Select Page

মুখ ও মুখোশের আড়ালে আয়নার ভেলকিবাজির গল্প

মুখ ও মুখোশের আড়ালে আয়নার ভেলকিবাজির গল্প

aynabaji

শহরের অলিগলিতে হাজার লোকের বাস। কেউবা ভালো, কেউবা মন্দ। আবার ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে থাকে কিছু মন্দ মানুষ-দাগী আসামীরা। টাকার জোরে সেসব ক্ষমতাবান আসামীরা পার পেয়ে যায়। তাদের কারনে বা তাদের হয়ে জেল খাটে নিরপরাধ সহজ-সরল মানুষেরা। কেউ কেউ জেল খাটে মাস বা বছর, কারো হয়ে যায় মৃত্যুদন্ড বা ফাঁসি। এদের মধ্যে কেউ কেউ এটাকে পেশা হিসেবে নিয়ে নেয়। এমনি একজনের গল্প এই আয়নাবাজি। এই শহরের গল্প ‘আয়নাবাজি’।

আয়না একজন অভিনেতা। না সে কোন মঞ্চ, নাটক বা চলচ্চিত্রের অভিনেতা নয়। পুরো দুনিয়া, বিশেষকরে জেলখানা তার অভিনয়ের স্থান। টাকার বিনিময়ে সে অন্যের হয়ে জেল খাটে। দাগী আসামী না হয়েও সন্দেহের চোখে পড়ে ক্রাইম রিপোর্টারের। এদিকে পাশের বাড়িতে আসা হৃদি নামের মেয়েটিকে ভালো লেগে যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু ক্রাইম রিপোর্টার নাছোড়বান্দা হওয়ায় অগত্যা তাকে এলাকা ছেড়ে যেতে হয়। এরই মধ্যে এই অভিনয়ের খেলা খেলতে খেলতে সে পরে যায় বড় রকমের এক ফাঁদে। এখন কি হবে তার পরিণতি?

চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন সৈয়দ গাওসুল আলম শাওন, আনম বিশ্বাস এবং সংলাপ লিখেছেন আদনান আদিব খান। গতানুগতিক বানিজ্যিকধারার চলচ্চিত্রের গল্পের মত জোড়াতালি বা নকল গল্প নয়। একদম মৌলিক গল্প। এই শহরের গল্প। এই শহরের মানুষের গল্প। গল্পের শুরুটা ছিল ভিন্ন। প্রথমেই আয়নাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় দর্শকের সামনে। তার চরিত্র সম্পর্কেও ধারনা পাওয়া যায় এতে। সংলাপগুলো ছিল অনবদ্য। কমেডি থেকে শুরু করে গুরুগম্ভীর সব ধরনের আমেজ ছিল সংলাপে। কিছু দৃশ্য অন্তর অন্তর ছিল হিউমারাস কমেডি। কাবিলা বা আফজাল শরীফের সস্তা কমেডি নয়। এটি পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরীর প্রথম চলচ্চিত্র। প্রথম হিসেবে তিনি দুর্দান্ত কাজ করেছেন। গল্প বলা, গল্পের দৃশ্যায়ন এবং পরিসমাপ্তি এককথায় অসাধারন। ডিজিটাল চলচ্চিত্রের এই সময়ে অমিতাভ রেজার এই কাজ কালজয়ী হয়ে থাকবে। তবে হঠাৎ করে কথার মাঝে ইন্টারমিশনটা বেখাপ্পা লেগেছে। এটা জাস্ট আগের সিনটায় হলেই ভালো হত।

চঞ্চল চৌধুরী মূল চরিত্র আয়নাসহ ছয়টি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রতিটি চরিত্রে তিনি নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। একজন অভিনয় শিক্ষক আয়না, পারভার্ট বস, পোস্টমাস্টার, মানসিক প্রতিবন্ধী যুবক, রাজনৈতিক নেতা, এবং সবশেষে পুলিশ গার্ড চরিত্রের রূপায়ন ঘটিয়েছেন নিখুঁতভাবে। প্রতিটি চরিত্রে প্রবেশ এবং সেই চরিত্রের বাস্তবায়ন দেখার মত। এছাড়া কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তার এই অবস্থায় আসতে। এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য পাওয়ার পর তার ওজন কমাতে হয়েছে ১৫ কেজি। সাড়ে তিন মাস ভাত কম খেয়ে এবং আড়াই মাস নিয়মিত দু’ঘন্টা করে ব্যায়াম করেছেন। তার এই পরিশ্রম সার্থক।

চঞ্চলের বিপরীতে ছিলেন মাসুমা রহমান নাবিলা। এটি ছিল তার প্রথম চলচ্চিত্র। নবাগত হিসেবে তার সেরাটাই দিয়েছেন। নায়িকা হিসেবে অতিরঞ্জিত আহ্লাদী বা ন্যাকামোপনা ছিল না তার অভিনয়ে। তার চরিত্রটি তিনি বিশ্বাসযোগ্যভাবেই উপস্থাপন করেছেন এবং আকর্ষণ ধরে রেখেছেন। ক্রাইম রিপোর্টারের চরিত্রে পার্থ বড়ুয়া চরিত্রটি গুরুত্ব বহন করে। প্রথমদিকে তার অভিনয় নিয়ে একটু সংশয় দেখা দিলেও বারবার ব্যর্থ হয়েও লেগে থাকা এবং আয়নার আসল পরিচয় খুঁজে বের করা – এরকম যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন সর্বোচ্চটুকু দিয়েই চেস্টা করেছেন। তবুও সে কিভাবে আয়নার আসল পরিচয় জানতে পারল এ নিয়ে খটকা থেকে যায়। এছাড়া অন্যান্য চরিত্র – পারভার্ট বসের চরিত্রে লুতফর রহমান জর্জ, স্টুডিও মালিক শাওন, কমেডি চরিত্রে জামিল, পুলিশ গার্ডের চরিত্রে বৃন্দাবন দাস ভালো করেছেন। আর অতিথি চরিত্রে আরিফিন শুভ দর্শকদের হাততালি কুড়িয়েছেন। তবে প্রথম ভিকটিম মেয়ের বাবার চরিত্রের লোকটার অভিনয় অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে।

কাহিনী, পরিচালনা ও অভিনয়ের পাশাপাশি কারিগরী দক্ষতা ছবিটিকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। ঢাকা শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে সদরঘাট সবকিছুই বৈচিত্রময় ও সুচারুরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামান। ভোরের আকাশ, বুড়িগঙ্গা, সদরঘাট, রাস্তার আশেপাশের বিভিন্ন দৃশ্য খুব ভালোভাবে ধারন করেছেন। সম্পাদনা ও শব্দগ্রহনও ছিল ঠিকঠাক। আয়নার বিভিন্ন চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন তারিক আনাম খান, আলী যাকেরদের মত অভিনেতারা। তাদের ডাবিং রেকর্ডও ভালো হয়েছে। আরেকটি বড় বিষয় ছিল মেকআপ। কোলকাতার মোহাম্মদ আলী এই বিভাগে দারুণ করেছেন। চঞ্চলের প্রতিটি চরিত্রে আলাদা আলাদা মেকআপ এবং সবগুলোই ছিল একটা আরেকটা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেন ছয়জনকে ছয়ভাবে সাজানো হয়েছে।

ছবির আবহসঙ্গীত পরিচালনা করেছেন কোলকাতার ইন্দ্রদীপ আর সঙ্গীতায়োজন করেছেন অর্ণব, ফুয়াদ, হাবিব ও চিরকুট ব্যান্ড। শুরুতে ঢাকার বিভিন্ন লোকেশনের সাথে অর্ণবের “প্রাণের শহর” মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। জেলখানায় চিরকুটের “দুনিয়া” আর এর কোরিওগ্রাফি ছিল অসাধারন এবং মাঝে হাবিব-অন্বেষা জুটির “ধীরে ধীরে যাও সময়” রোমান্টিক গানটি শ্রুতিমধুর ছিল। শেষটাতে ফুয়াদ আয়নার “ভেলকি” লাগিয়ে সমাপ্তি টানল।

সর্বোপরি, সাসপেন্স দিয়ে ভরপুর আয়নাবাজি দর্শকদের ভেলকি লাগাতে সক্ষম। আশা করি, দর্শকরা দারুণ উপভোগ করবে আয়নার ভেলকিবাজি।

আমার রেটিংঃ ৪.৫/৫


২ টি মন্তব্য

    • নিউজ ডেস্ক

      ঠিকই শুনেছেন। নতুন গল্পে টেলিভিশন সিরিজ ‘আয়নাবাজি’। বিস্তারিত goo.gl/vb4VKm

মন্তব্য করুন