াজ হোসেন; শো ক্রিয়েটর ও অভিনেতা হিসেবে নামি-দামি কিছু মুখ আছে।
তো, সেখানকার মূল গল্প বিহারি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া মোস্ট ওয়ান্টেড এক জঙ্গি, যার কোডনেম ‘কার্বন’। যে নিজের ‘স্বার্থ আদায়ে’ বিহারিদের আবেগকে ব্যবহার করছে। এর পেছনকার ঘটনায় যেতে হয় মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত; কার্বনের বাবা ছিল রাজাকার। বাংলাদেশিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে হত্যা করেছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে কার্বন বাংলাদেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: নিখোঁজ: গুম বেশ সহনীয়
কার্বন বিহারিদের ‘পাকিস্তান ফেরতের’ স্বপ্ন দেখায়। তার কথায় বিহারি তরুণরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীর নাতনিকে জিন্মি করে। বিনিময়ে তিনি স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বলেন, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। এমন একটা স্বীকৃতির পর সেই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ছক আঁকে কার্বন, সেই বোমাটা রেখে রাখে বিহারি তরুণ। তাকে নিস্ক্রিয় করা গেলেও ঠিকই হত্যা করে বিশেষ বাহিনির কর্মকর্তা।
সিরিজের আলোচিত দিক হলো, নাতনিকে জিম্মি করে বুদ্ধিজীবীকে দিয়ে বলাতে হলো ‘বিহারিদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে’। সিরিজের টাইমলাইন অনুসারে স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর এক কথা বলা হচ্ছে। সেটা আবার জিম্মি কেন্দ্রিক নেগোসিয়েশন দিয়ে। মানে একটা রাষ্ট্রে এতটুকু বোধ-বুদ্ধির উদয় হতে কতটুকু সময় লাগে। ঠিক এ স্বীকারোক্তির সমান্তরালে বিহারি তরুণ অডিটোরিয়ামে বোমা পেতে বসে আছে! মানে হলো, এই ‘স্বীকৃতি’ মিললেও তার জঙ্গিপনা থেকেই যাচ্ছে। মানে ‘মাসুদ কখনো ভালো হবে না’!
হ্যাঁ, বলা যেতে পারে ক্ষোভে উদগিরণের সুযোগ হিসেবে তাদের ফুসলানো হয়েছে। কিন্তু বিহারি যেহেতু একটা সহিংস জায়গায় দাঁড়ায়া আছে, যেন তারা জন্মগতভাবে এমন, তাদের কাছে মানবিকবোধ পরাজিত, যতক্ষণ না ওয়াসিম বুঝতে পারে, এটা একটা ফাঁদ। কিন্তু সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে, এই লড়াই চলছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি নির্যাতিত বাঙালি অফিসার, মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া বিহারি ও রাজাকারের সন্তান ‘কার্বন’কে ঘিরে। মানে একটা গতানুগতিক প্লটের ওপর ভিত্তি করে দেশের শত্রু-মিত্র দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান এ বিরোধের মধ্যে থেমে আছে। আসলে কী থেমে থাকে। বাস্তব দুনিয়ায়, এ বিরোধের চিত্তাকর্ষক বর্ণনার ভেতর দিয়ে আড়াল হয় বাকি কিছু।
জাতিগত ও রাজনৈতিক একটি সংখ্যালঘুকে কখন এভাবে বর্ণনা করা সম্ভব? যখন বিহারি আর বাঙালি বিভেদের দেয়াল অনেকটাই উঁচু। যার শুরু একাত্তরে, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের স্বপ্নভঙ্গ ও বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। বিজয়ী ইতিহাস হিসেবে আমরা উর্দুভাষী বিহারিদের নৃশংসতার অনেক ঘটনা আমরা লিপিবদ্ধ পায়। আবার বিপরীত দিকের বর্ণনা খুব একটা পাই না।
সম্প্রতি সর্বহারা পার্টির সাবেক সংগঠক রইসউদ্দিন আরিফের এক সাক্ষাৎকারে এমন একটা ঘটনা পড়ছিলাম। যেখানে তিনি ময়মনসিংহ শহরের মার্চের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘… এরপর যা ঘটল, বিহারি কলোনিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। আমার ওয়াইফ, প্রথম স্ত্রী, আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালে মারা গেছে, তার এক বান্ধবী ছিল বিহারি। তারা আনন্দমোহন কলেজে এক সাথে ফার্স্ট ইয়ার অনার্সে পড়ত। সে দৌড়ে গেল তার বান্ধবীকে বাঁচাতে। সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখল, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধা ফোবিয়াতে ভুগত।’
আরও পড়ুন: রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর ‘শাটিকাপ’
আবার ‘রিফিউজি’ সিরিজের রিভিউতে এমডি রমিজ লিখছেন, ‘প্রায় এক যুগ আগের একটা সুন্দর দিনের ঘটনা। আমি বাসে করে ভার্সিটি যাচ্ছিলাম। এ সময় বাসে এক বিহারি বৃদ্ধ ও তার ১২-১৩ বছরের নাতি নিজেদের মাতৃভাষায় অনর্গল কথা বলছিল। তাদের এই ভাষা সম্ভবত বাসে থাকা কয়েকজন বাঙালি ভদ্রলোকের অনুভূতিতে আঘাত হানে। হঠাৎ তারা চিৎকার করে বৃদ্ধ আর তার নাতিকে চুপ হতে বলে এবং বাংলাদেশে থেকে উর্দুতে কথা বলার সাহস তারা কোথায় পেয়েছে- তার জবাবদিহি চায়। বৃদ্ধ অপমানে মাথা নীচু করে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু তার অল্প বয়সী নাতি যেন প্রতিবাদ করতে চায়! ছেলেটার সাহস দেখে বাঙালি ভদ্রমহোদয়রা আরো জোরে চিৎকার করে তার দিকে তেড়ে আসে! ছেলেটা এবার ভয়ে কেঁপে ওঠে এবং মাথা নীচু করে।’
এর বিপরীতে আমরা অনেক নৃশংস ঘটনা দেখাতে পারি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, উল্টো ঘটনাগুলো আমরা আড়াল করেছি। যেহেতু আমরা বিজয়ী, আমরাই ইতিহাস লিখেছি। ‘রিফিউজি’তেও এর কোনো বিপরীত বয়ান নাই। এমনকি উর্দুভাষীদের জবানে ফোটে না কোনো শের বা সংগীত। শুধু জঙ্গি কার্বন ছাড়া। এখন রাজনৈতিক বৈরি অবস্থার ভেতর অপেক্ষাকৃত ও নিধনযোগ্য সংখ্যালঘুর ওপর দোষ চাপানো সহজ। সেখানে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ একটি অংশ। এ সিরিজে যখন ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ বলা হয়, তখন পাকিস্তানে ‘আটকে পড়া বাঙালিদের’ কথাও মনে পড়ে।
বাংলাদেশে অডিও-ভিজ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মগুলো ক্ষমতাবলয়ের বয়ানের দখলে। দৃশ্য-অদৃশ্য নিয়ম-কানুন ও আনুগত্য এর ভিত্তি। তাদের নির্ধারিত শত্রু-মিত্র ভেদাভেদের মধ্য দিয়ে চলে। আবার সংখ্যালঘু প্রশ্নে বিশেষত নির্যাতন-হামলার ঘটনাগুলো আড়াল করে বিভেদ আরও বাড়িয়ে তুলে। সে মিডিয়ায় স্বভাবতই নাগরিক অধিকারহীন জাতিগত ও ভাষিক সংখ্যালঘু বিহারিরা অনুপস্থিত। তাদের উহ্য হয়ে থাকা কোনোভাবে আমাদের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। তাদের জন্য কোনো রাজনীতি নাই, আন্তর্জাতিক হুমকি নাই। কিন্তু নিত্য নতুন শত্রু খোঁজার দলে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছি, এটা যেমন ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রসূত, তার গ্রান্ড ন্যারেটিভকে আরেকটু প্রলম্বিত করা।
সারা দুনিয়ায় নিউ মিডিয়া নানা ধরনের প্রান্তিক বিষয় তুলে ধরছে। তার বিপরীতে বাংলাদেশে বিশেষ করে ওটিটি ক্ষেত্রেও ক্ষমতাবলয়ের বয়ানগুলোই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কেন্দ্রিক নীতিমালা তো আজকাল খুবই আলোচিত হচ্ছে। সেখানে ওয়েব ফিল্ম বা সিরিজে গুম-খুনের ভিকটিমকে ভিলেন আকারে দেখিয়ে এক ধরনের বৈধতা দেওয়া আমরা দেখেছি। দেখছি বিহারিদের নিয়ে এ গল্প। এ সব ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্মতিও লক্ষ্য করা যায়। এ সম্মতি ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বাইরেও এমন কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে আমাদের মন বিহারিদের প্রতি খারাপ ধারণাগুলোই পোষণ করে। যেখানে আমাদের কোনো প্রশ্ন নাই। কারণ, সত্য নিরেট দেয়াল হয়ে আমাদের সামনে হাজির। আর কিছু দেখতে দেয় না। সেখানে বনে বাঘ না থাকলেও মনের বাঘ হালুম করে ভয় দেখাতে পারে।