মালেক আফসারী বা দেলোয়ার জাহান ঝন্টুরা পর্দার মিথ্যাটা একদম মন থেকে বলতেন
২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে এইটিজ বা নাইন্টিজের বাংলা মেইনস্ট্রিম সিনেমার পরিচালক (মালেক আফসারী, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু) আর তাদের সিনেমাকে সমালোচনা করা বেশ সোজা আর অনেক ক্ষেত্রে সমীচীনও বটে। তবে সেই সময়ের কথা ভাবলে, তাদের কাজটা যে ভীষণ কঠিন ছিলো আর মেইনস্ট্রিম সিনেমা যে এত ছেলের হাতের মোয়া না- সেটা আমরা বেশিরভাগই এখন স্বীকার করতে চাই না বা আমাদের বোধে আসে না।
মেইনস্ট্রিম সিনেমার মেকার মানে হচ্ছে, তিনি সিংহভাগ মানুষের পালস বোঝেন। এটা তো নিশ্চয় ফেলে দেয়ার মত কোন যোগ্যতা না? বেশিরভাগ মানুষের পালস বুঝতে পারা মানে বেশিরভাগ মানুষের কাছে সিনেমাটা পৌঁছানো এবং একই সঙ্গে এটাও একপ্রকারের নিশ্চয়তা যে, এই পরিচালক পরবর্তীতে কোনে সিনেমা বানালে সেইসব দর্শক আবারও আসবেন। যেহেতু দর্শক আবারও আসার গ্যারান্টি একপ্রকারের আছে, সেহেতু প্রোডিউসারও টাকা ঢালতে রাজি।
সবচেয়ে চমৎকার যে ব্যাপারটা, এরা নিজেদের কাজটায় অনেস্ট ছিলেন। তারা কখনই দর্শককে বোকা ভাবেন নাই, টেকেন ফর গ্র্যান্টেড নেন নাই। ‘আরে আমার সিনেমা তো দেখবেই’- এমন ভাবনা ভেবে শরীর শিথিল করে দেন নাই। ছয়টা গান, চারটা ফাইট, চৌধুরী সাহেব, প্রতিশোধের মাঝেও একটা তাল ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন।
আপনি তাদের বেশিরভাগ সিনেমার একটি সিন দেখলে পরের সিনে কী হবে- ইজিলি বলে দিতে পারবেন। কিন্তু এরপরেও একবার শুরু করলে টিভি বা ইউটিউবের সামনে থেকে সহজে উঠতে পারবেন না। কারণ তারা যাই বানাতেন, কনভিকশন দিয়ে বানাতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সিনেমা মোটামুটি দেখে এখন এসে আমার একটা জিনিসই মনে হয়- সিনেমা বানাতে লাগে কনভিকশন!
একই গল্প একজন বিশাল আয়োজনে বলছে- মজাই পাচ্ছি না। সেইম গল্প আরেকজন একদম নতুন আর্টিস্টকে নিয়ে বলছে, ভীষণ বিনোদিত হচ্ছি। কারণ এই পরিচালক সেই গল্পটা বিশ্বাস করে বলছেন। মিথ্যাটাও একদম মন থেকে বলছেন এমনভাবে যে আপনি বিশ্বাস না করে থাকতে পারবেন না।
আজকালকার উপমহাদেশীয় মেইনস্ট্রিম সিনেমাতে এই জিনিসটা আমি বেশ মিস করি। একমাত্র সাউথ ইন্ডিয়ানরাই এই ব্যাপারটা ধরে রাখতে পেরেছে যে কারণে তাদের এত জয়জয়কার। এটার পিছে অন্যতম একটা কারণ রাইটারকে মূল্যায়ন করা এবং তাদের প্রাপ্য সম্মান ও সম্মানী দেয়া।
মালেক আফসারীর আর কোনো সিনেমাই ‘এই ঘর এই সংসার’ কিংবা ‘ক্ষতিপূরণ’ লেভেলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। দেলোয়ার জাহান ঝন্টু যে পরিমাণ স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, অনেকে সারাজীবন সেই পরিমাণ বইও পড়ে নাই। কিন্তু তাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ সময়ের সাথে আগাতে না পারা, সময় বুঝে না চলা আর শুধুমাত্র অতীত রোমন্থনে আটকে থাকা। দেলোয়ার জাহান ঝন্টু যেভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করেন আর কতিপয় অসাধু সাংবাদিক নামের মানুষেরা যেভাবে তাকে আরও ক্ষেপিয়ে তোলেন, আমার ভয় হয় কবে না যেন তিনি হুট করে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন!
এদিক থেকে মালেক আফসারী দারুণ এক কাজ করেছেন ইউটিউবে এসে। সময়কে অনেকটা বুঝতে পেরেছেন তিনি। প্রায় রেগুলার তার ভিডিও দেখি আমি। ঘটনা ঘটতে দেরি আছে কিন্তু মালেক আফসারীর ভিডিও আসতে দেরি নাই। মানুষটার উপস্থাপনা ভীষণ এনার্জেটিক আর তার গল্পের ভাণ্ডার ফুরানোর নয়। অনেক ইয়ং ইউটিউবার যেখানে সপ্তাহে একটা ভিডিও দেন, সেখানে মালেক আফসারী একাধিক ভিডিও নিয়মিত দিচ্ছেন- ব্র্যাভো!
নিকেতনের অনেক ডিরেক্টর বা সমসাময়িক অনেক ডিরেক্টরই এফডিসির ডিরেক্টরদের তাদের প্রাপ্য ক্রেডিট দিতে চান না বা তাদের নাম কিংবা তাদের কাজের ব্যাপারে না জানাটাকে ‘কুল’ ভাবেন। আবার এফডিসির ডিরেক্টররাও মেইনস্ট্রিম সিনেমা বাদে অন্য কোনো গল্প বলাকে সিনেমা ভাবতেই চান না। এই একে অপরের মুখ না দেখাদেখি, এই বিভাজন, একে অপরকে অসম্মান, কাজের সমালোচনা না করে ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানো – আমাদের পতনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
তবে মালেক আফসারীদের যে জিনিসটা আমার ভাল্লাগে- তাদের ভেতরে যা, উপরেও তাই। আপনি তাদের সিনেমাকে পছন্দ করতে না পারেন, তবে তাদের প্যাশনকে অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। তারা যে তাদের (অন্ধ)বিশ্বাসে এখনও অনেস্ট- তা আপনি টের পাবেন আলাপ করলেই।
নিকেতনে এই ব্যাপারটা কম পাই আমি আমার সীমিত অভিজ্ঞতায়। তারা বিশ্বাস করেন একটা, বলেন আরেকটা, বানান আরেকটা। নিজের প্রোডাকশন বাদে অন্য যেকোনো ডিরেক্টরের ভুল খুঁজে বের করতে তারা শতাব্দীর সেরা শার্লক হোমস।
আরও কিছু ব্যাপার আমরা ভুলে যাই বা পাত্তা দেই না। মালেক আফসারী বা ঝন্টুরা তখন দর্শককে হলে টেনে এনেছেন, যখন প্রায় হাজারের উপর সিনেমাহল ছিলো। ফেসবুক ছিল না, ভিন্ন প্রচারের মাধ্যম একেবারেই ছিলো না। সেই যুগে টানা তিন ঘণ্টা মানুষকে বসিয়ে রাখা, দিনের পর দিন- চাট্টিখানি কথা নয়। অনেকের সিনেমা ৩০, ৪০ সপ্তাহও চলেছে। এখনকার ডিরেক্টরদের সিনেমা ৩০ দিন চলা মানেই বিশাল ব্যাপার।
আরেকটা স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেই। এফডিসির ডিরেক্টরদের কাছে কেউ টাকা পাওনা আছেন- এমন নিউজ আপনি শুনবেন না সাধারণত। কিন্তু নিকেতনের অনেক ডিরেক্টরের কাছে কত মানুষ যে কতশত টাকা পাওনা আছেন দিনের পর দিন- তা আপনি নিকেতনে একদিন হাঁটাহাঁটি করলেই জেনে যাবেন। ভণ্ডামির সীমা নাই আরকি!
অনেক বকবক করলাম, শেষ করি আলাপ। ছবিটা মালেক আফসারি পরিচালিত ‘ক্ষমা’ সিনেমার একটি দৃশ্য। বস্তিতে আগুন লেগেছে, মানুষ উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়াচ্ছে। এমন সময় আলমগীরের প্রবেশ। আপনি ধরেই নিয়েছেন- নায়ক এসেছে অর্থাৎ এখন সে আগুন নেভাবে। কিন্তু আপনাকে অবাক করে দিয়ে আলমগীর নিজের সিগারেট ধরাবেন আগুনে পুড়তে থাকা একটি বাড়ির এক কোনায় স্পর্শ করে। এই দৃশ্যের মাধ্যমে পরিচালক স্ট্যাবলিশ করে দিলেন, আলমগীর আসলে ‘নায়ক’ নন, বরং এই বস্তিতে আগুন লাগানোর পেছনের ‘খলনায়ক’ তিনি।
আমাকে বলতে পারবেন, লাস্ট কোন মেইনস্ট্রিম বাংলা সিনেমাতে আপনি এমন একটা বুদ্ধিদীপ্ত দৃশ্য দেখেছেন? এইসব swag দৃশ্য এখন এসে আরও আধুনিকভাবে, আরও উন্নত মেকিং এ অ্যাটলি কীংবা লোকেশ কানাগরাজ দেখান।
পুনশ্চ. ‘ক্ষমা’ বলিউডের সিনেমা ‘বেনাম বাদশাহ’র কপি। কিন্তু এরপরও দিনশেষে মালেক আফসারীর মুনশিয়ানার কারণেই সিনেমাতে তার পার্সোনাল টাচটা পাওয়া যায়।