Select Page

মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপনায় সার্বিক প্রচেষ্টা

মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপনায় সার্বিক প্রচেষ্টা

স্বাধীনতা, সে আমার– স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন–
স্বাধীনতা– আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতা দিয়ে ছবির শুরু। খিজির হায়াত খানের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের ছবি ‘ওরা ৭ জন’। স্বভাবতই ছবির নাম শুনে কালজয়ী ছবি ‘ওরা ১১ জন’-এর নাম মাথায় আসবে কিন্তু এ ছবিটি স্বতন্ত্রভাবে নির্মিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের ছবি গত এক দশকে যত হয়েছে বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। ‘ওরা ৭ জন’ মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতিকে স্পর্শ করার ভালো একটি প্রচেষ্টা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ৭ জনের একটি দল রণাঙ্গনে লড়াই করছে। তাদের মধ্যে শত্রুর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার শপথ আছে। তাদের জীবনের ভিন্ন ভিন্ন গল্প আছে।

ছবির গল্পের ভেতর আরেকটি গল্প আছে যেটি এ ছবিকে বিশেষত্ব দিয়েছে। পরিচিত মানুষ কিভাবে শত্রুতে পরিণত হয় তার একটা নমুনা দেখানো হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে যা যা সঙ্গত কারণে থাকা দরকার এ ছবিতে রাখা হয়েছে:

– গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে
– মা-বোনদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে
– রাজাকারবাহিনী তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে
– মুক্তিবাহিনীর অপারেশন চলছে
– আহত মুক্তিবাহিনীর সেবা দেওয়া হচ্ছে- রণাঙ্গনে নারীও আছে পুরুষের পাশাপাশি
– বীরাঙ্গনাদের অস্তিত্বের লড়াই

খিজির হায়াত খান মুক্তিযুদ্ধের দলনেতার চরিত্রে ছিল। তার অভিনয় পূর্ববর্তী দু-একটি ছবির তুলনায় বেশ ভালো ছিল। ডাক্তার চরিত্রে ইন্তেখাব দিনারের অভিনয় বরাবরের মতোই ব্যক্তিত্বপূর্ণ। আরেক ডাক্তার জাকিয়া বারী মমর চরিত্রটি পুরো মুক্তিযোদ্ধা দলে সবচেয়ে আলাদা। আলাদা চরিত্রটি মম অসাধারণভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে তার স্বকীয় ন্যাচারাল অভিনয়ে। হানাদারের সাথে তার কথোপকথনের সময় তার চোখ দিয়ে যেন আগুন জ্বলছিল।

ইমতিয়াজ বর্ষণের গেটআপই যেন সবার চেয়ে তাকে ভিন্ন করেছে। তার অভিনয় ও সংলাপের মধ্যেও ভিন্ন ফ্লেবার আছে। শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীবও ন্যাচারাল ছিল, খিজির হায়াতের আগের ছবিতেও সজীব ছিল। জয়রাজ নেগেটিভ চরিত্রে সবসময়ই দারুণ। শিবা সানুর নিজের ট্র্যাকের বাইরে আলাদা রকমের অভিনয় প্রশংসনীয়। বিশেষ একটি চরিত্রে অর্ষা অনবদ্য। অন্যান্যরাও ভালো অভিনয় করেছে। সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে সাধারণ মানুষের চরিত্রে যারা ছিল যাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে তাদেরকে দিয়েও ন্যাচারাল অভিনয় করানো হয়েছে। তবে পাকিস্তানি হানাদারদের চরিত্রগুলো তুলনামূলক দুর্বল অভিনয় করেছে।

গত দশকের মুক্তিযুদ্ধের ছবির মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন দেখানোর ক্ষেত্রে তারতম্য ছিল। ‘ওরা ৭ জন’-এ মুক্তিবাহিনীর অপারেশনকে লং সিকোয়েন্সে দেখানো হয়েছে। বিরক্তি আসেনি। ইউনিক কিছু সিকোয়েন্সও রাখা হয়েছে যা ছবির মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক অপারেশনের সময়ই সবচেয়ে ভালো ছিল। রণাঙ্গনে ইসলামী চেতনার ব্যবহারও এ ছবিতে পূর্বের মুক্তিযুদ্ধের ছবির থেকে ভিন্ন উপস্থাপনা ছিল।

পুরো ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের ভাইভ ধরে রাখার চেষ্টা ছিল অনেক। গানগুলোর মধ্যে ‘যাও দিলাম যেতে’ বেস্ট ছিল। সিলেটের পাহাড়ি লোকেশনে অপারেশনের সময়গুলো দেখতে ভালো লেগেছে।

ছবির অর্থপূর্ণ কিছু সংলাপ:

১. ফুলগাছটা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে কাল ভোর হবার আগেই আমরা মৌমাছির চাকটা ভাঙব, খাঁটি মধু খেতে অবশ্যই আসবেন।
২. অস্ত্র তুলে নেইনি বলে কি আমি সৈনিক নই?
৩. যাকে তোমরা বিশ্বাসঘাতক বলো সে আমার জন্য মুক্তিযোদ্ধা।

প্রথম সংলাপটি সেরা এবং স্বাধীনতাকে প্রতীকী অর্থে তুলে ধরা হয়েছে।

‘ওরা ৭ জন’ ছবির বাজেট যে কম ছিল সেটা বোঝা যায় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের টোটালিটি দেওয়ার মতো সুন্দর একটি প্রচেষ্টা ছবিটির মধ্যে সুস্পষ্ট। এ প্রচেষ্টার জন্যই ছবিটি মুক্তিযুদ্ধের ছবির মধ্যে উল্লেখ করার মতো ছবি হয়ে থাকবে।

রেটিং – ৭.৫/১০


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গত শতকে যেভাবে সমৃদ্ধ ছিল সেই সমৃদ্ধির দিকে আবারও যেতে প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। সেকালের সিনেমা থেকে গ্রহণ বর্জন করে আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠুক। আমি প্রথমত একজন চলচ্চিত্র দর্শক তারপর সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন দেখি। দেশের সিনেমার সোনালি দিনের উৎকর্ষ জানাতে গবেষণামূলক কাজ করে আগামী প্রজন্মকে দেশের সিনেমাপ্রেমী করার সাধনা করে যেতে চাই।

মন্তব্য করুন