মৌসুমীর অন্তিম ইচ্ছা নিয়ে আজহারী ও আফসারীর মন্তব্য
মিজানুর রহমান আজহারী ও মালেক আফসারী। একজন প্রভাবশালী ইসলামি বক্তা, অন্যজন এক সময়ের নামি পরিচালক। দুজনই একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরামর্শ দিলেন। উদ্দেশ জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমী। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ‘১৩টি প্রশ্ন’ শিরোনামে অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে নিজের কিছু অন্তিম ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন তিনি। এরপর বিষয়টি ঘিরে চারদিকে চর্চা শুরু হয়। যা নিয়ে আমজনতা থেকে বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা মৌসুমীর সহকর্মী; কারো মন্তব্যের বাদ পড়ছে না।
মৌসুমী মৃত্যুর আগে জীবনের কিছু শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, আমি যদি মরে যাই, আমার সব ভুলের জন্য ক্ষমা চাই সবার কাছে। ক্ষমা করে দেবেন আমাকে। আমার কয়েকটি ইচ্ছা আছে।
তিনি বলেছিলেন, আমি মারা যাওয়ার পর আমার লাশ যেন কাউকে দেখতে দেওয়া না হয়। অবশ্যই খুব গোপনে যেন কবর দেওয়া হয়। জানাজা হবে, কিন্তু আমি চাই না কেউ আমাকে আর দেখুক। আর মারা যাওয়ার আগে বড় হজ করার ইচ্ছা রয়েছে। আপনারা দোয়া করবেন আমার জন্য। আমার নিজের চেষ্টা তো রয়েছেই, সবার দোয়াও কাজে লাগে।
এ ছাড়া মৌসুমী অনুরোধ করেন, মৃত্যুর পর তার ছবিগুলো যেন সবার ফোন থেকে মুছে দেওয়া হয়। এমনকি টিভি চ্যানেলেও যেন ‘ধুমধড়াক্কা’ কোনো ছবি দেখানো না হয়।
মৌসুমী বলেন, যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমার কোনো কাজ মনে হয় যে আর্কাইভে রাখলে ভালো হবে, গবেষণার জন্য প্রয়োজন আছে, তা হলে সে উদ্দেশ্যেই ছবিগুলো সংরক্ষিত হবে। অবশ্যই বাছাই ছবিগুলো আর্কাইভে রাখা হবে, ভালো উদ্দেশ্যে। এ ছাড়া অন্য সব ছবি ডিলিট করে দিলে ভালো হয়।
পরবর্তীতে এ প্রসঙ্গে কথা বলেন ইসলামি বক্তা ও গবেষক শায়খ আহমাদুল্লাহ। এরপর মন্তব্য করেন আরেক ইসলামি চিন্তাবিদ ও বিশ্লেষক মিজানুর রহমান আজহারী। গত ৪ এপ্রিল রাত ১০টায় ‘লাইট আপন লাইট’ (দ্বিতীয় পর্ব) শিরোনামে ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানের একটি অংশে অভিনেত্রীকে নিয়ে কথা বলেন তিনি।
এ সময় মৌসুমীর নাম উল্লেখ না করে আজহারী বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন চিত্রনায়িকার আকুতির কথা শুনেছি। তিনি বলেছেন যে, আমার মৃত্যুর পরে আমার মুভিগুলো, ভিডিও ক্লিপসগুলো সবাই ডিলিট করে দেবেন।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘তো সারা জীবন এই পাপের পথে চলে, এ জাতীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে শেষ জীবনে এটা বললে কি আসলে ডিলিট হয়? এই সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বলতে কিছু আছে, আমি চাইলেই কি ভিডিওগুলো ডিলিট করা যাবে? যাবে না, তাই আমরা শেষ সময়ে না বুঝে, শালীনতার পথে, সত্যের পথে, কল্যাণের পথে এখন থেকেই যেন থাকি। সময় চলে যাওয়ার পর যেন আমরা না বুঝি।’
এ বক্তা আরও বলেন, ‘আমাদের চিত্রনায়িকা যে বোন এ আকুতি পেশ করেছেন, আসলে কি তার পক্ষে গোটাবিশ্বে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে তার মুভি, ভিডিওগুলোর যে সিন আছে, সেগুলো কি ডিলিট করা সম্ভব? দেখা যাবে, মৃত্যুর পরও সেগুলো চলতে থাকবে।’
মৌসুমীর এই অনুধাবন থেকে অন্য নায়িকাদের জন্য শিক্ষার বিষয় আছে জানিয়ে ইসলামি এ চিন্তাবিদ বলেন, ‘এ বোনের (মৌসুমী) কথা শুনে, রুপালি পর্দার অন্যান্য বোনেরা, আমরাও যেন একটু উপলদ্ধি করি, আমরা কোন পথে হাঁটছি? আমার কাজ, ক্যারিয়ার কি আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে আছে? এটা দিয়ে কি আসলে গণমানুষের কল্যাণ হচ্ছে? নাকি অশ্লীলতার দিকে ধাবিত হচ্ছি? একটু চিন্তা করি আমরা। একটু চিন্তা করি আমাদের লাইফস্টাইল সম্পর্কে।’
এ সময় কোরআনের আলোকে ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “মানুষের হৃদয়ে একটি নুর থাকে আর কুরআন একটি নুর, দুই নুর মিললেই নুরুন আলা নুর (আলোর ওপর আলো)। এটা নিয়েই আমাদের লাইভের নামকরণ ‘লাইট আপন লাইট’। প্রত্যেকের মধ্যে সেই সত্যের অংশ আছে। একটু চিন্তা করলেই বেরিয়ে আসবে। সঠিক উত্তর পেয়ে যাবেন। চলচ্চিত্র জগতের পথটা কেমন। তবে শালীনভাবে কোনো কিছু উপস্থাপন করলে ভিন্নকথা। অশ্লীলতার দিকে ধাবিত করে এমন চলচ্চিত্র, এগুলোর জন্য আমরা শেষ বিচারের দিন কী জবাব রেডি করেছি।”
এ পর্যায়ে আলোচনার শেষ দিকে তিনি বলেন, আমাদের যে বোন সোশ্যাল মিডিয়াতে আকুতি পেশ করেছেন, মৃত্যুর পর তার লাশ যেন কেউ না দেখে। মৃত্যুর পর তার ভিডিওগুলো যেন ডিলিট করে দেওয়া হয়। তার (মৌসুমী) দিকে খেয়াল করে অন্যান্য বোনরা তাদের লাইফস্টাইল নিয়ে একটু ভেবে দেখি। আমাদের দেশের অনেক বোনকে দেখেছি এবং ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বোনকে দেখেছি, তারা ইসলামের পথে ফিরে এসেছে। আমরা তাদের স্বাগত জানাই।’
ঘণ্টাব্যাপী এই লাইভের আলোচনা পর্বে নানান বিষয়ে কথা বলেছেন মিজানুর রহমান আজহারী। সেখানে প্রায় ৩ মিনিটের মতো স্থান পায় চিত্রনায়িকা মৌসুমী বিষয়ক আলোচনা।
এদিকে মৌসুমীর এমন ইচ্ছার কথা নিয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন নির্মাতা মালেক আফসারী। নির্মাতা বলেন, মৌসুমী আমার পরিচালিত ‘আমি জেল থেকে বলছি’ সিনেমার নায়িকা ছিলেন।
মৌসুমীকে উদ্দেশ করে নিজের ইউটিউবে বলেন, আপনি যে সিনেমাগুলো দর্শকদের ডিলিট করতে বললেন, আপনার সিনেমাগুলো যে চলছে ইউটিউবে সেগুলোর সঙ্গে অনেক পরিবারের রুজি জড়িত। আমি একটি সিনেমার কথা বলি— আমি জেল থেকে বলছি সেটি মিনিমাম একত্রে চালায় ২০ জন। কেউ কারো বিরুদ্ধে কপিরাইট দেয় না। এতে মাসে মিনিমাম দেড় লাখ টাকা করে আয় হয় তাদের। এ দিয়ে এদের সংসার চলে। তবে এ ছবিগুলো ডিলিট করে দিলে তাদের সংসার চলা বন্ধ হয়ে যাবে ম্যাডাম (মৌসুমী)। বুঝেন না কেন?
মৌসুমীকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, তবে আপনাকে আমি একটা পরামর্শ দিই— আপনি তো অনেক কামাইছেন, সুপারহিট ছিলেন, যশ-খ্যাতিও পেয়েছেন। কোনো কিছুর আপনার অভাব নেই। এখান থেকে কিছু টাকা ইনভেস্ট করে ওই ছবিগুলোর কপি রাইট কিনে নেন। পরে সেগুলো ধ্বংস করে দেন। আপনি নিজেও জানেন, রিজিকের তাগিদে আপনি মারা যাওয়ার পর কেউ ডিলিট করবে না।
এ পরিচালক আরো বলেন, আপনি ৩০ বছরে অনেক দিয়েছেন শিল্পকে। আপনার এগুলো অবশ্যই গবেষণায় কাজে দেবে। আপনার সব থেকে প্রিয় ছিল ইন্ডাস্ট্রি। তবে আমি বলব— আপনার প্রিয় না। যেহেতু সব কিছু ডিলিট করতে চাচ্ছেন। এটা আপনার ধর্মের সঙ্গে যায় না বলে উপলব্ধি হয়েছে।
পরিচালক বলেন, আমি জেল থেকে বলছি সেখানে যে অভিনয় করেছেন, সেটি দেখে আমি কান্না করেছি। আপনি হজে চলে যান। আড়াল হয়ে যান। খুব ভালো লাগবে ব্যাপারটা। কিন্তু আড়াল না হয়ে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত যদি চলচ্চিত্রে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন সেটি খারাপ হবে আপনার জন্য। মৃত্যুর আগের দিন মিডিয়াতে নাচ গান করলেন, পর দিন সব মুছে ফেলার অনুরোধ করলেন এটি কি সম্ভব? তার চেয়ে বরং নিজেকে আড়াল করে ফেলেন। ধর্মীয় পথে যান। যদি মনে করেন এ পথটা খারাপ ছিল, যেটি বুঝতে আপনার ৩০ বছর লাগছে। ৩০ বছর অভিজ্ঞতার পর বলছেন আমি সব কিছু মুছে ফেলব। এটা কেমনে সম্ভব? আমার খারাপ কাজগুলো বা ছবিগুলো সরিয়ে ফেলব আর ভালোটুকু রাখব। তা হলে আমাদের উচিত হবে, সারা জীবন ভালো কাজটুকুই করতে হবে।
এ পরিচালক চিত্রনায়িকা শাবানার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আপনি হজে চলে যান। হজ থেকে এসে আপনাকে আমরা শাবানা ম্যাডামের মতো দেখতে চাই। আপনি আড়াল হয়ে যান। পাশাপাশি কিছু টাকা ইনভেস্ট করে ওই ছবিগুলোর কপিরাইট কিনে নেন। পরে জীবিতাবস্থায় সেগুলো ধ্বংস করে দিন। এর মধ্য দিয়ে নতুন জীবন শুরু করুন। শাবানা ম্যাডামের মতো করে নিজেকে সরিয়ে ফেলেন। ওপরওয়ালা আপনাকে আরো উন্নতি দেবেন। শাবানা ম্যাডাম যেভাবে আড়াল হয়ে গেছেন। আপনিও সেভাবে আড়াল হয়ে যান। পাশাপাশি ফিল্ম ক্লাবের সদস্য থেকে সরে যান।
/সূত্র: ঢাকা পোস্ট ও কালের কণ্ঠ