Select Page

মান-সম্মান : ঢালিউডে আধুনিক ‘দেবী চৌধুরানী’

মান-সম্মান : ঢালিউডে আধুনিক ‘দেবী চৌধুরানী’

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ভেতর কত বৈচিত্র্য লুকিয়ে আছে সেটা যারা দেখেন নাই তারা কোনদিনও বুঝবে না, জানবে না। গত শতাব্দীর ৭০-৯০ দশকের বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের রূপ, রস ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই সেই সময়কার চলচ্চিত্রগুলো আপনাকে দেখতে হবে। নাক সিটকালে হবে না।

বাংলা সাহিত্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক দুর্বোধ্য অধ্যায় অথচ তার ‘দেবী চৌধুরানী’’ উপন্যাসটিকে কী সহজ-সরল ও আধুনিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেটা আজকের অনেক চলচ্চিত্রকর্মী, বোদ্ধা ও দর্শকরাও জানে না। বঙ্কিম চন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরানী’কে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেই ১৯৮২ সালে অথচ ২০১৮ সালে এসেও এমন আধুনিকভাবে উপস্থাপন করার সাহস দেখায় না।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ‘মাস্টার মেকার’-খ্যাত এ জে মিন্টু ‘দেবী চৌধুরানী’কে চলচ্চিত্রের পর্দায় আধুনিকভাবে উপস্থাপন করেন সাড়াজাগানো ও দর্শকনন্দিত ‘মান সম্মান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ছবিটি সেই সময় ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের তালিকাতেও স্থান পায়। আর পাবেই না কেন? যে চলচ্চিত্রের পরিচালক এ জে মিন্টু আর কলাকুশলী আলমগীর, শাবানা, জসিম, আহমেদ শরীফদের মতো তারকারা থাকেন সেই চলচ্চিত্র ব্যর্থ হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। এ জে মিন্টু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অশিক্ষিত–শিক্ষিত সব শ্রেণীর দর্শকদের কাছে হৃদয়গ্রাহী ও সহজবোধ্যভাবে উপন্যাসের ‘দেবী চৌধুরানী’কে পৌছাতে পেরেছিলেন।

এ জে মিন্টু এই ব্যাপারে সহযোগিতা নিয়েছিলেন আধুনিক বাংলার সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের। ‘দেবী চৌধুরানী’র ছায়া ধরে চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেন সৈয়দ শামসুল হক এবং সিনেমায় রূপান্তর ও পরিচালনা করেন এ জে মিন্টু। যখন নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘সানফ্লাওয়ার মুভিজ’ থেকে ‘মান সম্মান’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন ঠিক তখনই শাবানার প্রযোজনা সংস্থা এসএস প্রোডাকশনস ‘মান সম্মান’ প্রযোজনা করার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং শাবানা ও তার স্বামী ওয়াহিদ সাদিক মিন্টুকে অনুরোধ করেন এসএস প্রোডাকশন্সের সাথে কাজ করার জন্য। মিন্টু প্রিয় অভিনেত্রী শাবানার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। এসএস প্রোডাকশনসকে প্রযোজনার দায়িত্ব দিয়ে নিজেকে শুধু পরিচালক হিসেবে ‘মান সম্মান’ চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। মুক্তির পরপরই যা সুপারহিটের তকমা পায়।

ব্যবসায়ী ঠিকাদারের মেয়ের বিয়েতে গিয়ে গ্রামের এক স্কুল মাস্টারের সুন্দরী মেয়ে জমিলাকে(শাবানা)পছন্দ করে বিয়ে করে ফেলেন আলমগীর।শহরে ফিরে আলমগীর তার মাকে জানালে আভিজাত্যের অহংকারের কারণে তা মেনে নেয় না। আলমগীর শাবানাকেই বউ করে ঘরে তুলে আনবে জিদ ধরে। আলমগীরের বড় বোন আনোয়ারা ও বোনের জামাই প্রবির মিত্র মিলে মাকে রাজী করায়। কিন্তু এরই মধ্য ঘটে যায় অন্য ঘটনা।

আলমগীরের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু জসিম বিয়ের অলংকারও শাড়ি নিয়ে শাবানার বাড়িতে দুদিন আগে এসে হাজির হয়। পূর্ব পরিকল্পনা মতো জসিম রাতের আঁধারে বিয়ের সব গহনা চুরি করে শহরে ফিরে গিয়ে শাবানার বাবা আনোয়ার হোসেনের উপর দোষ চাপায়। জসিমের কথা বিশ্বাস করে আলমগীর শাবানাকে ঘরে তুলে আনার ব্যাপারে মত বদলায় এবং সম্পর্কছেদ করে।

এদিকে মিথ্যা চোরের অপবাদ ও মেয়ের সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার দুঃখ সইতে না পেরে আনোয়ার হোসেন মারা যায়। আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর শাবানা আলমগীরের বাড়িতে যায়। কিন্তু আলমগীরের মা শাবানাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং আলমগীরও মাতালবস্থায় শাবানাকে প্রত্যাখ্যান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়।

যাওয়ার আগে স্বামী হিসেবে আলমগীরের কাছে শাবানা জানতে চায় সে কোথায় যাবে, কী করবে এবং কিভাবে নিজের ভরণ পোষণ চালাবে? জবাবে আলমগীর জানিয়ে দেয় চোরের মেয়ে চুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে। সেই রাতেই আলমগীরের শোয়ার ঘর থেকে আলমগীরের একটা ছবি চুরি করা দিয়েই শাবানার চোরের খাতায় নাম লেখায়। এরপর রাস্তায় এক চোর গোলাম মুস্তাফার সাথে পরিচয় হয় এবং তিনি শাবানাকে নিজের বোন পরিচয় দিয়ে চোরের সর্দারের কাছে নিয়ে যায়। শুরু হয় অপরাধ জগতে শাবানার বিচরণ। একদিন পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে জেলে গেলে এজলাসে বসা প্রবীণ এক ব্যারিস্টার সিরাজুল ইসলাম শাবানার সব ঘটনা জেনে বিস্মিত হয় এবং নিজের এক গবেষণার কাজে শাবানাকে কাজে লাগাতে সিদ্ধান্ত নেন।

ছয় মাস জেলে খেটে বের হওয়ার পর ব্যারিস্টার সিরাজুল ইসলাম শাবানাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। এদিকে শাবানার পূর্বের আশ্রয়দাতা মুস্তাফা ও চোর সর্দার শাবানাকে হন্য হয়ে খুঁজতে থাকে। …একসময় পেয়েও যায় তারা শাবানাকে এবং শহরের গডফাদার আহমেদ শরীফের হাতে তুলে দেয়। আহমেদ শরীফ নিজের দলে শাবানাকে কাজে লাগাতে বছরব্যাপি প্রশিক্ষণও দেয়। প্রশিক্ষণের পর শাবানা হয়ে উঠে আরও দুধর্ষ। অপরাধ জগতের কুইন হয়ে উঠে শাবানা।

এভাবে নানা ঘটনা পরিক্রমায় সবশেষে আলমগীর শাবানার মিলনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ‘মান সম্মান’ চলচ্চিত্রটি।

সাধুভাষায় রচিত একটি দুর্বোধ্য সাহিত্যকে নিজের মতো করে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করাটা ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু মাস্টার মেকার এ জে মিন্টু সেই ঝুঁকিতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলেন। শাবানা কত উঁচুমানের অভিনেত্রী সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। সিনেমার গল্পে বারবার শাবানার চরিত্র বদল হয়েছে এবং সবগুলো চরিত্রে শাবানা সফলতার সাথে উত্রে গেছেন যা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি ব্যাপার। প্রতিটা রুপেই শাবানা নিজেকে বারবার ভেঙেছেন। আলমগীর, জসিম, আহমেদ শরীফ, আনোয়ারা, সিরাজুল ইসলাম, প্রবীর মিত্র সবাই যার যার চরিত্রে অভিনয়ের দক্ষতা দেখিয়েছেন।

জসিম যে খলনায়ক চরিত্রে আমার দেখা সবচেয়ে আধুনিক ও স্টাইলিশ ছিলেন সেটা ‘মান সম্মান’ চলচ্চিত্রে আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। পুরো ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জসিম খলনায়ক ছিলেন এবং গল্পে বেশ বড় একটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন কিন্তু একবারও জসিমকে দেখা যায়নি অন্য ১০ জন খলনায়কের মতো অট্টহাসি দিতে কিংবা সাধারণ খলনায়কদের মতো চোখ মুখ বাঁকা করে সংলাপ বলতে। জসিম তার মতো করে খলনায়কের নিজস্ব একটা ধরন তৈরি করাতে পেরেছিলেন। এ জে মিন্টু জানতেন কিভাবে শতভাগ আদায় করে নিতে হয় আর সেটা সকলের কাছ থেকে মিন্টু খুব দক্ষতার সাথেই আদায় করতে পেরেছিলেন। প্রতিটি দৃশ্যকে মিন্টু বাস্তবতার সাথে মিল রেখে তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন এবং কিছু কিছু দৃশ্য সংলাপের মাধ্যমেই দৃশ্যটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার এবং দর্শকদের মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন যেখানেই মিন্টু সবার চেয়ে আলাদা।

উপন্যাসের সাথে মিল রেখে সৈয়দ শামসুল হক চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন অসাধারণভাবে যার সাথে সংলাপগুলো মিলে দারুণ প্রানবন্ত হয়ে উঠেছিলো গল্পটি। সিনেমার সংলাপগুলো ছিল সত্যি অসাধারণ। মুকুল চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ও আলম খানের সুর করা গানগুলোও ছিল শ্রুতিমধুর। বিশেষ করে ‘তোমাকে গড়েছে খোদা’, আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ/তোর দুনিয়াটা সামলা’, এবং ‘কারে বলে ভালোবাসা/কারে বলে প্রেম’ গান তিনটি ছিল সেই সময়ের দর্শক ও শ্রোতাদের মুখে মুখে। ‘মান সম্মান’ চলচিত্রটি পরিবারের সাথে কৈশোরে লালকুঠি সিনেমা হলে দেখেছিলাম, এরপর থেকে আজো ভুলিনি চলচ্চিত্রটির কথা। এমন একটি চলচ্চিত্রের কথা ভুলা কি যায়?

একটি উপন্যাসকে কিভাবে আধুনিকতার সংমিশ্রণে সব শ্রেণীর দর্শকদের জন্য একটি সার্থক চলচ্চিত্রে রূপান্তর করতে হয় সেটা এ জে মিন্টুর ‘মান সম্মান’ দেখে আজকের পরিচালকদের শেখা উচিৎ।


মন্তব্য করুন