Select Page

মুন্সিগিরি: একটি ম্যাড়মেড়ে অ্যাডাপ্টেশন

মুন্সিগিরি: একটি ম্যাড়মেড়ে অ্যাডাপ্টেশন

বই থেকে সিনেমার অ্যাডাপ্টেশন কদাচিৎ লক্ষ্যভেদ করে। পাঠক সন্তুষ্টি অর্জন করা ভীষণ কঠিন কাজ। আবার আলাদা মিডিয়াম হবার কারণে নির্মাতা ক্রিয়েটিভ ফ্রিডমের হকদার। তিনি চাইলেই প্রতিষ্ঠিত কাজের পুনর্নির্মাণ করতে পারেন। ব্যক্তিগতভাবে, আমি এই স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে সে অ্যাডাপ্টেশনকে নিজ যোগ্যতায় ভালো হতে হবে। আমার দেখে ভালো লাগলো কিনা সেটাই চূড়ান্ত ব্যাপার—সেটা অ্যাডাপ্টেশন হোক বা মৌলিক।

মুন্সিগিরি আমার সেরকম ভালো লাগেনি। ট্রেলারের বেলায় যেমন দায়সারা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম। সিনেমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। গড়পড়তা সিনেমা থেকে আলাদা মুন্সিগিরি—এবং সেখানেই এর দৌড় শেষ। আলাদা কিন্তু মনে রাখার মতো নয়। যেহেতু সেরকম মনঃপূত হয়নি তাই স্বাভাবিকভাবেই তুলনামূলক আলাপটা প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে!

লেখক শিবব্রত বর্মণ আমার সাম্প্রতিককালের সেরা আবিষ্কার। তাঁর প্রতিটা লেখাই অসম্ভব ভালো লেগেছে। তাঁর গল্পের অ্যাডাপ্টেশন যে সঠিক হাতে পড়লে চমৎকার হতে পারে সে উদাহরণও আছে। চরকিরই ‘ঊনলৌকিক’ টিম সেটা করে দেখিয়েছেন। আমি এই সিরিজের ভূয়সী প্রশংসা করেছি। প্রত্যেকটা পর্ব অনবদ্য।

মুন্সিগিরির বেলায় সে মন্তব্য করতে পারছি না। মূল গল্পের পরিবর্তন নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই সেটা আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু দৃশ্যায়িত গল্পকে কোহিসিভ তো হতে হবে, নাকি! অনুসন্ধানী চরিত্রগুলোর মধ্যে যেমন প্রচুর সাদৃশ্য থাকে। তেমনই একেকটি চরিত্রের কিছু স্বকীয় গুণও থাকে। শার্লকের যেমন ওয়াটসন আছে, ব্যোমকেশের অজিত, ফেলুদার তোপসে—তেমনই মুন্সির আছে পারভীন। ব্যোমকেশের সঙ্গে সত্যবতীর সম্পর্কটা প্রেমময়। মুন্সির স্ত্রী পারভীন শুধু এই প্রেমময়য় সাংসারিক দিকটাই ফোকাস করেনি বরং মুন্সির সেরা বন্ধু, অনুসন্ধানের সহযোগীও সে। সিনেমায় আমরা দেখি, পারভীন বেশ খানিকটা অসন্তুষ্ট মুন্সির ব্যস্ত কর্মজীবন নিয়ে। তাহলে সেই পারভীন কেন মুন্সিকে তদন্তে সহযোগিতা করতে যাবে? গল্পের পারভীন সাহায্য করে কারণ সে ভাবিদের আড্ডা হোক আর দৈনন্দিন জীবন হোক, মুন্সিকে নিয়ে সবখানেই ভীষণ প্রাউড।

পারভীন এমনকি সাংঘাতিক বুদ্ধিমতীও বটে। মুন্সির তদন্তের বড় বড় বাধাগুলো সে সূক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে ডিঙাতে সাহায্য করে। যাকে বলে সক্রিয় সহযোগিতা—প্রোঅ্যাক্টিভ। সেই পারভীনকে সিনেমায় যে ট্রিটমেন্ট দেয়া হয়েছে সেটা সিনেমার গল্প অনুযায়ীই সাংঘর্ষিক। নারী চরিত্রের এমন পোর্ট্রেয়াল একটা কমন ক্লিশেতে পরিণত হয়েছে। মুন্সিগিরিও এর ব্যতিক্রম নয়।

মুন্সি সাধারণত প্রকাশ্যে তাঁর স্ত্রীর অবদান স্বীকার করে না। এটাকে তাঁর দাম্ভিকতা হিসেবে দেখতে পারেন। কিংবা লেখকের একটা সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা ভাবতে পারেন কেন্দ্রীয় চরিত্রের ত্রুটি উপস্থাপনে। মুন্সি বিবলিকাল কোনো ফিগার না, যে কিনা দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে। যেভাবেই বিচার করেন সেটা গল্পের পাতায় পাঠক হিসেবে বেশ এঞ্জয়েবল। পর্দায় তার কোনো ছিটেফোঁটাও নেই।

মুন্সিকে কেন ‘ম্যানুয়েল মুন্সি’ বা ‘এনালগ মুন্সি’ বলা হয় তার কমিকাল অ্যাঙ্গেল আছে গল্পে। সেটাকে শুধু একটা এক মাত্রিক চেইস সিন দিয়ে উপস্থাপন হাস্যকর লেগেছে। দেখুন, মুন্সি চিরায়ত তদন্তে বিশ্বাসী, তাঁর মতে ক্রাইম ডিটেকশনের যে উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, বুদ্ধির ঝিলিক সেটা ওই ডিজিটাল পদ্ধতিতে উধাও। সেই মুন্সি একসময় নিরুপায় হয়ে ফোন ট্র্যাকিংয়ের মতো অত্যাধুনিক পদ্ধতির দ্বারস্থ হয়। এই মুহূর্তটা মুন্সি চরিত্রকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত একটা কাজ এখানে দারুণ অর্থবহ। সেই আবেদনটা কোথায় সিনেমাতে?

কিংবা তদন্তে মুন্সির যে একনিষ্ঠতা, সিস্টেমকে বারবার চ্যালেঞ্জ করার অভিপ্রায় কোথায় সেটা? গল্পের মুন্সি কেস হাতে নেবার পর থেকে এগজিস্টিং তদন্তকে বারবার চ্যালেঞ্জ করেছেন, সহকর্মীদের এক প্রকার হেনস্তা করে ছেড়েছেন। তাঁর এই ‘ম্যানুয়েল’ তদন্তের অ্যাপ্রোচই তাঁর ‘ডাকনাম’-কে কমপ্লিমেন্ট করেছে। সিনেমায় এই এস্টাবলিশমেন্ট কোথায়!

গল্পের সেন্ট্রাল কনফ্লিক্টের ব্যাপারে আসুন তবে। সিনেমার ইশতিয়াক মির্জা কেন শুরু থেকেই ইনভেস্টিগেশনে অসহযোগিতা করছেন? সিনেমার সমাপ্তি অনুযায়ী এটা একেবারেই পয়েন্টলেস, অযৌক্তিক। সিনেমার গল্প অনুযায়ী তো ইশতিয়াক মির্জার হেসে-খেলে সাহায্য করার কথা।

গল্পের মুন্সির কাছে কেস এসেছে খুনি আছে কিন্তু খুনের মোটিভ নেই, সেটা বের করার দায়িত্ব হিসেবে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক সংস্থা থেকে উল্টো ঘুরে মুন্সির হাতে আসে কেসটা। সিনেমায় সে অ্যাঙ্গেল কোথায়!

মূল গল্পে দুই লেখকের গল্প মিলেমিশে যে আভাগার্দ সাহিত্য রচনা বিষয়ক মোচড়টা আছে তা ‘মৃতেরাও কথা বলে’ গল্পকেই যেন মেটা-রেফারেন্স দিচ্ছিল! ব্যাপারটা দারুণ এঞ্জয়েবল যদি আগে থেকেই পাঠক কিছু অনুমান করে থাকেন। সিনেমার গল্পে এই চমৎকৃত হবার উপাদানটা একেবারেই অনুপস্থিত। সুরাইয়া চরিত্রের ট্রিটমেন্টটা সে হিসেবে খুব একটা শার্প মনে হয়নি।

সিনেমায় হুটহাট করে সিন কাট দিয়ে যে এজি ফিলিংস দেবার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা ভালো লাগেনি। ট্রানজিশনগুলো আরও স্মুথ করলে এমনিতেই দর্শক সিটের সঙ্গে লেগে থাকতো। আমার ভয় হয়, এই শার্প-কাটের কারণে অনেক দর্শকই গল্প থেকে কমপ্লিটলি ডিটাচড হয়ে যাবেন! এই নিরীক্ষা অন্য কোনো প্রোজেক্টে মানানসই, মুন্সিগিরি টেস্ট-সাবজেক্ট হিসেবে সম্পূরক নয়।

সিনেমার গল্প অনুযায়ী সিনেমার শেষটা ভীষণ তাড়াহুড়ো করে করা। পাজলগুলো যখন মিলছে তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনারা খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন। এখানে বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

কারো অভিনয় নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। মোটামুটি সবার অভিনয়ই ভালো লেগেছে। স্ক্রিপ্টটা আরও টাইট হলে আরও দারুণ কিছু হতে পারতো এই সিনেমা।

আপনারা কী দেখবেন? দেখতে পারেন ক্রাইম জনরার সিনেমা হিসেবে নতুন কিছু দেখতে। কিন্তু খুব একটা আশা না রাখলেই ভালো হবে। উপন্যাসটা আগেই পড়া আছে? তাহলে স্কিপ করতে পারেন। ‘ঊনলৌকিক’ সিরিজটা দেখতে পারেন, দারুণ সময় কাটবে।


Leave a reply