Select Page

‘মুন্সিগিরি’র মুনশিয়ানা

‘মুন্সিগিরি’র মুনশিয়ানা

সুরাইয়া রূপে পূর্ণিমার মুখের একটি সংলাপ ছিল, বিচার হলে আমি কী পাবো? পেনশনের টাকাটা তাড়াতাড়ি পাবো? যে দশটা অফিসে ঘুরতে হচ্ছে সেটা লাগবে না?

সংলাপটা স্বামী হারানো এক স্ত্রীর অভিমান বা রাগ বলে মনে হলেও নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী কিন্তু বুঝিয়ে দিলেন এই ডিজিটাল যুগেও পেনশন, ইন্সুরেন্সের টাকার জন্য চলে যাওয়া মানুষটার পরিবারের সদস্যদের কতো ঝড়ঝঞ্চা পার করতে হয়। এই দৃশ্য বা সংলাপের মতো করে ৮৫ মিনিটের হত্যা রহস্যর ‘মুন্সিগিরি’ নামের ওয়েবফিল্মে আমাদের সমাজ, জীবন, পরিবার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নানা রকম সিচুয়েশনের মধ্য দিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যু উপস্থাপন করা হয়েছে বেশ ভালোভাবেই।

গল্পটা সোজা এবং সরল। রাজধানীতে একজন সরকারি কর্মকর্তা খুন হয়ে যান। সেই খুনের তদন্তের দায়িত্ব পড়ে ডিবি গোয়েন্দা মাসুদ মুন্সি এবং তার টিমের ওপর। প্রথম থেকেই খুনী কে সেটা একটু একটু আন্দাজ করা গেলেও কেন খুনটা হলো এবং কীভাবে সেটাই শিবব্রত বর্মনের লেখা গল্পে পড়ার পরেও সেলুলয়েডে সেটা দেখার সময় একটা আগ্রহ বজায় ছিল চিত্রায়ণ, মানানসই অভিনয় এবং নির্মাণের মুনশিয়ানার কল্যানে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি যে কোনো ফিকশন দেখার আগে জিরো এক্সপেকটেশন নিয়েই বসি। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে এটাও সত্য ‘আয়নাবাজি’র পর অমিতাভ-চঞ্চল জুটি, পূর্ণিমা এবং শবনম ফারিয়ার ওটিটি অভিষেক, গোয়েন্দা গল্প সব মিলিয়ে মাথায় নানা রকম বিষয় তো ঘুরছিল। পুরো ৮৫ মিনিট পার করার পর কোথাও কোথাও একটু অভিযোগ থাকলেও আমার কাছে ‘মুন্সিগিরি’ খারাপ লাগেনি।

ডিবি গোয়েন্দা মাসুদ মুন্সি হিসেবে চঞ্চল চৌধুরীর উপস্থিতি বিশ্বাসযোগ্য ছিল। ডিবির তদন্তের সময়কার কিছু বিষয় মাঝেমধ্যে একটু প্রশ্ন তুললেও সেটা স্ক্রিনপ্লেকে বোরিং করেনাই। মাসুদ মুন্সীর পারিবারিক জীবন, স্ত্রী-সন্তানের সাথে তার সম্পর্ক, ডিউটির ফাঁকে কাওরানবাজারে বাজার করা, বাসায় সন্তানকে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ালেখার দিকে খেয়াল রাখা বা উদয়ন শব্দের অর্থ বূঝিয়ে দেয়ার সময় একজন সাধারণ বাবা সব কিছুই বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তব বলেই মনে হয়েছে। উপন্যাসের মতোই এই গোয়েন্দা চরিত্র কিন্তু সিক্স প্যাক বা ফিট কোনো গোয়েন্দা না যেমনটা আমরা জেমস বন্ড বা ইথান রূপে টম ক্রুজকে দেখে আসছি। মারামারিতে পারদর্শী বা আকর্ষণীয় লুকও তার নাই। বাঙালি একজন সহজ এবং সাধারণ চেহারার গোয়েন্দা হিসেবে তাই মুন্সিগিরির মুন্সি মন জয় করবে সহজেই।

মাসুদ মুন্সির স্ত্রী পারভীন রূপে শবনম ফারিয়া ছিলেন সাবলীল। স্বামীর কেসের প্রতি তার আগ্রহ, কেস সমাধানে আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসে আরো একটু বেশি ব্যাপার থাকলেও সেলুলয়েডে কিছু অংশ বাদ পড়েছে। তবুও তার ভালোবাসা, অভিমান, রাগ আবার স্বামীর কেসে সাহায্য করা সবই সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে শবনম ফারিয়ার অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে। তবে স্বামী-স্ত্রী জুটি হিসেবে চঞ্চল এবং ফারিয়া খুব বেশি স্ক্রিনটাইম পাননি তবুও তাদের কেমেস্ট্রি ভালো লেগেছে।

এবং সুরাইয়া আক্তার রূপে চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা আলো ছড়িয়েছেন যতটা সময় তিনি স্ক্রিনে উপস্থিত ছিলেন। চঞ্চল চৌধুরীর মতো দক্ষ এবং শক্তিশালী অভিনেতার সাথে বলা যায় পাল্লাই দিয়েছেন এই নান্দনিক অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র মাধ্যম পূর্ণিমাকে পুরোটা ব্যবহার করতে পারেনি দামনে ওটিটি হয়তো এই গুনী অভিনেত্রীকে আরো ভিন্নধর্মী কাজে সুযোগ দিবেন। তার গ্ল্যামার, অভিনয় সবই ছিলো সহজাত এবং সুন্দর।

এ ছাড়া স্বল্প সময়ে নিজেদের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে নজর কেড়েছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, আহসান হাবীব নাসিম, গাজী রাকায়েত। ইশতিয়াক মির্জা চরিত্রে গাজী রাকায়েত আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন এটা বললে ভুল হবে না। সারপ্রাইজ ক্যামিও ইমতিয়াজ বর্ষণও নিজের সেরাটাই দিয়েছেন। পোস্টার, ট্রেলারে তার উপস্থিতি না থাকলেও গল্পে তার গুরুত্ব ভালো লেগেছে। আমাদের দেশে ক্যামিও হিসেবে এই রকম শিল্পীদের উপস্থিতি কম চোখে পড়লেও আশা করি সামনের দিনগুলোতে অভিনয়শিল্পী এবং নির্মাতারা এইদিকেও নজর দিবেন।

শিবব্রত বর্মণের গল্পে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যায় যে, অনেকগুলো ঘটনা বা চরিত্র সমান গুরুত্ব পেয়েই তার গল্প এগোয়। উপন্যাস বা গল্পের মতো করে সেলুলয়েডেও তাই পাওয়া গেল। এটাও একটা বড়ো স্বস্থির বিষয় যে মূল গল্পের আবেদন ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। অমিতাভ রেজা চৌধুরীর নির্মাণ আলাদা ছাপ রাখে বরাবরই। কিছু ড্রোন শট, তেজগাঁও বা কাওরানবাজার অথবা সুরাইয়ার কলোনির বাসা এসব কিছুই রিয়েল লোকেশনে শুটিং হয়েছে যা চোখকে স্বস্তি দেয় এবং গল্পের সাথে মিশে যেতে সাহায্য করে। এছাড়া এই গুণী নির্মাতার ফ্রেম বা কালার গ্রেডিংও প্রশংসার যোগ্য। তবে শেষের দিকে এসে সবকিছু যেন একটু তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেলো এটা নিয়ে একটু আক্ষেপ আছে আমার।

মুন্সিগিরি সিরিজের প্রথম গল্প ‘মৃতেরাও কথা বলে’। সামনে আরো গল্প আসবে কিনা সেটা নিয়ে ঘোষণা না এলেও ডিবি গোয়েন্দা হিসেবে মাসুদ মুন্সি আরো অনেক কেস এরকম সাবলীলভাবে সলভ করবে সেলুলয়েডে এটাই কামনা। সময় থাকলে দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’ তে দেখে নিতে পারেন এই ওয়েবফিল্মটি। আশাকরি খারাপ লাগবে না।


মন্তব্য করুন